স্মার্টফোনের ব্যবহার ছাড়া এখন জীবনই যেন চলছে না। এই ব্যবহার এতই বেশি যে আপনি হয়তো এই লেখাটিও পড়ছেন স্মার্টফোনের স্ক্রিনে! একটি মাস কিংবা একটি দিন তো দূরে থাক, কয়েক ঘণ্টাও এখন স্মার্টফোন ছাড়া কল্পনা করা যায় না। কি যেন নেই অবস্থায় ছটফটানি দেখা যায়। তবে উপকারী এই যন্ত্রটিই হতে পারে বড় ক্ষতির কারণ!
অতিরিক্ত কোন কিছু তো ভালো না। আর অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারে তো আরো সমূহ বিপদের ঘনঘটা। এজন্য জাপানের মধ্যাঞ্চলের তোয়োয়াকে সিটির একটি সুন্দর প্রস্তাব সমপ্রতি প্রকাশিত হয়েছে। যাতে অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের কারণে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে দৈনিক সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা স্মার্টফোন ব্যবহারের প্রস্তাব করেছে।
তোয়োয়াকে মেয়র মাসাফুমি কোকি এ সম্পর্কে বলেছেন, “আইনে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেই এবং এটি বাধ্যতামূলকও নয়। অতিরিক্ত ডিভাইস ব্যবহারের কারণে ঘুমের সমস্যা সহ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি এড়াতেই এই উদ্যোগ। এটি কেবল স্বেচ্ছামূলক নির্দেশনা। আমরা স্বীকার করি, দৈনন্দিন জীবনে স্মার্টফোন প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য। অনুমোদন পেলে এটি অক্টোবরে কার্যকর হবে।”
প্রস্তাবের খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাত ৯টার পর আর স্মার্টফোন ব্যবহার না করতে বলা হবে। মাধ্যমিক স্তর ও এর ঊর্ধ্বের শিক্ষার্থীদের জন্য এ সময়সীমা রাত ১০টা পর্যন্ত।
এর আগেও জাপানে আমরা এ ধরনের প্রাযুক্তিক নিষেধাজ্ঞার কথা শুনেছি। ২০২০ সালে জাপানের পশ্চিমাঞ্চলীয় কাগাওয়া প্রদেশে শিশুদের জন্য ভিডিওগেম ব্যবহারে সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল–সাধারণ দিনে এক ঘণ্টা এবং ছুটির দিনে সর্বোচ্চ ৯০ মিনিট, পাশাপাশি রাতের বেলায় স্মার্টফোন ব্যবহারে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়।
প্রযুক্তির প্রসারে স্মার্টফোন এখন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বে এখন ৪০০ কোটির বেশি মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। সমপ্রতি একটি সমীক্ষা বলছে, মানুষ দৈনিক গড়ে ৪.৮ ঘণ্টা খরচ করেন মোবাইল ফোনের নানা অ্যাপের পেছনে। যা হিসাব করলে, একজন মানুষ দিনে যতক্ষণ জেগে থাকেন তার প্রায় এক তৃতীয়াংশ খরচ করছেন মোবাইলের নানা অ্যাপস ব্যবহারে।
যন্ত্রটি মানুষে মানুষে যোগাযোগ সহজ করলেও এর অতিরিক্ত ব্যবহার মানুষের শরীর ও মনের জন্য নানা ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, স্মার্টফোনের ব্যবহার মস্তিষ্ক, দৃষ্টিশক্তি ও শিশুদের বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মোবাইল ফোনের ব্লু লাইট চোখের রেটিনার ক্ষতি করতে পারে এবং অতিরিক্ত ব্যবহারে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। ফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত সময় ব্যয় করলে অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার দেখা দিতে পারে। এটি দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগও বাড়ায়। গবেষকদের যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে, স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার ঘাড়, কাঁধ, কনুই এবং হাতে পেশিজনিত ব্যথার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, যা সাধারণত বার্ধক্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। গবেষণায় আরও দেখা যায়, স্মার্টফোন ব্যবহারের সময় শরীরের ভঙ্গির পরিবর্তনের কারণে ব্যথা শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। দীর্ঘক্ষণ স্মার্টফোন ব্যবহারের সময় অনেকেই সামনের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে রাখেন। ফলে ঘাড় ও মেরুদণ্ডে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয় এবং দীর্ঘ মেয়াদে ঘাড়ব্যথার কারণ হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, স্মার্টফোনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে সচেতন হতে হবে। এর পাশাপাশি স্মার্টফোন ব্যবহারে নিয়মিত বিরতি নেওয়া এবং সঠিক অঙ্গভঙ্গি বজায় রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা বলছেন, ফোন ব্যবহার করার সময় মাথা সোজা রাখতে হবে এবং ফোনটি চোখের উচ্চতায় ধরে রাখতে হবে। দীর্ঘক্ষণ টেক্সট করার সময় বারবার হাত বদলানো এবং দীর্ঘ সময় ফোনে কথা বললে হেডফোন ব্যবহার করা উচিত। মোবাইল ফোনে ৫০ মিনিটের বেশি কথোপকথনে আমাদের মস্তিষ্কের উপর প্রভাব পড়ে। এক হাতে ফোন না ধরে দুই হাতে ধরলে আঙুলের ওপর চাপ কমে। এ ছাড়া চোখের জন্য প্রতি ২০ মিনিট পর স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ২০ ফুট দূরের কোনো কিছুর দিকে ২০ সেকেন্ড তাকানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সাধারণত ব্যবহারের পর মোবাইল ফোন পকেটেই রাখা হয়। কিন্তু মোবাইল ব্যবহার না করলেও এর থেকে রেডিয়েশন বের হয়। সুতরাং মোবাইল ফোন পকেটে রাখা মোটেই নিরাপদ নয়। এই কারণে আপনি যখন ফোন ব্যবহার করছেন না, তখন উচিত হয় এটিকে ব্যাগে রাখা নয়তো হাতে রাখা। যেসব জায়গায় নেটওয়ার্ক সিগন্যাল কম পাচ্ছেন সেখানে মোবাইল কম ব্যবহার করাই উচিত। কারণ দুর্বল নেটওয়ার্কযুক্ত স্থানে আপনার ফোন নেটওয়ার্ক খোঁজার প্রাণপণ চেষ্টা করে। আর তখনই ফোন থেকে সবচেয়ে বেশি রেডিয়েশন বের হয়।
রোজ কত ঘণ্টা স্ক্রিন টাইম হওয়া উচিত আপনার! এই প্রশ্ন অনেকের মনেই থাকে। রোজ ঠিক কত ঘণ্টা ফোন ঘাঁটলে শরীরে কোনো ক্ষতি হবে না আসুন জেনে নেওয়া যাক। বয়সভেদে স্ক্রিনটাইম নির্ধারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিছু পরামর্শ দিয়েছে। যেমন– ক) ১ বছরের কম বয়সে স্ক্রিন এড়ানো উচিত। ১–২ বছরের শিশুদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। খ) ৩–৪ বছরের শিশুদের জন্য স্ক্রিন ব্যবহার দৈনিক ১ ঘণ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। গ) ৫–১৭ বছরের কিশোরদের জন্য সর্বোচ্চ ২ ঘণ্টা। ঘ) প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও দিনে ২ ঘণ্টার বেশি স্ক্রিন টাইম এড়িয়ে চলা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা বলছেন তাঁরা সমপ্রতি যে গবেষণা করেছেন, তাতে তাঁদের বের করা কৌশলগুলো অনুসরণ করেছেন অনেকেই। এতে তাঁদের মুঠোফোন ব্যবহারের সময় কমেছে। এমনকি অনেকের মুঠোফোন আসক্তিও কমে গেছে। ফলে ঘুমও ভালো হয়েছে।
‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড অ্যাডিকশন’ শীর্ষক সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষকদের বের করা সেই ১০টি কৌশল জেনে নেওয়া যাক।
* নোটিফিকেশন নিয়ন্ত্রণ: মুঠোফোন থেকে অপ্রয়োজনীয় সব নোটিফিকেশন (শব্দ, ব্যানার, ভাইব্রেশন) বাদ দিতে হবে।
* সময় নির্ধারণ: কোন অ্যাপ কতক্ষণ ব্যবহার করবেন তার সময় আগে থেকেই নির্ধারণ করতে হবে। চাইলে মুঠোফোনের পর্দা চালুর সময় নির্ধারণ করে নিতে পারেন।
* ঘুমের সময় মুঠোফোন দূরে রাখুন: অনেকেই ঘুমের সময় মুঠোফোন কাছাকাছি রাখেন। এ অভ্যাস বাদ দিতে হবে। এ জন্য মুঠোফোন সাইলেন্ট বা ভাইব্রেশন বন্ধ করে ঘুমানোর জায়গা থেকে দূরে রাখতে হবে।
* মুঠোফোনের পর্দা গ্রেস্কেল: আইফোন বা অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমে চলা মুঠোফোনে গ্রেস্কেল মোডে সুইচ অন করে রাখতে হবে। পর্দা সাদা–কালো থাকলে মুঠোফোনের আকর্ষণ কমে যায়, ফলে ব্যবহার কম হয়।
* সামাজিক যোগাযোগ অ্যাপ লুকানো: যাঁরা ইমেইল, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকের মতো অ্যাপ ব্যবহার থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারছেন না, তাঁরা চাইলে অ্যাপগুলো লুকিয়ে রাখতে পারেন। এ জন্য অ্যাপগুলো মুঠোফোনের হোম স্ক্রিন থেকে সরিয়ে আলাদা ফোল্ডারে রাখতে হবে।
* মুঠোফোন থেকে দূরত্ব বজায়: খুব বেশি প্রয়োজন না হলে মুঠোফোন দৃষ্টিসীমার বাইরে রাখতে হবে। প্রয়োজনে মুঠোফোন সাইলেন্ট করে পর্দার দিক নিচে রেখে কাজ করতে হবে।
* কঠিন আনলক পদ্ধতি: মুঠোফোনের আনলক পদ্ধতি কঠিন করতে হবে। প্রয়োজনে মুঠোফোনের টাচ আইডি বা ফেইস আইডি সুবিধা বন্ধ রাখতে হবে। খোলার পদ্ধতি কঠিন হলে বারবার আনলক করে মুঠোফোন ব্যবহার করতে মন চাইবে না।
* উজ্জ্বলতা কমানো: ফোনের ডিসপ্লে সেটিংস থেকে মুঠোফোনের উজ্জ্বলতা যতটা সম্ভব কমিয়ে রাখতে হবে। এতে ফোনের নীল আলো কমবে এবং চোখের জন্য উপকার হবে।
* মুঠোফোনের কাজ কম্পিউটারে করা: যে কাজ আপনি কম্পিউটারে করতে পারেন সেগুলো মুঠোফোনে করবেন না। এতে মুঠোফোনের ব্যবহার ও আসক্তি কমবে।
* মুঠোফোন রেখে বাইরে: যখন বাইরে যাবেন প্রয়োজন না হলে সঙ্গে মুঠোফোন নেবেন না। যেমন কেনাকাটা বা ব্যায়াম করার সময় যতটা সম্ভব মুঠোফোন ঘরে রেখে যাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। এতে ধীরে ধীরে মুঠোফোনের প্রতি আকর্ষণ কমে যাবে।
লেখক: উপ–পরিচালক (জনসংযোগ), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)











