অগ্নিযুগের বিপ্লবতীর্থ: ইউরোপীয়ান ক্লাব

বিচিত্রা সেন | মঙ্গলবার , ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১:২৮ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রাম! নামটি বলার সাথে সাথে আরেকটি শব্দ অবধারিতভাবে চলে আসে এর অগ্রভাগে। শব্দটি আমাদের সবার জানা। ‘বীর চট্টগ্রাম’ বলতেই আমরা অভ্যস্ত, কেননা এ চট্টগ্রাম বরাবরই বীর প্রসবিনী। যুগে যুগে এ চট্টগ্রামে জন্ম নিয়েছেন বাংলা মায়ের অকুতোভয় বীরেরা। তাই এই চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে নানা বীরত্বের কাহিনি। তেমনি এক বীরত্বগাথার সাথে জড়িত পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব। এই ক্লাবটির নাম বলার সাথে সাথে আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে একটি দুর্ধর্ষ অভিযানের চিত্র। যে বৈপ্লবিক অভিযানের সাথে জড়িয়ে আছে বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নাম।

ইউরোপীয়ান ক্লাবটি চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত বলে অনেকে এটাকে পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব বলে। ‘৪৭ পূর্ববর্তী সময়ে যখন এদেশে ব্রিটিশদের রাজত্ব ছিল তখন এ ক্লাবটি তাদের সান্ধ্য আড্ডার বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ব্রিটিশ অফিসাররা এখানে এসে খেলাধুলা, মদ্যপান এবং আনন্দফুর্তিতে ব্যস্ত থাকতেন। ব্রিটিশরা নিজেদেরকে এতটাই উচ্চবর্গের মনে করতেন যে, এর মূল ফটকে একটা অত্যন্ত অপমানজনক উক্তি লিখে রেখেছিলেন। যে উক্তিটাই বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের মনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। উক্তিটি ছিল ‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’।

ভারতীয়দেরকে কুকুরের সাথে তুলনা করা তৎকালীন অখণ্ড ভারতের অধিবাসী চট্টগ্রামের অগ্নিযুগের বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেন কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। তিনি তাঁর দলের বিপ্লবীদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন এই ক্লাবে আক্রমণ করার। তিনি চেয়েছিলেন ব্রিটিশদের দম্ভ ভেঙে দিতে। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামে যে যুব বিদ্রোহ হয়েছিল, তাতে এই ক্লাবেও অন্যতম আক্রমণ করার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু সেদিন গুড ফ্রাইডে উপলক্ষ্যে ক্লাব বন্ধ থাকায় তা ভেস্তে যায়। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র সূর্য সেন নন। তিনি আবারও এ ক্লাবে আঘাত হানার পরিকল্পনা করেন। এবার দায়িত্ব দেওয়া হয় বিপ্লবী শৈলেশ্বর চক্রবর্তীকে। তিনি আরও ছয়জনকে নিয়ে ১৯৩২ সালের ১০ আগস্ট ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। এর পরের মাসে মাস্টারদা সূর্য সেন পুনরায় ক্লাব আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এ ক্লাবে পুনরায় আক্রমণ করা হয়। তবে এবার নেতৃত্বে পুরুষের ছদ্মবেশে একজন নারী। তিনি বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। তাঁর নেতৃত্বে ১৫ জন সহযোদ্ধা অবশ্য পুরুষ ছিল। ওইদিন রাত আনুমানিক ১০টা ৪৫ মিনিটে চট্টগ্রামের অগ্নিযুগের দুর্ধর্ষ বিপ্লবীরা নিজেদের প্রাণ বাজী রেখে ইউরোপিয়ান ক্লাবে আঘাত হানেন। এতে মিসেস সুলিভান নামক এক ইংরেজ মহিলা নিহত, এবং চারজন পুরুষ ও সাতজন মহিলা আহত হয়।

এরপর বিপ্লবীরা পাল্টা আঘাতের সম্মুখীন হন। ইংরেজরা ঝড়ের গতিতে গুলি ছুড়তে থাকে। এসময় একজন বিপ্লবী নিহত ও এগারোজন বিপ্লবী আহত হন। তিনজন বিপ্লবী অক্ষত অবস্থায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার আহত হন এবং ইংরেজদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কায় পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে নিজের প্রাণ বিসর্জন দেন।

পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ব্রিটিশরা চলে গেলে সরকার ইউরোপিয়ান ক্লাব রেলওয়ের কাছে হস্তান্তর করে। পরবর্তীতে এটি বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় প্রকৌশলীর কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু জনমানসে এ স্থানে প্রীতিলতার জন্য কিছু করার সংকল্প ছিল। জনমতের প্রতি সম্মান রেখে ২০১২ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এর উদ্যোগে এ স্থানে নির্মিত হয় ‘প্রীতিলতার আবক্ষ ভাস্কর্য’। ২০১৮ সালে ক্লাবটিকে ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তবে একটি জাদুঘরে যা কিছু সংরক্ষণ করার কথা ছিল তেমনটা হয়নি। বিভিন্ন সময়ে প্রশাসন থেকে এ ব্যাপারে আশ্বাস দিলেও মূলত এখনো কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ২০২৫ সালের ২২ আগস্ট রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফাহিমুল ইসলাম এ ক্লাব পরিদর্শনে গেলে দেখা যায়, ক্লাবটির নামফলকে আবারও ‘ইউরোপীয়ান ক্লাব’ লেখা রয়েছে।

কথায় বলে, যে জাতি তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে না, সে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমাদের ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’। এই ইতিহাস সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া একান্তই জরুরি। ব্রিটিশ আমলে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে চট্টগ্রামে চারদিন স্বাধীনতার পতাকা ওড়ানো আমাদের পূর্বপুরুষদের বীরত্বের জয়গাথা প্রকাশ করে। এরই ধারাবাহিকতায় বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের প্রেরণা পেয়েছিলেন। তিনি একটি সফল অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর আত্মদান অন্য বিপ্লবীদের আত্মদানে প্রলুব্ধ করেছিল। প্রীতিলতা এই বাংলার প্রথম ‘নারী শহীদ’। তাঁর বীরত্বগাথাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ‘ইউরোপীয়ান ক্লাব’ তথা ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার স্মৃতি জাদুঘর’কে সংরক্ষণ করতে হবে। এটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ জাদুঘর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তবেই আমরা একটি কৃতজ্ঞ ও ইতিহাস সচেতন জাতি হিসেবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মৃতিতে উজ্জ্বল চবির বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
পরবর্তী নিবন্ধসীতাকুণ্ডে কাভার্ডভ্যানের ধাক্কায় বিএনপি নেতার মৃত্যু