‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য,/ ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা/ চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য/ কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।/ চিমনির মুখে শোনো সাইরেন–শঙ্খ,/ গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে,/ তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য/ জীবনকে চায় ভালোবাসতে।’
শ্রমিক–কৃষক মেহনতি মানুষের রক্তে ঘামে ভেজা মে দিবস আজ। আজ ১ মে, অধিকার বুঝে নেওয়ার দিন। ১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগোর ‘হে’ মার্কেটে মজুরের তাজা খুনে রাঙা রাজপথ ধরে লাল ঝান্ডা উড়িয়ে মেহনতি মানুষ নিজের অধিকার বুঝে নিয়েছিল। মে দিবসের সংগ্রাম শ্রমিক শ্রেণীকে উপহার দিয়েছে সংগ্রামী লাল পতাকা ও মুষ্টিবদ্ধ হাত। এই দিনটিতে বিশ্বের প্রতিটি দেশের মেহনতি মানুষ ভৌগোলিক দূরত্ব অতিক্রম করে ধর্মীয়, ভাষাগত, আচার–আচরণগত ভেদাভেদ ভুলে এক পতাকাতলে এসে জড়ো হয়। সমস্বরে আওয়াজ তোলে, ‘দুনিয়ার মজদুর, এক হও লড়াই করো। লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই।’ শ্রমিক শ্রেণীর জন্য আজকের দিনটি তাই দৃপ্ত শপথে বলীয়ান হওয়ার দিন, শেকল ছেঁড়ার দিন, উৎসবের দিন, একই সাথে শোকেরও দিন। আজ সরকারি ছুটির দিন।
১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে ৪ মে পর্যন্ত আমেরিকার শিকাগো শহরে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে বুকের রক্ত ঢেলে শ্রমিক শ্রেণী রচনা করেছে মে দিবসের সংগ্রামী ইতিহাস। পুলিশের গুলিতে নিহত হন ছয় শ্রমিক। আহত হন অনেকে। পাশেই কাঠচেরাই কারখানায় আরেকটি সভায় বক্তৃতা করছিলেন শ্রমিক নেতা স্পাইজ। তিনি ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সাথীদের সাথে পরামর্শ করে প্রতিবাদ সমাবেশ আহ্বান করেন। ৪ মে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের প্রতিবাদ সমাবেশ। রাত তখন ১০টা। শেষ বক্তা ফিলডেন বক্তৃতার ইতি টানছেন। এ সময় ওয়ার্ড নামে একজন পুলিশ সার্জেন্ট সমাবেশ বন্ধ করার নির্দেশ দেন। এ সময় সমাবেশস্থলে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। পুলিশের এক চর বোমাটি বিস্ফোরণ করে। সাথে সাথে নির্বিচারে শুরু হয় গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জ। ঘটনাস্থলে ৪ শ্রমিক ও ৭ পুলিশ নিহত হয়। রক্তে ভিজে যায় হে মার্কেট চত্বর। আগের দিন ৩ মে পুলিশের গুলিতে এক কিশোর শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয়। তার সাদা শার্টটি রক্তে লাল হয়ে যায়। রক্তে রঞ্জিত শার্টটি একটি কঞ্চিতে তুলে ধরে স্লোগান দিতে দিতে দৌড়াতে থাকে গুলিবিদ্ধ কিশোরটি। এর আগে পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণীর পতাকা ছিল সাদা, শান্তির প্রতীক। সেদিন থেকে কিশোরের রক্ত লাল শার্টটিকে প্রতীক হিসেবে ধরে শ্রমিক শ্রেণী লাল পতাকাকে বরণ করে নিল। ৩ মে যারা শহীদ হয়েছিল তাদের গণকবর দেওয়া হয়। রাতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। সকালে দেখা যায় বৃষ্টির পানিতে কবরের মাটি সরে গিয়ে মুষ্টিবদ্ধ একটি হাত বেরিয়ে এসেছে। শ্রমিকেরা মনে করল এ মুষ্টিবদ্ধ হাত তাদেরকে সংগ্রাম না থামানোর জন্য ডাক দিয়ে যাচ্ছে। সেই থেকে শ্রমিক শ্রেণী যখন কোনো সংগ্রামী শপথ গ্রহণ করে তখন মুষ্টিবদ্ধ হাত ঊর্ধ্বে তুলে শপথ করে।
১৮৮৮ সালে আবারো ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। সেই ১ মে’তেই আন্দোলনের সূচনা হয়। বিশ্বের সকল দেশে শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে মে দিবস পালনের সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয় ১৮৯০ সালে। সেই থেকে এ দিনটি শ্রমিক কৃষক মেহনতি মজদুরের দিন।
বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি বিপ্লব ও অন্যান্য আধুনিক সুযোগ–সুবিধার উৎকর্ষের ফলে মানুষের জীবনযাত্রায় অনেক উন্নয়ন ঘটলেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি আমাদের দেশের শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশে এখনো শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, কর্মঘণ্টা ও নিরাপদ কর্মস্থলের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক কোনো ক্ষেত্রেই শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মুক্তবাজার অর্থনীতি ও নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্যের কারণে স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষদের পরিবার–পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশিরভাগ শ্রমিকের চাকরির নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা নেই। একজন শ্রমিক হিসেবে নারী শ্রমিক শ্রম আইন অনুযায়ী সব অধিকারের সমান অংশীদার হলেও বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। নারী শ্রমিক–অধ্যুষিত গার্মেন্টস, অন্যান্য ক্ষুদ্র শিল্প ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে স্বল্প মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নিম্ন পদমর্যাদা, খণ্ডকালীন নিয়োগ, যখন–তখন ছাঁটাই এবং কর্মঘণ্টার অধিক কাজ করানো হয়। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী নারী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র থেকে সাপ্তাহিক ছুটি, মাতৃত্বকালীন ভাতা, ছুটি ও অন্যান্য সুযোগ–সুবিধা দেওয়া হয় না। এছাড়া অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ, সুপেয় পানির অভাব, যৌন হয়রানিসহ অনেক সমস্যা তাদের প্রতিনিয়ত ভোগ করতে হয়। সমকাজে সমমজুরি ও নারী–পুরুষের মজুরি বৈষম্য তো রয়েছেই। কৃষি ও গৃহস্থালির কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকলেও তাদের কাজের কোনো স্বীকৃতি নেই। গৃহকর্মে নিয়োজিত নারীরা সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত। ভাত–কাপড়, মাথা গোঁজার ঠাঁই, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ পাওয়া প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষের বিশাল অংশ এখনো এই অধিকার থেকে বঞ্চিত। তারা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখে, কিন্তু স্বপ্নপূরণের পথ খুঁজে পায় না।
স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বিপুল উৎসাহ–উদ্দীপনা নিয়ে মে দিবস পালন শুরু হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের প্রতি সম্মান জানিয়ে ১ মে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন।
জাতির পিতা দীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত। একদিকে শোষক, অন্যদিকে শোষিত। আমি শোষিতের দলে।’ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সেই শোষিতদের ভাগ্য আজও বদলায়নি।
মহান মে দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। মে দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শ্রমিক সমাবেশ, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। চট্টগ্রামেও বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।