জ্বালানি বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের সরবরাহকৃত ফার্নেস অয়েলে মাত্রাতিরিক্ত পানি পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে তেল গ্রহণ না করে সম্প্রতি ৮শ মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েলবাহী একটি জাহাজ ফিরিয়ে দিয়েছে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র বাঘাবাড়ী ৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্ট। কয়েকদিন আগে বিষয়টি জানাজানি হলে বিপিসিতে তোলপাড় শুরু হয়। মেঘনা পেট্রোলিয়ামের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা ফার্নেস অয়েলে অতি মাত্রায় পানি পাওয়ার বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন। তবে পরোক্ষভাবে ওইদিনের ফার্নেস অয়েল পরিবহনকারী ‘এমটি ওশান স্টার’ জাহাজের ওপর দোষ চাপানোর অভিযোগ উঠেছে মেঘনার ডিপো ইনচার্জের বিরুদ্ধে।
জানা যায়, ১২ নভেম্বর মেঘনা পেট্রোলিয়ামের পতেঙ্গার গুপ্তখাল প্রধান স্থাপনা (এমআই) থেকে ৮শ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন এমটি ওশান স্টার জাহাজ ভর্তি করে ফার্নেস অয়েল পাঠানো হয় রাজশাহীর সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী ৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্টে। ১৮ নভেম্বর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ফার্নেস অয়েল গ্রহণ করার আগে ল্যাবের পরীক্ষায় মানমাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত পানির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এরপর বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ ফার্নেস অয়েল গ্রহণ না করে ফিরিয়ে দেয়। ২৩ নভেম্বর পতেঙ্গা প্রধান ডিপোতে ফিরে আসা এসব ফার্নেস অয়েল গ্রহণ করে। গ্রহণ করার সময় পুনরায় পরীক্ষায় পানির পরিমাণ মানমাত্রার মধ্যে থাকার দাবি করেন প্রধান স্থাপনার ম্যানেজার (বর্তমানে এজিএম পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মুজিবুর রহমান। তবে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার জন্য আরেক জাহাজে করে বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ফার্নেস অয়েল পাঠায় মেঘনা পেট্রোলিয়াম।
তথ্য অনুযায়ী, মানমাত্রা অনুযায়ী ফার্নেস অয়েলে দশমিক ৫ শতাংশ পানি দ্রবীভূত অবস্থায় থাকতে পারে। কিন্তু ওশান স্টারে পরিবাহিত ফার্নেস অয়েল পরীক্ষা করে বাঘাবাড়ী ৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্টে পানি পাওয়া যায় দশমিক ৭ মাত্রায়।
বাঘাবাড়ী ৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্টের নির্বাহী প্রকৌশলী (অপারেশন) ফজলুর রহমান গতকাল আজাদীকে বলেন, মেঘনা পেট্রোলিয়াম থেকে আসা এমটি ওশান স্টার জাহাজটি থেকে ফার্নেস অয়েল গ্রহণ করার আগে ল্যাবে পরীক্ষা করে মানমাত্রার চেয়ে বেশি পানি পাওয়া গিয়েছিল। যে কারণে আমরা তেল গ্রহণ না করেই জাহাজটি ফেরত দিয়েছি। তবে চট্টগ্রাম থেকে ফার্নেস অয়েল নিয়ে আসার পর জাহাজটির প্রত্যেকটি ট্যাংকের সিল স্বাভাবিক ছিল বলে দাবি তার। তিনি বলেন, জাহাজটিতে ৭ লাখ লিটারের অধিক তেল ছিল। তবে আগে থেকেও কখনো জাহাজের লোকজন পরিবাহিত ফার্নেস অয়েলের চালানপত্র আমাদের দেন না। আমরা স্বাভাবিক নিয়মে মেপে গ্রহণ করে তাদের (জাহাজের সুপারভাইজার) রিসিভিং দিই।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটির আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মেঘনা পেট্রোলিয়াম চট্টগ্রাম ডিপো থেকে আসা জাহাজটি থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে দুটি নমুনায় একটিতে দশমিক ৮ শতাংশ এবং আরেকটিতে দশমিক ৭ শতাংশ পানির উপস্থিতি মিলেছে। যে কারণে পুরো জাহাজটি ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ফেরত আসা ফার্নেস অয়েল পুনরায় গ্রহণ করার আগে নিজেদের ল্যাবে পরীক্ষায় পানির পরিমাণ মানমাত্রার মধ্যে থাকার দাবি করেন মেঘনা পেট্রোলিয়ামের প্রধান স্থাপনার ম্যানেজার মুজিবুর রহমান। তবে তেল স্বাভাবিক নিয়মে বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিতে না পারা এবং ফেরত আসা জাহাজে প্রায় ৫শ লিটারের বেশি তেল কম পাওয়ার অভিযোগ এনে জাহাজটির মালিক কর্তৃপক্ষকে চিঠিও দিয়েছে মেঘনা পেট্রোলিয়াম।
এ বিষয়ে মুজিবুর রহমান আজাদীকে বলেন, এমটি ওশান স্টার জাহাজটিতে ৬টি পৃথক ট্যাংক রয়েছে। গত মাসের (নভেম্বর) ১২-১৩ তারিখ জাহাজটি বাঘাবাড়ী যাওয়ার পরে ওরা দুটি ট্যাংকে দশমিক ৭ শতাংশ পানি পেয়েছেন বলে জানিয়েছে। দশমিক ৭ অনেক সময় হয়ে যায়। কারণ যে তলুইন দিয়ে ওরা পরীক্ষা করে ওই তলুইনে পানির মাত্রা অনেক সময় বেশি থাকে। তাছাড়া এরা একদম বটম (তলানি) স্যাম্পল (নমুনা) নিয়ে পরীক্ষা করে। নিয়ম হচ্ছে কম্পোজিট করা। বটমে অনেক সময় ময়লা থাকে, ময়েশ্চার বেশি থাকে। এজন্য অনেক সময় পানির পরিমাণ বেশি দেখায়। ওরা যখন পানির পরিমাণ বেশি পাওয়ার কথা বলেছে, তখন তো জাহাজটি বসিয়ে রাখা যাবে না। যে কারণে জাহাজটি ফেরত আনা হয়েছে। বিকল্প আরেকটি জাহাজে তেল পাঠানো হয়েছে। তাদের উৎপাদনে কোনো বিড়ম্বনা হয়নি। তাছাড়া জাহাজটি ফেরত আসার পর আমরা প্রত্যেকটি ট্যাংকের বটম স্যাম্পল পরীক্ষা করে দশমিক ২ পেয়েছি। এরপর আমরা একটি খালি ট্যাংকে তেলগুলো নিয়েছি। ওই তেল এখনো ট্যাংকে ফেলে রাখা হয়েছে। যেকোনো সময় আবারো পরীক্ষা করার সুযোগ রয়েছে। পরে স্যাম্পল ইস্টার্ন রিফাইনারির ল্যাবে পরীক্ষা করে সবগুলোতে দশমিক ১ এর নিচে পাওয়া গেছে।
ফার্নেস অয়েল পরিবহন ভাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, যেহেতু পিডিবি থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে সেহেতু মেঘনা পেট্রোলিয়াম থেকে তাদের (জাহাজ মালিককে) ভাড়া দেওয়া হবে না। কারণ আমাদের সাথে চুক্তি অনুযায়ী জাহাজ মালিককে বিল পরিশোধ করা হবে না। আমরা ওশান স্টারের মালিককে ওই সপ্তাহেই চিঠি দিয়েছি। তাছাড়া জাহাজে ৫শ লিটারের কিছু বেশি তেল লস হয়েছে। সেটার বিলও জাহাজ কর্তৃপক্ষ পরিশোধ করবে। তাদের ভাড়ার বিলও পরিশোধ করা হবে না। রিফাইনারিতে স্যাম্পল পরীক্ষার বিলও জাহাজ মালিককে পরিশোধ করতে হবে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভুল থাকতে পারে। তা নাহলে কোথাও না কোথাও ধরা পড়ত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মেঘনার চার্টারে চলা এক জাহাজের মালিক আজাদীকে বলেন, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের চট্টগ্রাম ডিপো থেকে জাহাজে তেল দেওয়ার জন্য সবসময় দেড় পার্সেন্ট (১.৫০%) তেল কম দেওয়া হয়। এটা জাহাজ পরিচালনাকারী কর্মকর্তা ও ডিপো ম্যানেজারের মধ্যে অলিখিত সমঝোতা। অনেক সময় সমঝোতার মাধ্যমে জাহাজে বেশি তেলও দিয়ে দেওয়া হয়। বেশি তেল পথে চোরাইভাবে বিক্রি করে জাহাজের ড্রাইভার, সুপারভাইজাররা। চোরাই বিক্রি করা তেলের টাকা ডিপো ম্যানেজারসহ বিপিসির ঊর্ধ্বতন পর্যায় পর্যন্ত ভাগাভাগি হয়। কিন্তু অনিয়ম প্রকাশ পেলে বিপাকে পড়তে হয় জাহাজ মালিককে। বিপিসির উচিত পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
তিনি বলেন, পানি বেশি থাকার অভিযোগে ফেরত আসা তেল জাহাজ থেকে ট্যাংকে গ্রহণ করার আগেই বিপিসি, পিডিবি ও মেঘনা পেট্রোলিয়ামের প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে স্যাম্পল গ্রহণ করা উচিত ছিল। অনিয়ম ধামাচাপা দিতে তড়িগড়ি করে স্যাম্পল পরীক্ষা দেখিয়ে ফেরত আসা তেল ট্যাংকে নিয়ে নিয়েছে ডিপো কর্তৃপক্ষ।
এ ব্যাপারে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর ছাইফুল্লাহ আল খালেদ আজাদীকে বলেন, জাহাজটি ফেরত আসার পর আমরা নিজেরা পরীক্ষা করেছি। রিফাইনারির ল্যাবেও পরীক্ষা করেছি। সব জায়গায় ঠিক পেয়েছি। তবে জাহাজের মালিকপক্ষ কেন তেলগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বুঝিয়ে দিতে পারেনি সেটা তাদের ব্যর্থতা। স্যাম্পলিং করার জন্য জাহাজ সুপারভাইজার ও পিডিবির লোকজন থাকে। পিডিবিতে স্যাম্পলিং করার সময় জাহাজের কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকা উচিত ছিল। ওখানে তাদের (জাহাজ কর্তৃপক্ষ) ব্যর্থতা।
এ বিষয়ে বিপিসির পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) সৈয়দ মেহদী হাসান গত রাতে আজাদীকে বলেন, তেল সরবরাহে অনিয়মের অভিযোগ থাকলে অবশ্যই বিপিসির পক্ষ থেকে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, দুই মাস আগেও মানহীন তেল বিপণনের অভিযোগ ওঠে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের বিরুদ্ধে।