অজানা লাশের পরিচয় ও হত্যার রহস্য উদঘাটন যেভাবে

পিবিআইয়ের তদন্ত

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৮:৩৫ পূর্বাহ্ণ

পারিবারিক নানা টানাপোড়েনে কাতর বিদেশ ফেরত শাহজাহান আলম বালু ২০২০ সাল থেকে মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়াতেন। সে বছর ২ অক্টোবর রাতে পটিয়ার আমির ভান্ডার দরবার থেকে বের হবার পর গ্রামের কয়েকজন তাকে আটকে টাকা দাবি করেন; না পেয়ে মারধর করতে থাকেন। তাদের দুয়েকজন মারার কারণ জানতে চাইলে তারা বলে যে, ‘লোকটা পেটের ভেতরে করে ইয়াবা নিয়ে যাচ্ছে’।
কেউ জানতে পারলো না ছেলেগুলো শুধুমাত্র বিকৃত মানসিকতা থেকে শুধুমাত্র ‘মজা’ নেওয়ার জন্য বালুকে মারছে। নির্যাতন বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে ইয়াবা বের করার জন্য তাকে খাওয়ানো হয় ট্যাবলেট-সিরাপ। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় নিস্তেজ হয়ে পড়েন শাহজাহান। শেষবারের মতো ‘পানি পানি’ বলে চিৎকার করতে থাকে। পটিয়া উপজেলার দক্ষিণ ভূর্ষি ইউনিয়নের খানমোহনা গ্রামের মহিষপাড়া এলাকায় চানখালী খালে ততক্ষণে নিস্তেজ হয়ে পড়া বালুকে নিয়ে গিয়ে লাথি মেরে পানিতে ফেলে ফিরে যায় তারা উল্লাস করতে করতে। নিহত মো. শাহজাহান আলম বালু (৩৮) বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের খিতাপচর গ্রামের নূর হোসেন মেম্বারের ছেলে। বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজির পর নিহত শাহজাহানের ভাই জাহাঙ্গীর আলম বাদি হয়ে ৭ অক্টোবর পটিয়া থানায় অপহরণের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন।
এদিকে খালে ভাসতে ভাসতে বালুর লাশ চলে যায় পটিয়া থেকে বোয়ালখালীর খিতাপচরে রায়খালী খালে। ৫ অক্টোবর পুলিশ সেই খালের প্রসন্ন মাঝির ব্রিজের নিচ থেকে লাশ উদ্ধার করলেও মুখমন্ডল বিকৃত থাকায় লাশটির পরিচয় ছিল পুলিশের কাছে অজানা। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তার পরিচয় শনাক্তের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করে এবং গ্রেপ্তার করে দুই অপরাধীকে। গ্রেপ্তার দু’জন হলো, খানমোহনা মহিষপাড়া এলাকার মেহেদি হাসান হিরু (২৭) ও সাইফুল ইসলাম (৪০)।
গতকাল রোববার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকালে দুই আসামিকে নিয়ে যাওয়া হয় ঘটনাস্থল সেই খালের পাড়ে, যেখানে শাহজাহানকে নির্যাতন করে লাশ ফেলে দেয়া হয়। সেখান থেকে ‘খুনিদের’ ব্যবহৃত ছোরা, শাহজাহানকে খাওয়ানো সিরাপের বোতল, ওষুধের খালি পাতা উদ্ধার করে পিবিআই। এরপর বোয়ালখালীতে যেখানে তার লাশ পাওয়া যায় সেখানেও যায় পিবিআই টিম।
মামলার এজাহারে জাহাঙ্গীর অভিযোগ করেন, আট বছর ওমানে থেকে শাহজাহান ২০১৭ সালে দেশে ফিরে আসেন। ওমান থেকে তিনি টাকা পাঠাতেন ভাবি রহিমা বেগমের অ্যাকাউন্টে। রহিমা তার পাঠানো ১৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। এ নিয়ে রহিমা ও তার ভাই আরাফাত মিজান সোহেলের সঙ্গে শাহজাহানের বিরোধ সৃষ্টি হয়। এছাড়া শাহজাহানের আরেক ভাবী ছবি আক্তারের সঙ্গে স্থানীয় জাকির নামে এক ব্যক্তির মেলামেশা নিয়ে তার আপত্তি ছিল। এ নিয়েও ছবির সঙ্গে মনোমালিন্য হয়। এই চারজনের সঙ্গে বিরোধের জেরে শাহজাহানকে অপহরণ করা হতে পারে বলে সন্দেহ ছিল জাহাঙ্গীরের। পটিয়া থানা পুলিশ রহিমা, ছবি এবং জাকিরকে গ্রেপ্তার করেছিল।
২০২১ সালে বোয়ালখালী থানায় দায়ের হওয়া অজ্ঞাত ব্যক্তি খুনের মামলার তদন্তভার ২০২১ সালের এপ্রিলে দেয়া হয় পিবিআইকে। তদন্ত শুরুর তিন মাসের মধ্যে লাশের পরিচয় নিশ্চিত করে পিবিআই। এরপর পটিয়া থানায় গ্রেপ্তারকৃত তিনজনকে পিবিআই কার্যালয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ না পেয়ে, কিছুটা হতোদ্যম পিবিআই কর্মকর্তারা। এর মধ্যে শাহজাহানের এক ভগ্নিপতি জানান, অপহরণের দিন অর্থাৎ ২ অক্টোবর রাত ৩টা ২১ মিনিটে তার মোবাইলে শাহজাহানের মোবাইল থেকে একটি কল এসেছিল। এসময় শাহজাহান আহাজারি করতে করতে বলেন, ‘দুই লাখ টাকা তাড়াতাড়ি পাঠান, না হলে আমার হাত কেটে ফেলছে।’ কিন্তু ঠিকানা না দিয়ে মোবাইল বন্ধ করে দেয়ায় শাহজাহানের ভগ্নিপতি আর যোগাযোগ করতে পারেননি। সেই ফোন কলের সূত্র পেয়ে আশাবাদী হয়ে উঠে আবার পিবিআই। পিবিআই পরিদর্শক (প্রশাসন) কাজী এনায়েত কবীর বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি এবং সনাতন উভয় পদ্ধতিতে তদন্ত করি। ফোনকলের স্পট চিহ্নিত করে ছদ্মবেশে অবস্থান নিই। এলাকার বিভিন্ন চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিই। বিভিন্নজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। এক পর্যায়ে খানমোহনার সংঘবদ্ধ চক্রের কথা জানতে পারি। এদের মধ্যে হিরু ও সাইফুলকে ফাঁদ পেতে নগরীর পাহাড়তলীতে এনে শনিবার ভোরে গ্রেপ্তার করি। আদালতের মাধ্যমে তাদের তিনদিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করি। তারা হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে এর সঙ্গে জড়িত সবার তথ্য দেন।
জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিষয়ে তিনি বলেন, গ্রেপ্তার দুইজনসহ কিলিং মিশনে ছিল মোট ১০ জন। এদের অধিকাংশই ২০-২২ বছরের তরুণ। তারা এলাকায় মাদক সেবন করে, সংঘবদ্ধভাবে চলাফেরা করে এবং ছিনতাই-চাঁদাবাজি করে। এদের মূল নেতা সাদ্দাম হোসেন নামে একজন। সাদ্দামের দুজন মূল সহযোগী হচ্ছে মহিউদ্দিন এবং সুজন। তাদের নির্দেশে শাহজাহানকে তুলে নিয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।
ঘটনাস্থলে গিয়ে পিবিআই কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারকৃত হিরু ও সাইফুল জানায়, মারধরের কারণে দুর্বল হয়ে শাহজাহান বারবার ‘পানি পানি’ বলে চিৎকার করছিলেন। ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় নিস্তেজ হওয়ার সময়ও বারবার পানি খেতে চাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু গভীর রাতে চানখালী খালের পাড়ে পানির কোনো ব্যবস্থা তারা করতে পারেনি। পানি খাওয়ানোর জন্য তাকে খালে নামানো হয়। কিন্তু তিনি পানি পানের মতো অবস্থায় ছিলেন না। এসময় শাহজাহানকে পেছন থেকে লাথি মেরে খালে ফেলে তারা ফিরে যায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচকরিয়ায় লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স পুকুরে আহত ৪
পরবর্তী নিবন্ধজয় বাংলা হবে জাতীয় স্লোগান