দ্রুততম সময়ের মধ্যে করোনার ভ্যাকসিন পেতে করণীয় সব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়ে আসছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও একই কথা বলা হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী- অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন পেতে ভারতের সাথে চুক্তি করা হয়েছে। প্রথম দফায় ৫০ লাখ ভ্যাকসিন আসবে বাংলাদেশে। জনপ্রতি ২ ডোজ করে ২৫ লাখ মানুষকে এই ভ্যাকসিন দেয়া যাবে। কিন্তু ১৬ কোটির বেশি জনসংখ্যার দেশে প্রথম দফায় এই ভ্যাকসিন কারা পাবে, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হচ্ছে সরকারকে। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন- প্রথম দফাতেই সব বাসিন্দাকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা সম্ভব নয়। যার কারণে অগ্রাধিকার ভিত্তিক তালিকা করতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের মাধ্যমে প্রাথমিক ভাবে একটি তালিকা প্রণয়নের কাজ এরইমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। তবে প্রাথমিক ভাবে একটি তালিকা করা হলেও নতুন করে অগ্রাধিকার তালিকা প্রণয়ন এবং টিকাদান কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনা ও গুজব প্রতিরোধকল্পে জাতীয় কমিটির পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে একটি করে কমিটি গঠন করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। ১৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক (৩) মুহম্মদ শাহীন ইমরান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ সংক্রান্ত কমিটি গঠনের তথ্য জানানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিবকে সভাপতি করে জাতীয় কমিটি, মেয়রের নেতৃত্বে সিটি কর্পোরেশন এলাকার কমিটি এবং জেলাপ্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে যথাক্রমে জেলা ও উপজেলা কমিটি গঠন করা হয়েছে। জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব, সিটি কর্পোরেশন এলাকার কমিটির ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, জেলা পর্যায়ের কমিটিতে সিভিল সার্জন এবং উপজেলা কমিটিতে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এ কমিটির ৫টি কার্যপরিধির মধ্যে প্রথমেই কোভিড-১৯ মোকাবেলায় নিয়োজিত স্বাস্থ্য কর্মীগণ, সম্মুখ সারির কর্মীগণ, রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠী, বয়োজ্যেষ্ঠ জনগোষ্ঠী, দীর্ঘমেয়াদী রোগে আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর অগ্রাধিকার তালিকা প্রণয়নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কার্যপরিধি অনুযায়ী- এ সংক্রান্ত কমিটির নতুন করে অগ্রাধিকার তালিকা প্রণয়নের কথা। কিন্তু নির্দেশনায় কিছু অস্পষ্টতার কারণে সে পথে হাঁটতে পারছে না কমিটি।
অন্যদিকে, এ সংক্রান্ত কমিটির কার্যপরিধিতে অগ্রাধিকার তালিকা প্রণয়নের বিষয়টি উল্লেখ থাকায় আগে তৈরিকৃত তালিকা কাটছাঁট হতে পারে বলে আগেই জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। এতে ভ্যাকসিন কারা আগে পাবেন, সে অগ্রাধিকার তালিকা নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় কর্তৃক গঠন করা কমিটির কার্যপরিধিতে অগ্রাধিকার তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় নিয়োজিত স্বাস্থ্য কর্মীগণ, সম্মুখ সারির কর্মীগণ, রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠী, বয়োজ্যেষ্ঠ জনগোষ্ঠী, দীর্ঘমেয়াদী রোগে আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর অগ্রাধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য কর্মীর বিষয়টি বাদ দিলে সম্মুখ সারির কর্মী হিসেবে কারা বিবেচনায় আসবেন, সে বিষয়ে স্পষ্ট নন কমিটির সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন- সম্মুখ সারির কর্মী বলতে কারা বা কোন কোন বিভাগের কর্মীদের বিবেচনায় আনা হবে, তা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। প্রশাসন, আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনী, সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনী, গণমাধ্যম, শিক্ষা বিভাগ ছাড়াও সরকারের বিভিন্ন দফতর ও বিভাগ রয়েছে। এর মধ্যে সম্মুখ সারির কর্মী হিসেবে কারা বিবেচনায় আসবেন, তা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।
পাশাপাশি বয়োজ্যেষ্ঠ বিবেচনার ক্ষেত্রেও কত বছর বয়সীদের বিবেচনায় আনা হবে, তা নিয়েও অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। এছাড়া রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠী এবং দীর্ঘমেয়াদী রোগে আক্রান্ত প্রাপ্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। সব মিলিয়ে এই অগ্রাধিকার তালিকা প্রণয়নের পথে এগোতে পারছে না এ সংক্রান্ত কমিটি।
এ বিষয়ে সিটি কর্পোরেশন এলাকার কমিটির সদস্য সচিব ও চসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আজাদীকে বলেন- কমিটির কার্যপরিধির মধ্যে অগ্রাধিকার তালিকা প্রণয়নের কথা উল্লেখ করা থাকলেও এক্ষেত্রে আরো ষ্পষ্টতার প্রয়োজন আছে। এ বিষয়ে আমরা জাতীয় কমিটি বা মন্ত্রণালয়ের পরবর্তী নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি। তালিকা প্রস্তুতের বিষয়ে মানসিক ও সার্বিক ভাবে প্রস্তুত রয়েছেন জানিয়ে ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী বলেন- নির্দেশনা পেলে সে অনুযায়ী আমরা কাজ করবো।
গত ৩ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকার কমিটি প্রথম বৈঠকে বসলেও সেখানে অগ্রাধিকার তালিকা নিয়ে বেশি দূর এগোনো যায়নি। চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কেবল ভ্যাকসিন আসলে তা সংরক্ষণ ও তদারকিতে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়।
এদিকে, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে প্রাথমিক ভাবে চট্টগ্রামেও অগ্রাধিকার ভিত্তিক একটি তালিকা তৈরি করে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়। করোনা মোকাবেলায় সম্মুখযোদ্ধাদের সামনে রেখে ৫টি সেক্টরের (বিভাগের) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাখা হয় ওই তালিকায়। ৫ সেক্টরের (খাতের) মোট ২ লাখ ৭১ হাজার ৭৮৮ জনের তালিকা তৈরি করে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। জনপ্রতি ২টি ডোজ হিসেব করে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ ভ্যাকসিনের চাহিদা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা জানান সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি। ৫ সেক্টরের মধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, গণমাধ্যম, শিক্ষা বিভাগ এবং সামরিক-আধাসামরিক ও আইনৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওই অগ্রাধিকার তালিকায় রাখা হয়। তবে নতুন করে কমিটি গঠনের প্রেক্ষিতে প্রাথমিক ভাবে তৈরি করা আগের তালিকায় কাটছাঁট হতে পারে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। এ প্রসঙ্গে জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি আজাদীকে বলেন, এখন যেহেতু কমিটি করা হয়েছে এবং কমিটিকে নতুন করে অগ্রাধিকার তালিকা প্রণয়নের জন্য বলা হয়েছে; সে হিসেবে আগের তালিকায় পরিবর্তন আসতে পারে বলে আমরা ধারণা করছি। জেলাপ্রশাসকের নেতৃত্বে জেলা পর্যায়ের কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন সিভিল সার্জন। যদিও জেলা পর্যায়ের কমিটির এখনো বৈঠক হয়নি। চট্টগ্রামে নতুন জেলাপ্রশাসক যোগদানের পর এ সংক্রান্ত কমিটির বৈঠক আহ্বানের কথা জানিয়েছিলেন সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি।
অন্যদিকে, অগ্রাধিকার তালিকা প্রণয়ন ছাড়াও তালিকা প্রণয়নে উপজেলা কমিটিকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা প্রদান, করোনা ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ করা, ভ্যাকসিন প্রদানকালীন সময়ে ভ্যাকসিন প্রদান কেন্দ্রসমূহে আইনশৃক্সখলা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ এবং ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের নিমিত্ত অন্যান্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের কথা বলা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় কর্তৃক গঠন করা কমিটির কার্যপরিধিতে।