দেশের আগামী একশ’ বছরের বন্দর হিসেবে গড়ে উঠতে যাওয়া চট্টগ্রাম বে টার্মিনালের প্রয়োজনীয় ভূমির সংস্থান হতে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে নানা জটিলতায় ঝুলে থাকা এই ভূমির সংস্থান এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় সুপারিশ যাওয়ার পরই প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন জুটবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। একইসাথে বনবিভাগের নামে গেজেট হওয়া ২৬৭ একর ভূমির গেজেট বাতিলের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ভূমির দখল পাওয়ার পরই বে টার্মিনালের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে সূত্র বলেছে, ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত প্রকল্পটির আনুষাঙ্গিক নানা প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, নগরীর হালিশহর সমুদ্র উপকূলে জেগে উঠা একটি চরকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট একটি প্রাকৃতিক চ্যানেলের পাড়ে কয়েক হাজার একর ভূমি রয়েছে। এর মধ্যে ৮৫৭ একর ভূমি ব্যবহার করে বে টার্মিনাল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত মেগা প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের তোড়জোড় করা হলেও নানা প্রতিকূলতার মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এর মধ্যে ভূমির সংস্থান একটি অন্যতম সমস্যা হয়ে প্রকল্পটিকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করে। ছয় কিলোমিটারেরও বেশি লম্বা ভূমির উপর বে টার্মিনাল গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার শুরুতে ৬৮ একর ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমি সরকার হুকুমদখল করে বন্দর কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করে। ইতোমধ্যে এই ভূমি উন্নয়নের নানা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
৮৫৭ একর ভূমির মধ্যে মাত্র ৬৮ একরের সংস্থান হলেও বাকি ৭৮৯ একর ভূমি নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা প্রকল্পটির অন্যতম প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠে। বন্দর কর্তৃপক্ষ এই ভূমি বে টার্মিনালের জন্য বরাদ্দের আবেদন করার পর ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে বিস্তারিত রিপোর্ট প্রদানের জন্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে দায়িত্ব প্রদান করে। জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে উক্ত ভূমির ব্যাপারে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। যাতে বলা হয় যে, উক্ত ভূমির মধ্যে ২২ একর ভূমি নিয়ে মামলা মোকদ্দমা রয়েছে। এগুলোর মালিকানা বিভিন্নজন দাবি করছেন। এছাড়া ২৬৭ একর ভূমি বনবিভাগের বনায়নের জন্য গেজেট করা রয়েছে। এর বাইরে সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত ৫০০ একর ভূমি রয়েছে। যেগুলো নিয়ে কোন বিরোধ নেই। উক্ত ৫০০ একর ভূমি ইজারার জন্য ১২৪১ কোটি টাকা মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
এই রিপোর্ট পাওয়ার পর ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ মামলা মোকদ্দমার ব্যাপারটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য জেলা প্রশাসককে উদ্যোগ নেয়ার তাগাদা দেন। তিনি বনবিভাগের নামে গেজেটভুক্ত ২৬৭ একর ভূমিতে যেহেতু কোন বনায়ন হয়নি তাই সেগুলোকে নতুন করে গেজেট করার ব্যবস্থা নেয়ার জন্যও জেলা প্রশাসককে তাগাদা দেন।
অপরদিকে ৫শ’ একর নিষ্কন্টক ভূমির মূল্য ১২৪১ কোটি টাকার স্থলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কত টাকা প্রদান করতে পারবে তাও মন্ত্রী জানতে চান। বন্দর কর্তৃপক্ষ ভূমির মূল্য বাবদ কোন টাকা প্রদান করতে পারবে না জানিয়ে বলা হয় যে, বে টার্মিনাল সরকারি প্রতিষ্ঠান। জায়গা কিনে টার্মিনাল করার মতো অবস্থা বন্দরের নেই। এই জমি বন্দর কর্তৃপক্ষ কখনো বিক্রি করতে পারবে না। জমির মূল্য বাবদ অপারেটরের কাছ থেকে কোনো টাকাও নেয়া যাবে না। ‘সাঙ্ককেন কস্ট’ হিসেবে এই ভূমি ব্যবহৃত হবে। তাই ভূমির কোনো মূল্য না নিয়ে প্রতিকী মূল্য যথা ১০১ টাকা, ১০০১ টাকা বা ১ লক্ষ ১ টাকায় উক্ত ভূমি বে টার্মিনালের বিপরীতে বরাদ্দ দেয়ার আবেদন করে। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় থেকে সুপারিশ পাঠানো হবে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। প্রধানমন্ত্রী উক্ত ভূমির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাসহ অনুমোদন প্রদান করবেন। বিষয়টি একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, অচিরেই এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে বে টার্মিনালের প্রয়োজনীয় ভূমির সংস্থান হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, বে টার্মিনালের ভূমি নিয়ে আর কোনো সংকট নেই। এটি এখন প্রায় চূড়ান্ত হয়ে রয়েছে। আগামী কিছুদিনের মধ্যে এই ভূমির সংস্থান হয়ে যাবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম চলে সাড়ে চারশ’ একর ভূমিতে। বে টার্মিনালের প্রয়োজনীয় ভূমির সংস্থান হওয়ার পর এটি ক্রমান্বয়ে আরো সম্প্রসারিত হবে। বিদ্যমান চট্টগ্রাম বন্দরের অন্তত ৫ গুন বেশি জায়গায় পরিচালিত হবে বে টার্মিনালের কার্যক্রম। চট্টগ্রাম বন্দরে সর্বোচ্চ সাড়ে নয় মিটারে ড্রাফটের জাহাজ বার্থিং নিতে পারে। বে টার্মিনালে ১৪ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে। বে টার্মিনালে মোট তিনটি টার্মিনাল থাকবে। প্রতিটি টার্মিনালে ৩০০ মিটার লম্বা ছয়টি জেটি থাকবে। অর্থাৎ একটি টার্মিনালে ১৮শ’ মিটার লম্বা জেটি এবং পশ্চাদসুবিধা গড়ে তোলা হবে। প্রতিটি টার্মিনালে একই সাথে ছয়টি জাহাজ বার্থিং দেয়া যাবে। তিনটি টার্মিনালের দুইটি বিদেশি অপারেটর দিয়ে পরিচালনা করানোর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।