অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ ফিরল সুপ্রিম কোর্টের হাতে

হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়

| বুধবার , ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। এছাড়া রায়ে আগামী তিন মাসের মধ্যে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিচারপতি আহমেদ সোহেল ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর বেঞ্চ স্থানীয় আদালতের (অধস্তন আদালত) নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার এ রায় দিয়েছে।

জনস্বার্থে করা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সাদ্দাম হোসেনসহ কয়েকজনের এই মামলায় আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আনীক আর হক, ডিএজি মোহসিনা খাতুন, ডিএজি মোহাম্মদ মেহেদী হাসান, এএজি শেখ নাসের ওয়াহেদ, এএজি জুনায়েদ হোসেন খান, এএজি কাজী কামরুন্নেসা মুননী। খবর বিডিনিউজ ও বাসসের।

ইন্টারভেনরের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম এবং আইনজীবী মাহিউদ্দিন। আদালতের সহায়তাকারী ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া। রায়ের পর অ্যামিকাস কিউরি শরীফ ভূঁইয়া বলেন, ১১৬ অনুচ্ছেদকে পরবর্তীতে যেভাবে সংশোধন করা হয়েছিল, সেই সংশোধনসবগুলোকে আজকে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। আপনারা জানেন যে, ১১৬ অনুচ্ছেদ১৯৭২ সালের সংবিধানে যেভাবে ছিল, তাতে অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে সুপ্রিম কোর্টের উপর ন্যস্ত ছিল। পরবর্তীতে এটাকে চতুর্থ, পঞ্চম এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংশোধন করে এই কর্তৃত্ব রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয়। এবং আরো কিছু সংশোধনী করে রাষ্ট্রপতিকে সুপ্রিম কোর্টের সাথে পরামর্শক্রমে এ কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে বলা হয়। পঞ্চম সংশোধনীটা আগেই আপিল বিভাগ বাতিল ঘোষণা করেছিলেন। আজকে ১১৬ অনুচ্ছেদের চতুর্থ এবং পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করা হয়। যার ফলে ১১৬ অনুচ্ছেদ ১৯৭২ সালের অবস্থায় ফিরে গেছে। এতে করে অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব সম্পূর্ণভাবে সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত হয়েছে।

রায়ের পর মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, এ রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হলো এবং এ রায়ের মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের করায়ত্ব এবং রাজনৈতিক প্রভাব থেকে অধস্তন বিচার বিভাগ মুক্তি পেল। একই সাথে আমাদের অধস্তন আদালতের বিচার বিভাগের অফিসাররা তাদের আত্ম মর্যাদা ও সম্মান ফিরে পেল। আজকের এ রায়ের মাধ্যমে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ যা মূল সংবিধানে ছিল তা ফিরে এল। অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, ছুটি, পদোন্নতি সবকিছু ছিল রাষ্ট্রপতির উপরে। এ রায়ের ফলে তা ফিরে গেল সুপ্রিম কোর্টে উপরে ন্যস্ত করা হলো।

তিনি বলেন, একই সাথে নিম্ন আদালতের বিচার বিভাগের অফিসারদের জন্য একটি রুলস করা হয়েছিলতাও বাতিল করা হয়েছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে আলাদা বিচার বিভাগের সচিবালয় গঠন করা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বিষয়। তাই এটি যেন সরাসরি আপিল করা হয় সে বিষয়ে সার্টিফেকেট দেওয়া হয়েছে।

শিশির মনির বলেন, এই যাত্রায় যদি বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে, তাহলে আমাদের বিবেচনায় এই ভারতীয় সাবকন্টিনেন্টে ভারতের বিচার ব্যবস্থাকে আমরা এখনও সম্মানের চোখে দেখি। যদি আমাদের বিচার বিভাগ এ রায়ের পরে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, তাহলে আমাদেরকেও এই ভারতীয় উপমহাদেশে একটি নতুন বিচারিক সিস্টেমের ক্ষেত্রে গুরুত্বের দৃষ্টিতে দেখা হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থার যে অনিশ্চয়তা আছে, যে ইনফ্লুয়েন্স আছে, যে প্রভাব আছেযখন যে সরকার আসে, তখন তারা বিচার বিভাগকে ইনফ্লুয়েন্স করতে চায়। দিনে কোর্ট বসায়, রাতে কোর্ট বসায়, যখন যাকে খুশি নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করবে; কে পছন্দের, কে অপছন্দেরএসব দুষ্টচক্রের অবসান ঘটবে।

গত বছরের ২৫ আগস্ট ১০ জন আইনজীবীর পক্ষে মূল সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহালের নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। ওই আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাই কোর্ট রুল জারি করে বিদ্যমান সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চায়।

বর্তমান সংবিধানের (সংশোধিত) ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অধস্তন আদালতের দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, বিচারকর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্বে নিযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকবে।

পরে এ অনুচ্ছেদে সংশোধনী আনায় বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি, ছুটি, শৃঙ্খলা ইত্যাদি নির্বাহী বিভাগের আওতায় চলে আসে। এসব কাজ রাষ্ট্রপতির পক্ষে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ করে থাকে।

মামলাটি বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের নেতৃত্বাধীন হাই কোর্ট বেঞ্চে শুনানি ও নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ছিল। তবে গত ২৪ মার্চ বিচারপতি ফারাহ মাহবুব আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় বেঞ্চটি ভেঙে যায়। এরপর নতুন বেঞ্চ নির্ধারণের আবেদন করেন রিটকারী আইনজীবী শিশির মনির। গত ২০ এপ্রিল প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ রিট আবেদন নিষ্পত্তির জন্য হাই কোর্ট বেঞ্চ গঠন করে দেন। এরপর শুনানি নিয়ে গতকাল রায় ঘোষণা করা হলো।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচবির সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা, আসামি সহস্রাধিক
পরবর্তী নিবন্ধবৈঠক শেষে যা জানাল রাজনৈতিক দলগুলো