বহুল প্রত্যাশার পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার হাসপাতাল চালু হচ্ছে অক্টোবরে। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের পাশেই প্রায় ১৩০ কোটি টাকা খরচ করে গড়ে তোলা ক্যান্সার হাসপাতালের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। ভারত থেকে আসা একটি বিশেষজ্ঞ টিম যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ করছে। বিশেষায়িত এই হাসপাতালে রেডিওথেরাপিসহ ক্যান্সারের সব ধরনের চিকিৎসা প্রদান করা হবে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিস্তৃত এলাকায় দুই কোটির বেশি মানুষ বসবাস করে। বিপুল এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ ক্যান্সার আক্রান্ত। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। বছরে গড়ে পঞ্চাশ হাজারের বেশি নতুন ক্যান্সার রোগী যুক্ত হচ্ছে এই তালিকায়। প্রতিদিন গড়ে ১৩৬ জন মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এদের মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি হাসপাতালে কিছু মানুষ চিকিৎসা নিতে এলেও অনেকে রয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসার বাইরে। এই অবস্থায় প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক রোগী ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরসহ নানা দেশে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
চট্টগ্রামে সরকারি–বেসরকারি কোনো পর্যায়ে ক্যান্সারের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা নেই। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কেমোথেরাপি দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও তা অপ্রতুল। মাসের পর মাস সিরিয়াল দিয়েও অপারেশন বা কেমোথেরাপি দেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায় না। কেমোথেরাপিসহ ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য মানুষকে নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। প্রাইভেটেও কেমোথেরাপি দেওয়ার ব্যবস্থা অপ্রতুল।
কেমোথেরাপির অবস্থা যেনতেন হলেও রেডিওথেরাপির অবস্থা নেই বললেই চলে। চমেক হাসপাতালে সীমিত সুযোগ–সুবিধা থাকলেও বেসরকারি কোনো হাসপাতালে রেডিওথেরাপি দেওয়া যায় না। ঢাকায়ও সিরিয়াল দিয়ে সাত–আট মাস অপেক্ষা করতে হয়। অবস্থাপন্নরা দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নিলেও চট্টগ্রামে সাধারণ মানুষের দুর্বিসহ অবস্থা। ক্যান্সার চিকিৎসায় চট্টগ্রামের সার্বিক অবস্থা নাজুক মন্তব্য করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী এবং পরিবারই কেবল বুঝতে পারে কী দুরবস্থার মোকাবেলা তাদের করতে হয়। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, চট্টগ্রামে ক্যান্সারের চিকিৎসা অপ্রতুল। যথাযথ চিকিৎসার অভাবে প্রতি বছর কয়েক হাজার ক্যান্সার রোগী মারা যাচ্ছেন। ক্যান্সারজনিত মৃত্যুহার সাড়ে ৭ শতাংশ। চিকিৎসা ব্যবস্থায় উন্নতি না ঘটলে ২০৩০ সালে এই হার ১৩ শতাংশে পৌঁছাবে। চিকিৎসায় অনেক ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যায় মন্তব্য করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেছেন, চিকিৎসাব্যবস্থা সহজলভ্য করতে পারলে অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব।
এই অবস্থায় চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল বিশ্বমানের একটি হাসপাতাল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক এম এ মালেককে চেয়ারম্যান করে ১০১ সদস্যের ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি দেশে–বিদেশে মানুষের কাছ থেকে হাসপাতালের জন্য আর্থিক অনুদান সংগ্রহসহ নানাভাবে কাজ করে। মানুষের টাকায় মানুষের জন্য এই ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ার কার্যক্রমে শরিক হন চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ। মানুষের কাছ থেকে সংগৃহীত টাকা দিয়ে সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ১০ কাঠা জায়গায় ৮০ হাজার বর্গফুটের ১০ তলা একটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক ঋণ নিয়ে আমদানি করা হয়েছে ক্যান্সার চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি। গত কয়েকদিনে সব যন্ত্রপাতি হাসপাতালে এসে পৌঁছেছে। ভারত থেকে এসেছে একটি বিশেষজ্ঞ টিম। আগামী মাস দুয়েকের মধ্যে এই হাসপাতাল পরিপূর্ণ ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে।
গতকাল হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক যন্ত্রপাতি স্থাপনের কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি ক্যান্সার হাসপাতাল ভবনের নির্মাণকাজের খোঁজ নেন এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি সম্প্রতি আমদানি করা ক্যান্সার মেশিনসহ (লাইনিয়ার এক্সিলারেটর) অন্যান্য যন্ত্রপাতি পরিদর্শন করেন। ক্যান্সার হাসপাতালের নির্মাণকাজ ও সার্বিক কার্যক্রমের অগ্রগতিতে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন।
এম এ মালেক ক্যান্সার মেশিন ইনস্টল করতে ভারত থেকে আসা বিশেষজ্ঞ টিমের সদস্যদের সাথে কথা বলেন এবং যত্নের সাথে মেশিনগুলো স্থাপন করার অনুরোধ জানান। টিমের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিশ্বখ্যাত সিমেন্স কোম্পানি এখানে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ও ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করছে। এই কোম্পানি তাদের কাজের ব্যাপারে আপস করে না। বিশেষজ্ঞ টিম জানায়, আগামী ৪৫ থেকে ৫০ দিনের মধ্যে মেশিন স্থাপনের কাজ শেষ হবে।
আগামী অক্টোবরে ক্যান্সারের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা শুরু করার আশাবাদ ব্যক্ত করে এম এ মালেক বলেন, জনগণের টাকায় জনগণের এই হাসপাতালে শুধু চট্টগ্রামের নয়, সারা দেশের মানুষকেই বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হবে। ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের পাশে দাঁড়ানোর এই সুযোগ তাঁর জীবনের অনেক বড় পাওয়া বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ সময় ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির কো–চেয়ারম্যান এস এম আবু তৈয়ব, সদস্য ও দৈনিক আজাদীর চিফ রিপোর্টার হাসান আকবর উপস্থিত ছিলেন। অন্যদের মধ্যে হাসপাতালের কার্যনির্বাহী কমিটির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মোহাম্মদ মোরশেদ হোসেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল মান্নান রানা, জেনারেল সেক্রেটারি মোহাম্মদ রেজাউল করিম আজাদ, ট্রেজারার অধ্যক্ষ লায়ন ড. মোহাম্মদ সানাউল্ল্যাহ, জয়েন্ট জেনারেল সেক্রেটারি এস এম কুতুব উদ্দিন, অর্গানাইজিং সেক্রেটারি মোহাম্মদ সাগির, স্পোর্টস অ্যান্ড কালচারাল সেক্রেটারি মোহাম্মদ আহসান উল্ল্যাহ, সদস্য ডা. ফজল করিম বাবুল, পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. নূরুল হক, ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল প্রফেসর অসীম কুমার বড়ুয়া, ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথের পরিচালক প্রফেসর ওয়াজির আহমেদ, কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন, অবস অ্যান্ড গাইনী বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর সিরাজুন নুর রোজী, মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর অনুপম বড়ুয়া, নেফ্রলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর আবুল কাশেম, ইএনটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী, এনেসথেসিওলজি বিভাগের প্রফেসর আহমেদ আবু নাসের চৌধুরী, রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের প্রফেসর আ ম ম মিনহাজুর রহমান, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রফেসর সঞ্জয় কান্তি বিশ্বাস, প্রধান প্রকৌশলী অনুরূপ চৌধুরী, উপ–পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন, উপ–পরিচালক (মেডিকেল অ্যাফেয়ার্স) ডা. এ কে এম আশরাফুল করিম, উপ–পরিচালক (প্রশাসন, আইসিএইচ) ডা. মো. আবু সৈয়দ চৌধুরী, অনকোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. শেফাতুজ্জাহান, আইসিইউ ইনচার্জ ডা. মাহাদী হাসান, চিফ মেডিকেল ফিজিসিস্ট মো. নজরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
পরে এম এ মালেক হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল আজ চট্টগ্রামবাসীর একটি আস্থার জায়গায় পরিণত হয়েছে। জনগণের ভালোবাসা ও সহযোগিতায় এই হাসপাতাল আজ বিশাল একটি প্রতিষ্ঠানে রূপ লাভ করেছে। তিনি রোগীদের প্রতি চিকিৎসার পাশাপাশি সদয় ব্যবহার ও ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য ডাক্তারদের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, লাখ টাকা দিতে হবে কথা নেই। আমরা এক টাকাও নেব। জনগণের টাকায় জনগণের এই হাসপাতাল যেন সবার হাসপাতাল হয়ে ওঠে, সবাই যেন এটিকে নিজের ভাবতে পারে, সেজন্য আমরা সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ চাই।
ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির কো–চেয়ারম্যান এস এম আবু তৈয়ব বলেন, একটি সম্পূর্ণ নাগরিক উদ্যোগে এবং জনগণের অংশগ্রহণে এমন একটি হাসপাতাল গড়ে ওঠার নজির ঢাকায়ও নেই। তিনি সকলকে ক্যান্সার হাসপাতালের সহযোগিতায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির সেক্রেটারি রেজাউল করিম আজাদ বলেন, চট্টগ্রামের মানুষ অকাতরে এই হাসপাতালের জন্য দান করেছেন। আমরা চট্টগ্রামের মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং বিশ্বাসের মানুষ এম এ মালেক নেতৃত্ব দেওয়ায় এই কঠিন কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন করতে যাচ্ছি। ১৩০ কোটি টাকার এই হাসপাতালের জন্য আমাদেরকে ব্যাংক থেকেও অনেক টাকা ঋণ নিতে হয়েছে। চট্টগ্রামের বিত্ত এবং চিত্তবান মানুষ যদি এগিয়ে আসেন তাহলে সামনের পথচলা অনেক সহজ হবে। আসছে অক্টোবরেই আমরা হাসপাতাল চালু করব। তবে আমাদের ফান্ডে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।