নগরীর আকবর শাহ ১ নম্বর ঝিল এলাকায় পুলিশের ওপর হামলা চালানো আলোচিত সন্ত্রাসী মো. নুর আলম প্রকাশ নুরু (৪০) অবশেষে পুলিশের জালে ধরা পড়েছে। গত ৮ জানুয়ারি নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জ থানার শান্তিরহাট এলাকা থেকে আকবর শাহ থানা ও ডিবি (পশ্চিম) পুলিশের একটি যৌথ টিম নুরুকে গ্রেপ্তার করে। এসময় কাউছার (৩০) নামে তার এক সহযোগীকেও গ্রেপ্তার করা হয়। নুরুকে গ্রেপ্তারের পর তাঁকে নিয়ে ফের ওই ঝিল এলাকায় অভিযান চালায় পুলিশ। এসময় তার দেয়া তথ্যে সেখান থেকে একটি ওয়ান শুটার গান, রিভলবার, রাম দা উদ্ধার করা হয়।
অবশেষে ধরা পড়লো নুরু : ২০১৪ সালের ৬ জুলাই শেষবার নুরুর আস্তানায় পুলিশ হানা দিলে তার অনুসারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে। এক পর্যায়ে পুলিশ নুরুকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে। পুলিশের ওপর হামলা ও অস্ত্র উদ্ধার ঘটনায় দুটি মামলা হয়। এসব মামলায় ১৮ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ১২০ জনকে আসামি করা হয়। জামিনে এসে নুরু হয়ে উঠে অঘোষিত সম্রাট। এরপর থেকে গত ছয় বছরের অন্তত চার বার অভিযান চালায় পুলিশ নুরুর আস্তানায়। ২০১৮ সালে নুরু বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে পুলিশের অভিযান সফল হয়নি। এর জের ধরে তৎকালীন আকবর শাহ থানার ওসি সহ থানার ৬ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়। নুরুর বোন রুবি বাদী হয়ে এ মামলা করেন। ২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর নুরুকে গ্রেপ্তারে ১ নম্বর ঝিলে অভিযান চালায় আকবর শাহ থানা ও নগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তার করে আজম নামে নুরুর এক সহযোগীকে। এরপর ৩১ ডিসেম্বর নুরুর ১২ সহযোগী গ্রেপ্তার হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। ৪ জানুয়ারি গ্রেপ্তার হয় নুরুর ঘনিষ্ট সহযোগী নুরুল আলম। দীর্ঘ ছয় বছরে পাঁচবার অভিযান চালানোর পর অবশেষে গত ৮ জানুয়ারি নুরু গ্রেপ্তার হয়।
কে এই নুরু : আকবর শাহ থানার পূর্ব ফিরোজ শাহ কলোনির পাহাড়ি এলাকা স্থানীয়দের কাছে ঘোনা নামে পরিচিত। আর জলাধারগুলোর নাম ঝিল। এগুলোকে বলা হয়- এক, দুই, তিন নম্বর ঝিল । এক সময় ছিন্নমূল মানুষ এসব খাস জায়গায় বসতি স্থাপন করলেও এখন বিভিন্ন পেশার লোকজনের বসবাস। কুমিল্লার ধনু মিয়া এখানে ঝিলের মাছ বিক্রির পাশাপাশি অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তার মৃত্যুর পর দুই ছেলের মধ্যে নুরে আলম নুরু, জানে আলম, মেয়ে রুবি ও মেয়ের জামাই আলমগীর ১ নং ঝিল এলাকায় বসত গড়ার পর এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এরপর থেকে নুরু মাদক, অস্ত্র কারবার, চুরি, ডাকাতি, লুটপাট, পাহাড় কাটাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে।
দিনমজুর থেকে কোটিপতি : ২০১০ সালেও দিনমজুর নুরুর মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না। আশ্রয় নেয় ১ নম্বর ঝিলের পাহাড়ে। ২০১২ সালে নুরু আকবর শাহ এলাকায় পাহাড় দখল ও বিক্রি শুরু করে। পাহাড় দখলের জন্য ভুয়া কবর তৈরি করে সাইনবোর্ড দেয় নুরু। পরে ঘর বানিয়ে বিক্রি করে। নাছিয়া ঘোনায় পাহাড় কেটে বসতি গড়েছে নুরু, যা নুরু কলোনি নামে পরিচিত। ইসা ভবন নামে একটি গেট করে করা হয় মাদ্রাসা ও এতিমখানা। প্রভাবশালীরা তাকে ব্যবহার করে । এতে নুরুর অপরাধের বিস্তৃতি ঘটে।
পাহাড়ে নুরুর রাম-রাজত্ব : নুরুর ডেরায় পৌঁছার আগে অস্ত্র ও মাদক সরিয়ে নিতে নিয়োগ দেয়া হয় বিশাল সদস্যের বাহিনী। তার ইয়াবা ব্যবসাসহ নানা অপকর্মে রয়েছে বেতনভুক্ত লোক। আকবরশাহ এলাকার ইয়াবারহাট নুরুর নিয়ন্ত্রণাধীন নাছিয়া ঘোনা, বেলতলি ঘোনা ও ঝিলপাড় ।
এ এলাকায় সন্দেহভাজন কাউকে দেখলে জানিয়ে দেয় তার ডেরায়। তার আস্তানায় সারাদিনই বসত জুয়ার আসর। একটি কক্ষে চলত মাদক বেচাকেনা ও সেবন। রয়েছে কবুতর, ছাগল ও গরুর খামার। নাম ইছা এগ্রো ফার্ম। রয়েছে ফার্নিচার কারখানা। এভাবে ৭ বছরে কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে যায় নুরু।
মুখ খুলছে এলাকাবাসী : ঝিলের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম জানান, কয়েক কিলোমিটার এলাকায় নুরুর আধিপত্য রয়েছে। তার আস্তানার তিনপাশেই পাহাড়। আস্তানায়র পথে একাধিক লোহার গেট ও বেতনভুক্ত লোকজন পাহারায় থাকে। যারা মাদক কেনা, সেবন ও জুয়ার আসরে যায় তারাই যেতে পারে।
নুরুর বিরুদ্ধে মামলার পাহাড় : নুরুর বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৩০ টি মামলার সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। মাদক আইনে ১৮টি মামলা রয়েছে। মামলাগুলো হয়েছে ২০১৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত। শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায়ও নাম আছে নুরুর। পাহাড় কাটার অপরাধে নুরুর বিরুদ্ধে মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। আকবর শাহ থানার ওসি মো. জহির হোসেন বলেন, নুরু পাহাড় কাটা, খাসজমি দখল, অস্ত্র ও মাদক মামলার আসামি।
সাজা সম্পর্কে জানতো না পুলিশ : নুরুর বিরুদ্ধে একটি মামলায় ১৭ বছরের সাজা দেন আদালত। এ বিষয়ে দেড় বছর কিছু জানতো না পুলিশ। এ প্রসঙ্গে সিএমপির ডিসি (পশ্চিম) ফারুক উল হক বলেন, অস্ত্র মামলায় জামিন নিয়ে পলাতক ছিল নুরু। পরে তার অনুপস্থিতিতে সাজা হয়। গতকাল ৯ জানুয়ারি আগ্রাবাদ সিডিএ এলাকায় ডিসি (পশ্চিম) কার্যালয়ে ব্রিফিংয়ে তিনি এসব তথ্য জানান। উপস্থিত ছিলেন গোয়েন্দা পশ্চিম বিভাগের ডিসি মনজুর মোরশেদ, অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (পশ্চিম) এএএম হুমায়ুন কবির সহ পুলিশ কর্মকর্তাবৃন্দ।