রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রীন কফি কটেজ ভবনে লাগা আগুনে ৪৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে। বেঁচে থাকার জন্য হাসপাতালে যু্দ্ধ করছেন আরও ১০ জন। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের সর্বোচ্চ চেষ্টায় প্রায় দুই ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ততক্ষণে নিভে যায় ৪৬ জনের জীবন প্রদীপ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, রাজধানী ঢাকা শহরে যতবার বড় কোনো আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে ততবারই উঠে আসে জরুরি নির্গমন পথ নেই। সিঁড়ি ঘরের দরজা তালাবদ্ধ থাকা কিংবা ভবনে অতিরিক্ত সিঁড়ি নেই। প্রতিবারই তদন্ত হয়, প্রতিবেদন জমা হয় অথচ পুড়ে যাওয়া ভবন মেরামত করা হলেও থেকে যায় আগের মতোই।
ভবনে কাজ করেন এমন বেশ কয়েকজন প্রাণে বেঁচে ফিরে জানান, ৭ তলা ভবনটিতে উঠানামায় একটি সরু সিঁড়ি থাকলেও তা ব্যবহার করতে দেওয়া হতো না। সিঁড়িটি ছিল ব্যবহার অনুপযোগী। পুরো ভবনের জন্য ছিল কেবলমাত্র ছোট লিফট। এই ছোট লিফট দিয়েই লোকজন উঠানামা করতেন। বৃহস্পতিবার আগুন লাগার ফলে ভবনের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একমাত্র ছোট লিফটিও বন্ধ হয়ে যায়। অন্ধকার ফ্লোরগুলোতে নারী পুরুষ ও শিশুরা ছোটাছুটি ও চিৎকার করতে থাকেন।
ব্যবহার অনুপযোগী সিঁড়িতে থাকা গাদা গাদা সিলিন্ডার সরিয়ে কেউ কেউ ভবনটির ছাদে উঠতে পারলেও বেশিরভাগই আটকা পড়েন ফ্লোরগুলোতে। কেউ সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে গিয়েও নামতে পারেননি। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে অচেতন হয়ে পড়েন তারা।
আগুন লাগার সময় ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘নিচতলার চায়ের চুমুক নামে রেস্টুরেন্ট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পুলিশের একজন সার্জেন্টসহ আশেপাশের লোকজন আগুনটি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে এনেছিল। এ সময় পাশে থাকা গ্যাস সিলিন্ডারটি বিস্ফোরিত হয়। তখন আগুন ওপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস আসে।
তিনি বলেন, ‘ আগুন লাগার পরপরই ওপরের রেস্টুরেন্টগুলোতে থাকা লোকজনকে নেমে আসার জন্য বলা হয়েছিল। অনেক অনুরোধ করা হয়। সবাই চেয়ে দেখছিল। হয়ত ভাবছিলেন, আগুন নিচে লেগেছে, তাতে ভবনের ওপর তলাগুলোতে লোকজনের কী ক্ষতি হবে? আগুন ছড়িয়ে পড়লে এর কিছুক্ষণ পর আর কেউ নামতে পারেনি। কেউ কেউ লাফ দিয়েছেন। কিন্তু শুরুতেই নামতে চাইলেও সিড়ির এক সাইড দিয়ে নামতে পারতেন অনেকেই।’
অন্য এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘ভবনটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ জরুরি মুহূর্তে নামার জন্য কোনো ব্যবস্থা ছিল না । ফায়ার সার্ভিসসহ অনেকে ব্যবস্থা নিতে এলেও কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই চলে যেতেন তারা। ফলে দিনের পর দিন থেকে গেছে একই অবস্থায়।’
রাজধানীর বেইলি রোডের সাততলা গ্রিন কোজি কটেজের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন বিবেচনায় এই ভবনটিকে তিনবার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল বলে জানান তিনি। শুক্রবার (১ মার্চ) ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের ডিজি ফায়ার সার্ভিনের ডিজি এসব কথা বলেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ‘এই ভবনে কোনো অগ্নি নিরাপত্তার পরিকল্পনা ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ বলে ভবনটির কর্তৃপক্ষকে তিনবার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল ‘ তিনি আরও বলেন, ‘এই ভবনের প্রবেশের জন্য একটি সিঁড়ি রয়েছে। অর্থাৎ ভবনে চলাচলের একটিই পথ ছিল। ভবনের চার তলায় গ্যাসের সিলিন্ডার দেখতে পেয়েছি, সেখানে এখনো সিলিন্ডার আছে, সেখানে গেলে আপনারাও সিলিন্ডার দেখতে পাবেন।’
অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের বিষয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন বলেন, ‘এই ভবনের নিচতলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। তদন্ত করলে সঠিক কারণ বলা যাবে। আমাদের প্রাথমিক ধারণা হচ্ছে গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে এই বিস্ফোরণ হতে পারে।’ এদিকে সিটি মেয়র তাপস বলেন, ‘আমাদের প্রাথমিক পরিদর্শন এবং তথ্য থেকে যতটুকু জানতে ও দেখতে পেয়েছি, এই ভবন নির্মাণে অনেক গাফিলতি করা হয়েছে। এই ভবন নির্মাণে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, বিএনবিসি কোডে যে নির্ণায়কগুলো রয়েছে সেগুলো সম্পূর্ণরূপে লঙ্ঘন করা হয়েছে। আমরা পরিদর্শনে দেখলাম, ১০ তলা ভবন হওয়া সত্ত্বেও মাত্র একটি সিঁড়ি রয়েছে এবং সেই সিঁড়িটাও নির্ধারিত মানদণ্ড অনুযায়ী প্রশস্ত না। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী পাঁচ তলার উপরে ভবন হলেই একটি ভবনে দুটো সিঁড়ি থাকতেই হবে এবং একটি সিঁড়ি জরুরি সাড়া দেওয়ার জন্য নির্ধারিত থাকবে। অগ্নিকাণ্ড, ভূমিধসসহ যেকোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে সেটি ব্যবহৃত হবে। কিন্তু এই ভবনে তা মানা হয়নি বলেই অগ্নিকাণ্ডে এত হতাহত হয়েছে।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ ধরনের ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন ও পরিপালন একান্ত আবশ্যক।