অগ্নিঝুঁকিতে চট্টগ্রামের হাজারো পণ্যগুদাম

অতি ঝুঁকিপূর্ণ প্রায় অর্ধশত স্পট, নেই ফায়ার সেফটি প্লান আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিসকে

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ১৪ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৮:৫৭ পূর্বাহ্ণ

আতুরার ডিপো এলাকার কয়েকটি পণ্যগুদামে ৯ ডিসেম্বর ভোররাতে আগুন লাগে। ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি অনুযায়ী, ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কয়েক কোটি টাকার গার্মেন্টস ও ঝুট পণ্য পুড়ে গেছে। ওই আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের প্রায় ১৯ ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, প্রায় পরিত্যক্ত ভবনে ব্যবহৃত ওই গুদামগুলোর কোনো ফায়ার সেফটি প্লান নেই। আবার গুদামে পণ্যগুলোও সঠিকভাবে সাজিয়ে রাখা হয় না। এতে আগুন নেভাতে যেমন বেগ পেতে হয়, তেমনি পুড়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদও।
একইভাবে ঠিক একমাস আগে গত ৯ নভেম্বর নগরীর সদরঘাট বাংলাবাজারে একটি কেমিক্যাল গুদামে আগুন লাগে। এতেও পুড়ে যায় মূল্যবান সম্পদ। ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আগুন নেভাতে গিয়ে বিপাকে পড়ে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। বিষাক্ত ধোঁয়ায় আগুনের কাছে যেতে বিশেষ ফায়ার সেফটি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হয়েছে ফায়ার ফাইটারদের। ফায়ার সার্ভিস বলছে, বাংলাবাজারে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত গুদামটি মূলত শতবর্ষী পরিত্যক্ত পুরানো ভবনকে গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছেন আমদানিখাতে জড়িত ব্যবসায়ীরা। এই গুদামেও ছিল না ফায়ার সেফটি প্লান।
সূত্রে জানা গেছে, নগরীর চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ, রাজাখালী, মাঝিরঘাট, স্ট্যান্ড রোড, বাংলাবাজার, মাদারবাড়ি, কালুরঘাট শিল্প এলাকা, হালিশহর, অলংকার, বায়েজিদ, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে দুই হাজারের অধিক গুদাম রয়েছে। তন্মধ্যে ৮ হাজার বর্গফুট থেকে ৫০ হাজার বর্গফুটের গুদাম (ওয়্যারহাউজ) রয়েছে প্রায় হাজারের অধিক। অলংকার-সাগরিকা এলাকার কিছু ওয়্যারহাউজের ফায়ার সেফটি থাকলেও বেশিরভাগ গুদামের নেই ফায়ার সেফটি ব্যবস্থাপনা।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, ফায়ার সার্ভিস ২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সময়ে চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ স্পট নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে সমগ্র চট্টগ্রামে অগ্নি দুর্ঘটনার ঝুঁকিপূর্ণ, অতিঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণীতে ভাগ করে। নগরীর প্রায় অর্ধশত স্পট রয়েছে আগুনের অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে। অতি ঝুঁকিপ্রবণ স্পটগুলোর মধ্যে সিঙ্গাংপুর সমবায় সমিতি মার্কেট, কর্ণফুলী মার্কেট, বহদ্দারহাট হক মার্কেট, স্বজন সুপার মার্কেট, বকতেয়ার মার্কেট, চাক্তাই চাল পট্টি, শুটকি পট্টি, খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জ, মিয়া খান নগর পুরাতন ঝুট মার্কেট, ওমর আলী মার্কেট, বন্দর এলাকার পোর্ট মার্কেট, বড়পুল বাজার, রিয়াজ উদ্দিন বাজার, জহুর হকার্স মার্কেট, টেরি বাজার, তামাকুমন্ডি লেনও রয়েছে।
তথ্যমতে, শুধুমাত্র রিয়াজ উদ্দিন বাজারেই ছোটবড় ১২৮টি মার্কেটে ১০ হাজারের অধিক দোকান রয়েছে। তামাকুমন্ডি লেইনে ১১০টি মার্কেটে প্রায় ১০ হাজার দোকান রয়েছে। টেরিবাজারে ছোটবড় প্রায় ৮৫টি মার্কেটে রয়েছে প্রায় দুই হাজার দোকান। এখানেও রয়েছে ছোট ছোট অনেক গুদাম। যেখানে গার্মেন্টস, মনোহারী, জুতো কিংবা তৈজষপত্রের মজুদ থাকে।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, চট্টগ্রামে পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। যে কারণে যেকোন অগ্নি দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির আশংকা বেশি থাকে। আবার শহুরে গিঞ্জি সড়ক ও অলি-গলির রাস্তা দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো প্রবেশ কষ্টকর হয়। ফলে ভবনগুলোতে ফায়ার সেফটি প্ল্যান কার্যকর না হলে যেকোনো দুর্ঘটনায় প্রাণহানির আশংকা রয়েছে ফায়ার সার্ভিসের।
ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপ-সহকারী পরিচালক ফরিদ আহমেদ মনির গতকাল রোববার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রামে অসংখ্য পণ্যগুদাম রয়েছে। বেশিরভাগ পণ্যগুদামের ফায়ার সেফটি প্লান নেই। যারা পণ্যের গোডাউন (গুদাম) বানানোর জন্য ভবন তৈরি করেন, তাদের উচিত ফায়ার সার্ভিস থেকে ‘ফায়ার সেফটি প্লান’ নেওয়া। এতে প্রস্তাবিত ভবনের কোথায় ফায়ার এস্টিংগুইসার থাকবে, কী পরিমাণ পানি সংরক্ষণ করতে হয় কিংবা ভবনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, সে সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া থাকে। থাকে ডিটেইল নঁকশাও।
তিনি বলেন, শীতকালসহ শুষ্ক মৌসুমে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেশি ঘটে। নগরীতে পানির অভাবও প্রকট। কোথাও আগুন লাগলে পানির জন্য আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়। আতুরার ডিপোর ঘটনায় অনেক দূরের একটি পুকুর থেকে পানি আনতে হয়েছে। অথচ আগুনের ঘটনায় যেমন মূল্যবান সম্পদ পুড়ে যায়, অন্যদিকে জীবনহানির ঘটনাও ঘটে। তারপরেও আগুন নিয়ে মানুষ সচেতন নয়।
চট্টগ্রাম ওয়্যার হাউজ কমিশন এজেন্ট এসোসিশেনের সভাপতি শফিক আহমদ বড়মিয়া দৈনিক আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রামের মাঝিরঘাট, স্ট্যান্ড রোড, অলংকার, পোর্ট কলোনি, বায়েজিদ, কালুরঘাট মিলে প্রায় হাজারের অধিক ওয়্যারহাউজ রয়েছে। এখানে ৫০ হাজার বর্গফুটেরও ওয়্যারহাউজ রয়েছে। শুধু বায়েজিদ এলাকাতেই দুইশয়ের অধিক বড় ওয়্যারহাউজ রয়েছে বলে দাবি এ ব্যবসায়ীর। গুদামের অগ্নিঝুঁকির বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা ভবনের মালিকের কাছ থেকে গুদাম কিংবা ওয়্যারহাউজ ভাড়া নিই। কোনো সময়ে আমদানির পণ্য বেড়ে গেলে সাময়িক সময়ের জন্য এসব গুদাম ভাড়া নিয়ে ব্যবহার করি, আবার ছেড়ে দিই। এখানে গুদামের ফায়ার সেফটি প্লান করতে হবে ভবন মালিককে, গুদাম ব্যবহারকারীদের নয়। তিনি বলেন, যেসব এলাকায় পণ্যের গুদাম রয়েছে, তার আশেপাশে আগুনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ একটি বসতঘরে আগুন লাগলেও পাশের গুদাম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা থাকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশাটলের সিটে বসা নিয়ে দ্বন্দ্ব, মাথা ফাটল শিক্ষার্থীর
পরবর্তী নিবন্ধআনোয়ারা চন্দনাইশ বোয়ালখালী বহিষ্কার হচ্ছেন ২৫ বিদ্রোহী প্রার্থী