ছয় হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি নুরজাহান গ্রুপের এমডি জহির আহমেদ রতনের জামিন নাকচ করে দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি নতুন তিনটি মামলায় তাকে দেওয়ানী আটকাদেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল পৃথক পৃথক আবেদনের উপর শুনানি শেষে চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান এ আদেশ দেন। এর আগে রতনকে আদালতে হাজির করা হয়। প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর তাকে ঢাকার বাড্ডা থেকে গ্রেপ্তার করে নগরীর কোতোয়ালী থানা পুলিশ। তার বিরুদ্ধে ৬১ মামলার পরোয়ানা রয়েছে। এর মধ্যে সাজা পরোয়ানা রয়েছে ২৬টি। আদালতের বেঞ্চ সহকারী রেজাউল করিম আজাদীকে বলেন, রতনের জামিন চেয়ে তার আইনজীবী আবেদন করলে বিচারক সেটি নাকচ করে দিয়েছেন। পাশাপাশি তাকে নতুন তিনটি মামলায় আটকাদেশ দেওয়া হয়েছে। ২০টির বেশি মামলায় তার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত হওয়া সাজাগুলো একটির পর একটি কার্যকর হবে জানিয়ে বেঞ্চ সহকারী বলেন, রতন সব সাজা একসাথে কার্যকর চেয়ে আবেদন করেছিলেন। আদালত সেটি নাকচ করে দেন।
এদিকে রতন যখন কাঠগড়ায় দাঁড়ানো তখন তার উদ্দেশ্যে বিচারক বলেন, এই আদালতে আপনার প্রতিষ্ঠানের যত মামলা আছে তাতে ব্যাংকগুলোর দাবি ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি। আপনি হয়ত বলবেন সেটা আরো কম। এখানে সাউথ ইস্ট ব্যাংকের চারটি মামলায় ১২০০ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৬টি মামলায় ১৫০০ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের চারটি মামলার মধ্যে তিনটির রায় হয়েছে–এগুলোতে প্রায় ১০০০ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের দুটি মামলায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা, আরও আছে। জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকেরগুলোতে কোনো মর্টগেজও নেই। ইতঃপূর্বে এসব মামলায় আপনার ও আপনার পরিবারের সদস্যদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছি। ইমিগ্রেশন পুলিশ জানায়, আপনার স্ত্রী কানাডায়। আপনি দেশেই ছিলেন, পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
গত ২ বছর আদালতে সেভাবে উপস্থিত ছিলেন না উল্লেখ করে বিচারক বলেন, আপনি কি বলতে চান। কোনো প্রপার্টি আছে এখন? তখন রতনের আইনজীবী নুকবাতুল জুমার বলেন, প্রপার্টি যা আছে সব মর্টগেজ। এসময় রতন বলেন, আমি এক সময় হাজার কোটি টাকা বছরে ট্যাঙ দিয়েছি। ব্যবসা করেছি, দেশের কাজ করেছি। ওয়ান ইলেভেনের সময় কি পরিস্থিতি ছিল আপনারা জানেন। শুধু আমি না, তখন ব্যবসায় সবাই লস করেছে। লস কভার করতে আবার এলসি করেছি। ব্যাংক তখনও এলসি করতে দিয়েছে। তখন ব্যাংক আগের এলসির টাকা ফেরত চাইলে আমি এ পথে আগাতাম না। আগের ও পরের সুদ মিলে বড় অংক হয়ে গেছে। তারপর ডলার ক্রাইসিসের কারণে এক ব্যাংক থেকে ডলার কিনে আরেক ব্যাংককে দিতে হয়েছে। নতুনগুলো আপনারা দেখছেন। পুরনোগুলো দেখছেন না।
বিচারক বলেন, এখানে যত ডকুমেন্ট এসেছে মামলায়, সব ২০১১ সালের ও তার পরের। আপনার যে পরিমাণ খেলাপি, দেশের শীর্ষ ৫ ঋণ খেলাপির মধ্যে আপনার নাম থাকার কথা। বড় খেলাপিদের কথা বিবেচনায় নিয়ে রিশিডিউল করতে ২–৩% দিয়ে ১০ বছরের সময় দেয়া হয়েছে। সেখানেও প্রবেশ করেননি। আপনার বিরুদ্ধে অনেক চেকের মামলাও আছে।
এ বিষয়ে রতন বলেন, আমার দুর্বলতা ছিল, সেটার সুযোগ অনেকে নিয়েছে। আমি কোনো টাকা পাচার করিনি। টাকা পাচার করলে দেশে থাকতাম না আজ। দেশের জন্য কাজ করেছি। নাম বলছি না এখানে, কয়েকটি ব্যাংক বেঈমানি করেছে। গত ১০–১২ বছরে মামলার জ্বালায় কোনো ব্যবসা করতে পারেননি উল্লেখ করে রতন বলেন, কিন্তু কর্মচারীদের বেতন ঠিক রেখেছি। নিজের খাওয়ার পয়সা ছিল না। আইনজীবী ছিল, হয়ত সঠিক জায়গায় নজর দিতে পারিনি। অর্থ পাচার করিনি স্যার। এলসি করেছি। শোধ করতে পারিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের শর্তে তখন লোকাল এলসি ছিল। সবাই করেছে। এরকম একটা এলসির জন্যও মামলা করেছে। আমি একা না।
আদালতসূত্র জানায়, ২০১০/২০১১ সালে ভোগ্যপণ্য আমদানী ও বাজারজাত করণের জন্য রাষ্ট্রায়াত্ত অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক এবং বেসরকারী ন্যাশনাল ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করেন নুর জাহান গ্রুপের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। ভোজ্য তেল এবং গম আমদানীর জন্য এই ঋণ সমূহ বিতরণ করা হয়। লেটার অব গ্যারান্টি এবং ট্রাস্ট রিসিটের বিপরীতে আমদানি পণ্য ছাড় করে নিলেও নুরজাহান গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের টাকা ফেরত দেয়নি। ২০১৩/২০১৪ সাল থেকে বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান খেলাপি ঋণ আদায়ে মামলা করলেও ঋণ আদায় করতে পারেনি। আদালতসূত্র আরো জানায়, বিভিন্ন মামলার সাজা এবং গ্রেপ্তারি পরওয়ানা নিয়ে রতন এবং তার অপর ৩ ভাই দীর্ঘ দিন ধরে আত্মগোপনে ছিলেন। জহির আহমেদের স্ত্রী এবং সন্তানেরা ২০১২ সাল থেকে কানাডায় বসবাস করলেও অর্থঋণ আদালতের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার ফলে রতন দেশত্যাগ করতে পারেননি। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য গত বছরের ১৫ জানুয়ারি পুলিশের আইজি বরাবর আদেশের কপি পাঠানো হয়।