বর্তমানে আমাদের দেশে অগ্নিজনিত দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত কয়েক বছরে এ দুর্ঘটনায় প্রাণহানিসহ সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পুড়ে ছাই হয়েছে অগণিত মানুষের স্বপ্ন। প্রাণহানি যেমন ক্ষতিকর; তেমনি একজনের সম্পদ পুড়ে যখন তার তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্ন ছাই হয়ে যায়, তখন তার কষ্টও সীমাহীন হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়ায় বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে অগ্নিকাণ্ডে এক পরিবারের পাঁচজনের প্রাণহানির ঘটনাটি মর্মান্তিক। দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, রাঙ্গুনিয়ায় ভয়াবহ আগুনে একই পরিবারের ছয় সদস্যের মধ্যে মারা গেছেন পাঁচজনই। এর মধ্যে রয়েছে দুইটা শিশুও। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে উপজেলার পারুয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মহাজন পাড়ার খোকন বসাকের (৪২) বাড়িতে এই মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটে। পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য সিএনজি টেক্সি চালক খোকনই। তার শরীরের ৪০ শতাংশ পুড়ে গেছে। তিনি আশঙ্কাজনক অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। জানা যায়, এক পরিবারের ৫ জনের মৃত্যুর ঘটনায় তাদের স্বজনদের আহাজারি থামছে না। মৃতদেহগুলো সৎকারের পরদিনও শ্মশানে গিয়ে কাঁদতে দেখা গেছে স্বজনদের।
স্থানীয় ইউপি সদস্য পিএম হৃদয়কে উদ্ধৃত করে আজাদীর প্রতিবেদনে বলা হয়, একটু অসতর্কতার জন্য, ছোট্ট একটি ভুলের জন্য সব শেষ হয়ে গেল। পুরো পরিবারটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। চুলার আগুন থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছিল। বসতঘর লাগোয়া রান্নাঘরে অনেক লাকড়ি মজুত ছিল। এ কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তিন কক্ষের ঘরটিতে একটিই দরজা ছিল। সেখানে রাখা ছিল তার সিএনজি টেক্সি। আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর টেক্সির গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে আগুনের তীব্রতা বেড়ে যায়। এ সময় কোনোরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে খোকন বসাক বের হয়ে যান। পাড়ার সবার সাথে তিনি নিজেও আগুন নিভানোর চেষ্টা করেছিলেন। ভেতর থেকে তার পিতা–মাতা, স্ত্রী–সন্তানরাও বাঁচার জন্য আর্তচিৎকার করেছিল। কিন্তু তাদের বাঁচানো গেল না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অসতর্কতা ও অবহেলার কারণে প্রতি বছর অগ্নি দুর্ঘটনায় অগণিত মানুষ নিহত ও সম্পদের ক্ষতি হয়। বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট, গ্যাস বিস্ফোরণ, দাহ্য কেমিক্যাল স্টোরেজ, অগ্নি দুর্ঘটনা, রান্নাঘরসহ ছোটখাটো অবহেলার কারণেও ঘটছে ছোটখাটো অগ্নি দুর্ঘটনা।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মাত্র এক বছরে দেশে আগুন লাগার ঘটনা প্রায় ২২ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বেড়েছে প্রাণহানির ঘটনা। ২০১৯ সালে দেশে ছোট–বড় মিলিয়ে মোট ২৪ হাজার ৭৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। দগ্ধ হয়ে ১৮৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ৫৮৬ জন। যেখানে তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছিল ১৯ হাজার ৬৪২টি। সে বছর প্রাণ হারিয়েছিল ১৩০ জন। এক বছরে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার ২০১৭ সালে এ দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ১৮ হাজার ১০৫ এবং প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ৪৫ জনের। এখানে চুলার আগুন ও শর্টসার্কিটই অগ্নি–দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ বলে দেখা গেছে। শতকরা ৩৯ ভাগ অগ্নিকাণ্ড এ কারণে ঘটছে। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার না করে মানসম্পন্ন সরঞ্জাম ব্যবহার করা উচিত। এতে শর্টসার্কিটের ঘটনা কমানো সম্ভব।
অন্যদিকে, বিশেষজ্ঞ ড. মতিউর রহমান তাঁর এক লেখায় বলেন, অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ অবহেলা। আর সেই সাথে আসে অজ্ঞতা। তাই প্রত্যেকেরই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ সচেতন হওয়া উচিত। রান্না করার পরে, চুলার আগুন সম্পূর্ণরূপে নিভিয়ে দিতে হবে। সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ নিভিয়ে নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে। এছাড়া কারখানায় ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। ছোট বাচ্চাদের আগুন নিয়ে খেলা থেকে বিরত রাখতে হবে।
অগ্নি দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে সবাইকে জানতে হবে। আমাদের শিখতে হবে কীভাবে এসব দুর্ঘটনা মোকাবেলা করতে হয়। আমাদের সচেতন হতে হবে। আমাদের সবাইকে নিয়ম মেনে চলতে হবে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। আর যারা এগুলো মানবে না তাদের উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আমাদের সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। অপ্রত্যাশিত অগ্নি দুর্ঘটনা রোধ করতে হবে।