‘আসছে ফাগুন দ্বিগুণ নয়, ১৬ কোটি হবো।’ এটি ছিল চট্টগ্রাম বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী কাউসার মাহমুদের (২২) শেষ ফেসবুক স্ট্যাটাস। তার দুদিন পর ৪ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনে চট্টগ্রামের নিউমার্কেট চত্বরে পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় গুরুতর আহত হয় কাউসার। দীর্ঘ ৭০ দিন হাসপাতালের বেডে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকার পর গত রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) তিনি মারা যান। গতকাল দুপুর বারোটায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কাউসারের প্রথম জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর রাত আটটার দিকে চট্টগ্রাম আগ্রাবাদের কমার্স কলেজ মাঠে দ্বিতীয় জানাজা নামাজ শেষে মসজিদের পাশে কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। বন্ধু স্বজনরা শেষবারের মতো একবার দেখতে কমার্স কলেজ মাঠে ছুটে আসেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জানান ছাত্র আন্দোলনে শহীদ কাউসারকে। কাউসারের মৃত্যুর খবরে কাঁদছে পুরো চট্টগ্রাম। শহীদের বন্ধু স্বজনরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোক জানাতে দেখা গেছে। কাউসারের পরিবারে নেমেছে শোকের মাতম। ছেলেকে হারিয়ে বাবা–মা দুজনই পাগল প্রায়। কাউসার লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার ভাটরা ইউনিয়নের আব্দুল মোতালেবের ছেলে। আব্দুল মোতালেব নগরের চট্টগ্রাম কর্মাস কলেজ রোডে দীর্ঘদিন ধরে পরিবার নিয়ে থাকেন।
গত ৯ আগস্ট ছিল শহীদ কাউসারের ২২তম জন্মদিন। সেদিন ফেসবুকে জন্মদিনের কেক ও চিকিৎসাধীন কাউসারের ছবি পোস্ট করে কাউসারের ছোট ভাই সুলতাল মাহমুদ লিখেন, ‘হেপি বার্থ ডে ভাইয়া। আজ দুই মাস দশদিন হয়ে গেল ভালো করে কথা বলতে পারি না। তোর সাথে একদিন ঝগড়া না করলে ভালো লাগে না। কিন্তু আজ কতদিন তোর সাথে কথাই বলতে পারি না।’ শহীদ কাউসারের বন্ধু তানজিম উদ্দিন লিখেছেন, ‘আমাদের ৪১ ব্যাচের কাউসার মাহমুদ আল্লাহর জিম্মায় ফিরে গেলো। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ’লা আমার বন্ধুকে জান্নাত নসীব করুক। ২ বছরের ভার্সিটি লাইফে তোর সাথে ছোট ছোট অনেক মেমোরি, ট্যুর, ইফতার, এঙারসন সব জায়গায় তুই ছিলি প্রাণবন্ত। মিস করবো রে তোরে।’ সর্বশেষ এক সাক্ষাৎকারে কাউসার বলেছেন, ‘পুলিশের টিয়ারসেল খেয়ে রাস্তায় পরে গিয়েছিলাম। সেখানেই ছাত্রলীগে আঘাত করে। আব্বু–আম্মুকে কিছু না জানিয়ে ঘরে শুয়ে পড়ি। পরে আমার ব্যথা আর খিঁচুনি ওঠে।’
জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই আন্দোলনে অংশ নেন বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী কাউসার মাহমুদ। নগরের নিউ মার্কেট ও দেওয়ানহাট কেন্দ্রীক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তিনি। গণঅভ্যুত্থানের একদিন আগে ৪ আগস্ট চট্টগ্রাম হয়ে উঠেছিল অগ্নিগর্ভ। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ–সংগঠনগুলোর সশস্ত্র হামলায় সেদিন আহত হয় দুই শতাধিক ছাত্র–জনতা। যাদের অধিকাংশ ছিলেন গুলিবিদ্ধ। পূর্বে ঘোষণা অনুযায়ী ৪ আগস্ট সকাল ১০টার আগেই নগরের নিউ মার্কেট এলাকায় অবস্থান নেয় বিক্ষুব্ধ ছাত্র–জনতা। সেখানে আন্দোলনে অংশ নেন কাউসার। বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায়। এ সময় ছাত্রলীগ–যুবলীগসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অত্যাধুনিক অস্ত্র, শটগান, পিস্তল, লংরেঞ্জ রাইফেল, চাইনিজ কুড়াল, রাম–দাসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা যায়। পুলিশের ছোঁড়া টিয়ারশেলের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন কাউসার। তখন ছাত্রলীগের বেধড়ক পিটুনিতে কিডনিতে আঘাত প্রাপ্ত হন। পরদিন ৫ আগস্ট নগরের ইসলামি ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করা হয় কাউসারকে। চিকিৎসকরা জানান গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত কাউসারের দুটি কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। দুই সপ্তাহ ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন কাউসার। পরে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে কাউসারকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে যাওয়া হয়। ৭০ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর শাহাদাত বরণ করেন এ শিক্ষার্থী। এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর নিউ মার্কেটে আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম আরিফ (১৮) শাহাদাত বরণ করেন। কাউসার মাহমুদের বাবা আব্দুল মোতালেব জানান, সোমবার দুপুর ১২টার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কাউসারের প্রথম জানাজা হয়। এরপর রাতে আব্দুর রহমান মাতব্বর জামে মসজিদে দ্বিতীয় জানাজা শেষে মসজিদের পাশে কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।