একটি কেইস হিষ্ট্রি দিয়ে লেখাটি শুরু করছি। ৪ বছরের ছেলে নাম রুহি(ছদ্ম নাম)। চট্টগ্রাম মা-শিশু ও জেনারেল হাসপাতালের অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্রে এসেছিল। বাবা-মার অভিযোগ ছিল সে অতি চঞ্চল, অসম্ভব ধরনের অস্থির, আক্রমনাত্মক ব্যবহার এবং সঠিকভাবে কথা বলতে না পারা। রুহি একটি ফুটফুটে ছেলে। স্বাস্থ্য মোটামুটি ভাল। শারীরিক কোন সমস্যা আছে বলে মনে হয়নি। তার ইতিহাস নিয়ে জানা গেলো যে জন্মের সময় তার কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছিল। সে জন্মের পরপর কান্না করেনি যার জন্য তাকে হাসপাতালে নবজাতক ইউনিটে নিবীড় পরিচর্যায় ভর্তি করতে হয়েছিল। অক্সিজেনসহ হাই পাওয়ারের নানা ধরনের এন্টিবায়োটিক দিতে হয়েছিল। ওখানে প্রায় ২ সপ্তাহ খানিক ছিল। এর পরবর্তীতে বাব-মার কাছ থেকে জানা যায় যে, তার বসা, উঠা, দাঁড়ানো এবং হাঁটা মোটামুটি সঠিক বয়সে হয়েছে। কিন্তু তার মৌখিক যোগাযোগ এবং শারীরিক ভঙ্গির মাধ্যমে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারতো না। এটাকে verbal and non verbal communication এর সমস্যা বলা হয়। সমবয়সীদের সাথে তার আচরণ ছিল আক্রমনাত্মক। তবে সে ছবি আঁকতে ভালোবাসতো এবং গুনগুন করে গান গাইতে চাইতো। আমাদের “অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্রে” আসলে আমরা তাকে ক্রমান্বয়ে স্পীচ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি এবং সাইকোলজীকেল কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে স্বাভাবিক বাচ্চার মত অনুভূতি প্রকাশে সক্ষম হই। সম্প্রতি পুনরায় আমাদের “শিশু বিকাশ কেন্দ্রে” আসে। এখন সে অনেকটা বয়স অনুপাতে স্বাভাবিক শিশুর মত আচরণ করে। মায়ের নির্দেশ মোতাবেক সূরা বলতে পারে। গাড়ী এবং বাসের মত জটিল ছবি আঁকতে পারে। তবে এখনো স্বাভাবিক কথা সে বলে না এবং এর জন্যই বাবা-মার “শিশু বিকাশ কেন্দ্রে” আসার কারণ। আমরা বাবা-মাকে অভয় দিয়েছি যে আমাদের বিকাশ কেন্দ্রের বিভিন্ন ধরনের থেরাপীর মাধ্যমে শিশুর কথা বলার সমস্যাটি সমাধান হয়ে যাবে। এখানে লক্ষ্যনীয় যে এই শিশুর ক্ষেত্রে কোন প্রকার ঔষধ ব্যবহার করা হয়নি। শুধুমাত্র বিভিন্ন প্রকার থেরাপির মাধ্যমে শিশুটিকে সুস্থ্য করার প্রয়াস হয়েছিল মাত্র।
গত ২রা এপ্রিল ছিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। করোনাকালীন এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল- “প্রতিদিন কর্মক্ষেত্রে অটিজম শিশুর অংশগ্রহণ: করোনা-উত্তর অটিজম শিশুদের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ ও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি”। ঐ দিন জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত প্রতিটি দেশকে সারাবিশ্বের সকল অটিজম শিশুর মান উন্নয়নের লক্ষ্যে সচেতন হওয়া ও নীতি নির্ধারণ তৈরী করা। এটি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাশকৃত একটি নীতিমালা। বাস্তবিক পক্ষে অটিজম বা অঝউ কোন রোগ নয়। এটি মস্তিস্কের বিকাশ জনিত সমস্যা মাত্র। ফলে শিশুর মানসিক বিকাশের প্রতিবন্ধকতা থাকে। স্বাভাবিক শিশুর মত ঐ শিশু পরিবারের, সমাজের কিংবা বন্ধুবান্ধবের মাঝে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না। দেখতে শুনতে স্বাভাবিক ও উজ্জল বর্ণের হলেও এরা নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা থাকতে পছন্দ করে। যেটার লক্ষণ কারো ক্ষেত্রে চোখে বুঝা নাও যেতে পারে। কারো কমবেশি Co-morbidity থাকে। এই ধরনের শিশু অনেক অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন- বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি, উচ্চস্বরে চিৎকার করা, চেচামেচি করা, সবকিছু ভেঙ্গে ফেলা, মা বাবা বা আত্মীয় স্বজনকে মারধর করা বা কোন কিছু ছুড়ে মারা, ঠিক মত টয়লেট ট্রেনিং না করা, কিছু কিছু ক্ষেত্রে খিঁচুনী বা মানসিক পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। এরা অনেক সময় প্রকৃতি ভালোবাসে, বাহিরের জগতের নীল আকাশ, কালো মেঘ বা বৃষ্টি হলে খুবই উৎফুল্ল হয়ে যায়। আবেগ প্রবণ হয়, অনেক সময় বাহিরে বের হয়ে রাস্তায় বা পার্কে খুব আনন্দের সাথে দৌড়াদৌড়ি করে, গুনগুন গান করে, ফুলকে ভালোবাসে, প্রজাপ্রতির সাথে খেলা করে, মনে মনে অনেক কবিতা আবৃত্তি করে। বেশীরভাগ অটিজম শিশুর সমস্যা তত গুরুত্ব হয় না। মারাত্মক হলে ভিন্ন কথা।
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারিতে বেশিরভাগ অটিজম শিশু ঘরেতেই আছে, স্কুল বা বাহিরে যাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। আমাদের দেশের বাস্তবতায় আমাদের বাসস্থান অটিজম শিশুর জন্য মানান সই নয়। তাই এই পরিস্থিতিতে অটিজম আক্রান্ত শিশুর মা বাবারা স্বস্তিকর অবস্থায় ছিল না বলে আমার মনে হয়। এক্ষেত্রে কিছু উপদেশ বা পরামর্শ আমি লিখছি যা পরিবারের কাজে আসতে পারে। আগেই বলেছি বেশিরভাগ অটিজম শিশুরা প্রকৃতি ভালোবাসে। তাই ঘরের ভিতরে প্রাকৃতিক পরিবেশ আনুন। ঘরের ১টি রুমকে ফার্নিচার সরিয়ে রুমটাকে খোলামেলা রাখুন। প্রয়োজনে ঘরটিকে কৃত্রিম গাছপালা, ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখুন। রং তুলি দিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্বলিত ছবি দেয়ালে লাগান। তাদের সাথে এমনভাব করুন বা আচরণ ভঙ্গি করুন যেন এটি একটি বাহিরের পরিবেশ, কিছু কাগজের ফুলও তৈরি করে রাখতে পারেন। যেহেতু অটিজম শিশুরা বহুদিন যাবৎ ঘরে আটকে আছে সেহেতু তাকে সপ্তাহে ৭ দিনের জন্য ১টি রুটিন করে দিন। সকালে ঘুম থেকে রাত্রে বিছানায় যাওয়া পর্যন্ত রুটিন করে ফেলুন। একেক দিন একেক রকম বৈচিত্র্য নিয়ে রুটিন করবেন। দেওয়ালে বড় বড় করে লিখে রাখুন। কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত তার কি কাজ এটা অনেকটা ক্যাডেট কলেজের ছাত্রদের রেজিমেন্টেড রুটিন এর মত। তবে সে ঐ রুটিনে অনিহা প্রকাশ করলে রুটিনে কিছু পরিবর্তন আনুন। শিশুর কাপড় চোপড় সব সময় ঢিলেঢালা ও কালারফুল হতে হবে। মাঝে মাঝে শিশুকে গরম পানিতে গোসল করাবেন। তখন সমস্ত শরীরে চেপে চেপে গা হাত পরিস্কার করাবেন এ ধরনের চাপ/প্রেসারকে অনেকটা থেরাপির কাজ করবে। ঘরের মাঝখানে একটি দোলনা লাগাবেন। সম্ভব হলে ছাদে নিয়ে একটু হাটাহাটি করবেন। অথবা খুব ভোরে সামনের রাস্তায় কিছুক্ষণ হাটা হাটি বা দৌড়াদৌড়ি করবেন। আপনার শিশু যদি তার সমস্যার কারণে কোন ঔষধ খেয়ে থাকে তা অবশ্যই নিয়মমত খাওয়াতে হবে। অটিজম আক্রান্ত শিশু প্রায় কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগে। প্রয়োজনে রাত্রে ১ চামচ ইছুবগুলের ভূসি ১ গ্লাস পানিতে গুলিয়ে ঘুমানোর আগে খাইয়ে দিবেন। প্রয়োজনে কোষ্ঠ কাঠিন্যের ঔষধ ব্যবহার করবেন। খিুচনী থাকলে খিচুনীর ঔষধ সঠিকভাবে খাওয়াতে হবে। আর মানসিক অস্থিরতা থাকলে অহঃর- চংুপযড়ঃরপ ড্রাগ যেমন- জবংঢ়বৎফড়ষ স্বল্প ডোজে দিনে ও রাত্রে খাওয়ানো যেতে পারে। তবে পরামর্শ থাকবে ঔষধ খাওয়ানোর আগে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে দিলে ভালো। চর্বিযুক্ত খাবার খাবে না, আঁশযুক্ত খাবার, সবজি খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন, টিভি বা ট্যাব দেখা একদম বন্ধ করে দেবেন না। তবে কার্টুন নয় কোন Meaningful কোন প্রোগ্রাম হলে ভাল। শিশুর প্রত্যেক কথা বা কাজকে বিশ্লেষণ করবেন। বিরক্ত হলে অন্য বিষয়ে যাবেন। সব সময় তার নুন্যতম কাজকে প্রশংসা করবেন। কিছুতেই তিরস্কার করবেন না। বস্তুত এ সময়ে মা বাবাকে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব নিতে হবে। প্রয়োজনে স্কুল শিক্ষক বা গুগল থেকে পরামর্শ নিবেন।
প্রশ্ন দেখা দিতে পারে অটিজম শিশুর মান উন্নয়নে কোন ঔষধের প্রয়োজন আছে কি? বাস্তবিক পক্ষে এটা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি কোন ধরনের Co-morbidity না থাকলে বিভিন্ন ধরনের থেরাপির মাধ্যমে অটিজম শিশুর মান উন্নয়ন করা যায় কিন্তু বাংলাদেশে সে ধরনের থেরাপির সংখ্যা খুবই নগণ্য। লক্ষনীয় যে বাংলাদেশে কেবলমাত্র সাভারস্থ “সি.আর.পি” ও ঢাকা সেনানিবাসের “প্রয়াস” ছাড়া অন্য কোথাও থেকে এ ধরনের যোগ্য থেরাপিস্ট তৈরী হচ্ছে না। উদ্বেগ এর বিষয় যে, আমাদের দেশে দিনে দিনে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। অনেক সময় শিশুর পিতামাতা বুঝতে পারেন না যে শিশুটি স্বাভাবিক আচরণ করছে না বা বয়সের তুলনায় পিছিয়ে আছে। বেশিরভাগ মা-বাবা মনে করেন যে সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যাবে। আবার অনেক বয়বৃৃদ্ধরা বলে থাকেন চিন্তার কোন কারণ নেই এমনিতে ঠিক হয়ে যাবে। ঐ শিশুর বাবাও দেরীতে কথা বলেছে। এভাবেই শিশুর মূল্যবান ৩/৪ বছর পার হয়ে যায়।
কানের সমস্যার কারণে শিশু কোন কথা বলেনা বলে মা-বাবারা প্রথমে যায় ই.এন.টি বিশেষজ্ঞের কাছে। পরে উনারা শিশু রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করে। ডাক্তার সাহেবরাও চেম্বারের ব্যস্ততার কারণে মা-বাবাকে ভাল করে বুঝিয়ে দেন না। অভিভাবকরা এ ডাক্তার সেই ডাক্তার থেকে পরামর্শ নেওয়ার জন্য দিন রাত চেম্বারে চেম্বারে ঘুরতে থাকে। তত দিনে শিশুর ৬/৭ বছর পার হয়ে যায়। এ সুযোগে অনেক কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের খাবার বা ভিটামিনে সুস্থ্য হয়ে যাবে বলে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজেদের ব্যবসায়িক পায়দা লুটে নেই। এতে করে বাবা-মায়েদের লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হয় কিন্তু দৃশ্যমান কোন উন্নতি হয়না। এদিকে শিশুর অটিজম বা অতি অস্থির বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতা সনাক্ত হওয়ার পর কোথায় যাবে সেটার কোন দিক নির্দেশনা পায় না। মনে করে ঔষধে ভালো হয়ে যাবে। এ ধরনের সমস্যা নিয়ে অনেক অভিভাবক তাঁর শিশুকে নিয়ে আমার চেম্বারে আসলে আমি তাদেরকে থেরাপী নেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম মা-শিশু ও জেনারেল হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্রে পাঠায়। কিন্তু তারা তা না করে ঢাকা বা চট্টগ্রামের বড় বড় কর্পোরেট হাসপাতালে যায়। ওখানে দামী দামী সিটি স্ক্যান ও এম.আর.আই করে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।
বাংলাদেশে অল্প সংখ্যক প্রতিষ্ঠানে Multi Disciplinary Team এর মাধ্যমে এ ধরনের শিশুদের চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে। বর্তমানে ঢাকার কয়েকটি হাসপাতালে এই ধরনের টীম কাজ করে যাচ্ছে। চট্টগ্রামে আমি গত ২০ বছর ধরে নিরলস পরিশ্রম করে চট্টগ্রাম মা-শিশু ও জেনারেল হাসপাতালে একটি “অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র” প্রতিষ্ঠা করেছি। বর্তমানে এ কেন্দ্রে প্রতিদিন বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা ছাড়াও ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষীপুর ও কুমিল্লা থেকে অনেক রোগী আসে। পরিশেষে বলতে চাই, বিগত ২০ বৎসরের অধিক সময় ধরে এই নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডারস শিশুদের নিয়ে কাজ করছি। করোনাকালীন পরিস্থিতিতে তারা ভালো ছিল না। কেওবা ঔষধ পায়নি, কেউবা থেরাপীর জন্য সেন্টারে আসতে পারেনা, কেউবা এই মহামারিতে অর্থের অভাবে দিশেহারা হয়ে উঠেছেন। তবে করোনাউত্তর পরিস্থিতিতে তাদের অবস্থার উন্নতি হবে, এই আশা করছি।
লেখক : পরিচালক, অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র,
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল।