এ বাড়ির ছেলেরা ভারতে। এই খবর পাক সেনারা জানতো। ওরা প্রায়ই মুক্তির খোঁজে হানা দিতো। যেহেতু আমার শ্বশুরবাড়ি স্বনামে বিখ্যাত থাকায় ওরাও হয়তো বা সমীহ করতো। আতিকের জন্মের সপ্তাহখানেক পর ওরা পুনরায় হানা দিলো আমাদের অন্দর মহলে। তার আগে ওরা আমাদের পাশের পাড়ার হিন্দুদের ওপর প্রচণ্ড অত্যাচার চালালো। ওদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে পুরোটা ধ্বংস করে দিলো। অনেককে গুলি করে মারলো।
এরপরেই বুট জুতার শব্দ আমাদের পুরো বাড়িতেই প্রতিধ্বনিত হলো। ছেলেরা যে যেদিকে পারে পেছনের পুকুর পাড় দিয়ে উধাও হলো। কেউ কেউ পানিতে ডুবে নাক ভাসিয়ে থাকলো। আমরা মেয়েরা সবাই রান্নাঘরে জমায়েত হলাম। সাক্ষাৎ যম যেন আমাদের সামনে। ওদের রক্তচক্ষু হুঙ্কারে আমরা কিছুটা সন্ত্রস্ত ছিলাম। জ্বালাও পোড়াও করে ওরা সম্ভবত পিপাসিত ছিলো। রুক্ষস্বরে পানি চাইলো। আমার শাশুড়িমা গৃহকমীকে নিয়ে ওদেরকে ঘড়ায় ঘড়ায় পানি দিলেন। ওদের পিপাসা যেন মিঠছেই না।
তখন আতিকের বয়স মাত্র ৭ দিন। আমি ঘুমন্ত বাচ্চাকে বিছানায় রেখেই রান্নাঘরে আশ্রয় নিলাম। এত তাড়াহুড়ার মধ্যে আমি নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবেই এই ব্যবস্থা নিলাম। ঘুমন্ত বাচ্চাকে ওর কাপড়–চোপড়সহ তুলে নেবার সময়টুকুও পেলাম না। ভাগ্য ভালো, ওরা শেষ পর্যন্ত আমার বেডরুমে যায়নি। আতিক ঘুম ছিল। এক সেনা আমার দিকে আঙুল তুলে শুধালো– ‘ইয়ে কৌন হ্যায়?’
আমার শ্বাশুড়ির বাড়ি হুগলী। উনি উর্দু জানতেন। ওদের ভাষাতেই জানালেন– ‘হামারা বেটাকা বহু হ্যায়।’ আমার সাত কপালের ভাগ্যি; সে অন্যদিকে মন দিলো। অর্থাৎ চড়ে বেড়ানো মুরগি ধরতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। বলাবাহুল্য, আমাকে সারাক্ষণ আম্মা তাঁর পেছনে আড়ালে রেখেছিলেন। আমার বয়স তখন সম্ভবত ঊনিশ। যাবার বেলায় আমার ভাসুরের মেজ ছেলেকে (সারোয়ার) সামনে পেয়ে হুকুম দিলো আগামীকাল সে যেন ব্রীজের নিচে (কালুরঘাট) বিকালে অবশ্যই দেখা করে। ভাগ্য ভালো সে আজরাইলের হুকুম তামিল করেনি।
এত কাণ্ডের ভেতরেও ওরা বিদায় নেবার পর দেখা গেলো পাশের বাড়ির এক চাচি আম্মা তার বৌকে বকাঝকা করছেন। তিনি তার সমস্ত সঞ্চয় ও গয়না একটা বালিশে পুরে রেখেছিলেন নিরাপত্তার জন্য। তা বধূমাতা কেন হাতে করে বালিশটা তুলে আনেনি। উনাকে বোঝানো যাচ্ছে না কিছুতেই যে, এটাই ঠিক হয়েছে। এত বালিশের ভেতরে স্পেশাল একটা বালিশ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করলে ওরাতো ওটাই কেড়ে নিতো! অনেক দুঃখ ভয় ভীতির মধ্যেও আমরা সেদিন হাসলাম। যাকে বলে দুঃখের হাসি।
এই বাড়িতে আর এক ঘরে দুই শরীফের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। একজনের ঘরে উনার তরুণী কন্যা ছাড়া আর কেউ নেই। মেয়ে একা কি করবে? দিশকুল না পেয়ে পেছনে পুকুরের পাড়ের দিকে হাঁটা দিলো। অন্য শরীফ সব ব্যবধান ভুলে সেই মেয়েকে সাদরে ডেকে নিলো, ‘মরলে একসাথে মরবো, ঘরে আয়।’ এই বলে। এভাবেই দুই পরিবার সব বিবাদ ভুলে আবারো এক হলো।
রাজাকার আলবদর তথা শয়তানদের দোসরদের দৌরাত্ম্য সারাদেশে চলছে। আর ছিল শান্তি কামিটির চেয়ারম্যান নামধারী কতক বেঈমানের দল। এসব সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের থেকে আমরা দূরেই থাকতাম। তবুও কোন ঘরে মুক্তি এসেছিলো, এসব খবর ওদের নখদর্পণে রাখার চেষ্টা করতো।
রাতের বেলা ঘরেও হ্যারিকেনের নিভু নিভু আলোতে সব কাজ করতে হতো। বিবিসি বাংলা সংবাদ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী কোলকাতা, পাকিস্তানি বেতার সবই আমরা শুনতাম এবং সত্য মিথ্যা মিলাতাম। তবে খুব লো ভলিউমে। আর ছিলো ভয়েস অব আমেরিকা। স্বাধীন বাংলা বেতারের দেশাত্মবোধক গান, রবীন্দ্র–নজরুল গীতি, এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র, রাজু আহমেদের জল্লাদের দরবার সহ বহু কথিকা, জীবন্তিকা, মুক্তিকামী প্রত্যেক বাঙালির নিকট প্রিয় ছিলো। যুদ্ধে যেতে পারিনি। এসব শুনে শুনেই আমরা প্রতিমুহূর্ত আশান্বিত থাকতাম। একদিন আমরা স্বাধীন হবো। এই দেশ হানাদার মুক্ত হবে, হবেই ইনশাআল্লাহ। এই আশায় থাকতাম সবাই। এপ্রিল মাসে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলার আমবাগানে ১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রথম গঠন হয়েছিলো। একে একে এবং পরবর্তীতে বহুদেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এদের মধ্যে ভারত, ভুটান, নেপাল রাশিয়া অন্যতম। এভাবেই আমাদের দিনগুলো কাটছিলো। দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোদুল দোলায়। বিভিন্ন জায়গায় পাকবাহিনির পরাজয় এবং নাকাল হবার ঘটনা চমৎকারভাবে শুনতাম স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে। শেখ মুজিবুর রহমান, উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং স্বরাষ্ট্র ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী হন এম কামরুজ্জামান। নবগঠিত এই সরকার বিশ্বসম্প্রদায়ের সমর্থন পেতে থাকে। অপরদিকে মুক্তিবাহিনির ও গেরিলা যোদ্ধাদের মনোবল বাড়তে থাকে। বাংলার ইতিহাসের এই গৌরবোজ্জ্বল মাস মুক্তিকামী মানুষের মনোবলকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করতে থাকে। ফলে মুক্তিযুদ্ধ সফলতার দিকে দ্রুত এগুতে থাকে। হানাদার বাহিনির মনোবল তেমনি হ্রাস পেতে থাকে।
নভেম্বর মাসের শেষের দিকে আব্বা আনোয়ারা থেকে এসে আতিকসহ আমাকে নিয়ে গেলেন। আমাদের যাত্রা ছিলো নৌকা যোগে। গন্তব্য কর্ণফুলীর অপর পাড়ে আনোয়ারায়। ওখানে দেখলাম সবকিছু স্বাভাবিক। এখানে পাকবাহিনির আগমন নেই। নদী পার হওয়া তাদের জন্য কঠিন ব্যাপার। ফলে মানুষ নিরাপদে, শান্তি ও স্বস্তিতে আছে। যদিও ভেতরে ভেতরে অনেকের ছেলেরা মুক্তি বাহিনিতে যোগ দিয়েছে। তবে সেটা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। আমি এই বাড়ি ঐ বাড়ি ঘুরে ঘুরে দিন কাটাচ্ছি। সঙ্গী ট্রানজিস্টর। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, বিবিসি বাংলা এবং আকাশবাণী কোলকাতা। আরও ছিলো ভয়েস অব আমেরিকা। এমন কিছু মানুষ থাকে তারা সবসময় বিপক্ষে থাকে। এখানেও তার ব্যাত্যয় নেই। কিন্তু বয়স্করা পাকিস্তানের সাপোর্টার। তারা আশা করে পাকিস্তান টিকবে। যাই হোক, মনভরে এই সব শুনি আর আশান্বিত হতে থাকি। বিজয় আমাদের হবেই হবে। সেই স্বাধীনতার স্বাদ পেতে সবাই উম্মুখ।
ডিসেম্বর মাস এসে গেলো। আনোয়ারার আকাশে প্লেন–হ্যালিকপ্টারের আনাগোনা বেড়ে গেছে। খবরে শোনা হলো–
অবশেষে ১৫ ডিসেম্বর, ৯ মাসের নাতিদীর্ঘ যুদ্ধ এই মাসেই দ্রুত পরিণতির দিকে ধাবমান হতে থাকে। ভারতীয় সেনাবাহিনির প্রধান জেনারেল স্যাম মানকেশ পাকবাহিনিকে শেষবারের মতো আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। এরপূর্বে পাক অধিনায়ক এ এ কে নিয়াজী বেলা ২টা ৩০মি. ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেলের মাধ্যমে যুদ্ধ বিরতির আবেদন জানায়। মেজর রাওফরমান আলী দিল্লিস্থ যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস থেকে মিত্রবাহিনির অধিনায়ক মেজর মানকেশের কাছে তা পাঠান। মানকেশ তৎক্ষণাৎ বিকেল ৫টা থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত বিমান হামলা বন্ধের নির্দেশ দেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের মাধ্যমে। যুদ্ধ বিরতির মাধ্যমে পাকবাহিনি প্রধানকে আত্মসমপর্ণের নির্দেশ দেন। যার পরিণতিতে শত্রুপক্ষ প্রধান আবদুল্লাহ খান নিয়াজী লেফটেনেন্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে জমা দেন। সোহরাওয়ার্দী ময়দানে ঢাকায় সবার সামনে।
এভাবেই আমাদের মুক্তিবাহিনির বিজয় ত্বরান্বিত হয়। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মুক্ত স্বাধীন বাংলা হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান লাভ করে। আমরা পাই একটি স্বাধীন দেশ ও লাল সবুজে মেশানো পতাকা। এই বিজয় গৌরবের বিজয়। ১৬ ডিসেম্বরকে তাই ত্যাগ তিতিক্ষার রক্ত ঘামে মিশ্রিত লক্ষ লক্ষ মা বোনের মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে প্রাপ্ত বিজয় বললে এতটুকু অত্যুক্তি হবে না। এই বিজয় ৩০ লক্ষ পুরুষ নারীর শহিদের রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্ত বিজয়।
এই দিনটিতে আমি বাড়ির পুকুরে নেমেছিলাম প্রায় বেলা ২টার পর। একগলা পানিতে ডুবে আছি। মাথার ওপর শুরু হলো প্লেন–হেলিকপ্টারের আনাগোনা। শত্রুবাহিনিতো বিমান হামলা বন্ধ রেখেছে। পলকেই বুঝলাম, আমাদের মিত্রবাহিনির এই আকাশযান। আকাশ থেকে কি–সব কাগজ ফেলা হচ্ছে। আনোয়ারার মতো গঞ্জ–গ্রামেও বাইরে প্রচণ্ড হট্টগোলের মাঝে শোনা গেলো আওয়াজ! জয় বাংলা! আমিও গলা অবধি পানিতে ডুবেই সমস্ত শক্তি একত্র করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিলাম ‘জয় বাংলা’! ৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর।
আজ পুনরায় অনুভব করতে চাই সেই আনন্দকে। প্রাপ্তিকে। কিন্তু দেশের সামগ্রিক অবস্থা মনকে অসহায় করে ফেলে। পদ্মাসেতু, উড়ালসেতু, কর্ণফুলী টানেল, কক্সবাজার রেললাইনসহ আরো বহু প্রাপ্তি আমাদের। পাশাপাশি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের এই স্বাধীন দেশে বেঁচে থাকার যুদ্ধ, সামাজিক অবক্ষয়, দুর্নীতিরচিত্র দেখলে মনে হয় এখনও বুঝি সেই গলাঅবধি পানিতেই ডুবে আছি। এই ডুবন্ত পানি থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে কখন উঠবো সেই ভরসাও যেন পাচ্ছি না!
তবুও আশায় বাঁচে মানুষ। আমাদেরও ১৮ লক্ষ বাঙালি জাতি তথা সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর চিন্তা ও চেতনায় সেই প্রাপ্তির আশাতেই বেঁচে থাকা।
লেখক : রম্যসাহিত্যিক, সভানেত্রী, চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘ।