‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়রি’ –আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা ও আলতাফ মাহমুদের সুর করা অমর একুশের প্রভাতফেরির গান। এই গানটি প্রথম সুর করেছিলেন আবদুল লতিফ। তাঁর নাম অনেকটা অনুচ্চারিত। যেরকম অনুচ্চারিত ভাষাশহীদ অহিউল্লাহ, আবদুল আওয়াল ও সিরাজুদ্দিনের নাম।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার গোপন বৈঠক হয় আগের দিন রাতে। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ১১ জন ছাত্রনেতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের গোপন সিদ্ধান্ত নেন। তারা পুকুরপাড়ে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন। এরা হলেন আব্দুল মোমিন, আনোয়ার হোসেন, আনোয়ারুল হক খান, গাজীউল হক, হাবিবুর রহমান শেলী, এম আর আখতার মুকুল, মুহাম্মদ সুলতান, মঞ্জুর হোসাইন, এস এ বারী এটি ও কামরুদ্দীন হোসেন শহুদ।
বলছি সিরাজুদ্দিনের কথা। সেদিন সিরাজুদ্দিন নবাবপুরে ‘নিশাত’ সিনেমা হলের বিপরীত দিকে মিছিলে থাকা অবস্থায় টহলরত ইপিআর জওয়ানের গুলিতে মারা যান। সেরাজুদ্দিন ওরফে নান্না মিয়া ছিলেন সিরাজুদ্দিনের মৃত্যুদৃশ্য প্রত্যক্ষকারী একমাত্র সাক্ষী। তার সাক্ষ্যে জানা যায়, সিরাজুদ্দিন থাকতেন তাঁতিবাজারের বাসাবাড়ি লেনে। ভাষাসৈনিক ও গবেষক আহমদ রফিক তার ‘ভাষা আন্দোলন ইতিহাস ও উত্তর প্রভাব’ শীর্ষক গ্রন্থে (পৃ : ১৯৭) লিখেছেন, ‘কলতাবাজার মহল্লার অধিবাসী সেরাজুদ্দিন ওরফে নান্না মিয়া একাধিক মৃত্যুর ঘটনা উল্লেখ করেছেন তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে। তিনি ১৯৭২ সালে (তিনি তখন স্টেডিয়ামে দোকান–ব্যবসা চালান) এক সাক্ষাৎকারে লেখককে জানান, তিনি বাবুবাজার থেকেই চলমান মিছিলে অংশ নিয়ে সদরঘাটে রাস্তার মোড়ে পৌঁছান। সেখান থেকে ভিক্টোরিয়া বাহাদুর শাহ পার্ক হয়ে রথখোলায় পৌঁছাতেই দেখেন চকচকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সেনাবাহিনীর কয়েকজন জওয়ান ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে। তা সত্ত্বেও মিছিল স্লোগানে রাজপথ মুখরিত করে এগিয়ে চলে। সেরাজুদ্দিন মিছিলে চলতে চলতে দেখতে পান উল্টো দিক থেকে সৈন্য বোঝাই একটি ট্রাক ‘চৌধুরী সাইকেল মার্ট, বরাবর এসে থেমে যায়। এদিকে ‘মানসী’ সিনেমা হলের গলি থেকে পুলিশ ও জওয়ানদের একটি অংশ গলির মুখে এসে দাঁড়ায়। তখনি ট্রাক থেকে গুলি ছুটে আসে মিছিল লক্ষ্য করে। তার কিছু দূরে একজন তরুণ গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান। শার্ট–প্যান্ট পরা ঐ তরুণের কোমরের ওপর গুলি লাগে। রক্তে কাপড় ভিজে যায়। ঐ মিছিলের কয়েকজন তাকে ধরাধরি করে ‘মানসী’র গলিপথে নিয়ে বলে যায় তরুণেরও নাম সিরাজুুদ্দিন, ঠিকানা বাসাবাড়ি লেন, তাঁতিবাজার।’
উপেক্ষিত এই ভাষা শহীদ প্রসঙ্গে ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘরের নির্বাহী পরিচালক এম আর মাহবুব বলেন, ভাষা শহীদরা আমাদের অহংকার। কিন্তু আজও সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিক এই পাঁচ জনের বাইরে কোনো ভাষা সৈনিকের নাম আমরা জানি না। আজও বলতে হয় নাম না জানা ভাষা শহীদ। এটি দুঃখজনক। অথচ দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি যে ২২ তারিখ শহীদ হয়েছিলেন রিকশা চালক আবদুল আওয়াল। তার রিকশার লাইসেন্স নাম্বারসহ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। খুশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে মাথায় গুলিলেগে শহীদ হয়েছিলেন অহিউল্লাহ। নিশাত সিনেমা হলের সামনে সিরাজুদ্দিন নামে আরেকজন শহীদ হয়েছেন। তৎকালীন পত্রপত্রিকায় এবং বিভিন্ন গবেষণার তথ্য থেকে বেরিয়ে এসেছে এই তিনজন সেদিন শহীদ হয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, যে এই তিনজন ভাষাসৈনিককে নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি।
‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ –পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জোর করে উর্দুকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বাংলা আমাদের ভাষা, মায়ের ভাষা। সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণের কারণে বাংলাকে তারা কেড়ে নিতে পারেনি।