৬৭ টাকার স্যালাইন ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা

হাসান আকবর | বৃহস্পতিবার , ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৪:৪৪ পূর্বাহ্ণ

স্যালাইনের সংকট তৈরি করে অল্প ক’দিনের মধ্যেই কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সংঘবদ্ধ একটি চক্র। টাকা দিয়েও স্যালাইন না পাওয়ার পরিস্থিতি বিরাজ করছে চট্টগ্রামে। ৬৭ টাকার স্যালাইন বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা দরে। তাও নগরীর বহু অলি গলি ঘুরে এক একটি স্যালাইন যোগাড় করতে হচ্ছে। ডেঙ্গুর প্রসারের সুযোগ নিয়ে ওষুধ কোম্পানিসহ সংশ্লিষ্ট চক্র স্যালাইন নিয়ে কারসাজি শুরু করে। এতে করে শুধু ডেঙ্গু রোগীই নয়, একই সাথে সার্জারি, সিজার, ডায়ালাইসিসসহ বিভিন্ন রোগীকে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

সূত্র জানিয়েছে, দেশে স্যালাইনের ব্যবহার ব্যাপক। বিভিন্ন অপারেশন, ডায়ালাইসিস এবং সিজারে স্যালাইন ব্যবহৃত হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় স্যালাইনের ব্যাপক ব্যবহার সংঘবদ্ধ চক্রকে বিরাট এক সুযোগ এনে দেয়। ডেঙ্গু রোগীর রক্তের ঘনত্ব ঠিকঠাক রাখার জন্য স্যালাইন প্রদান করা হয়। গত মাস দুয়েক ধরে দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার ঘটে। আর এই সুযোগে দেশব্যাপী স্যালাইনের সংকট তৈরি হয়।

দেশে একাধিক ওষুধ কোম্পানি স্যালাইন উৎপাদন করে। সাধারণ এসব স্যালাইনের বাজার মূল্যও খুব বেশি নয়। আধা লিটার স্যালাইন ৪৫/৫০ টাকা এবং এক লিটারের স্যালাইন ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হতো। স্যালাইনের গায়ে এই মূল্য আরো কম লেখা রয়েছে। কিন্তু ডেঙ্গুর রোগের বিস্তারে হঠাৎ করে এই স্যালাইনের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। এক লিটার স্যালাইন ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। টাকা দিয়েও স্যালাইন পাওয়া যাচ্ছে না ফার্মেসিগুলোতে। গতকাল একাধিক রোগীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাজারের কোথাও স্যালাইন নেই। টাকা দিয়েও স্যালাইন পাওয়া যাচ্ছে না।

মোহাম্মদ শিপলু নামের একজন ব্যবসায়ী গতকাল দৈনিক আজাদীকে জানান, আগ্রাবাদ থেকে শুরু করে মেডিকেলের সামনে পর্যন্ত শত শত ফার্মেসি ঘুরেও একটি স্যালাইন পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে হাজারী গলিতে একটি দোকান থেকে পরিচিত জনের মাধ্যমে ৪০০ টাকায় একটি স্যালাইন যোগাড় করা হয়েছে। শুধু ডেঙ্গু রোগীই নয়, হাসপাতালে শত শত রোগী একটি স্যালাইনের জন্য হাহাকার করছে। রোগীর স্বজনেরা হাজার হাজার টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়েও স্যালাইন যোগাড় করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

একাধিক ফার্মেসি মালিকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ওষুধ কোম্পানিগুলো স্যালাইন সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ১০০টি স্যালাইন চাইলে ৫ থেকে ১০টি দিচ্ছে। তাও আবার শর্ত হিসেবে ওরস্যালাইন কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। এসব কোম্পানির ওরস্যালাইনের কিনলেই কেবল ৫/১০টি সাধারণ স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে এসব কোম্পানির উৎপাদিত ওরস্যালাইনের কোন চাহিদাই বাজারে নেই। এগুলো বিক্রিও হয় না। ওরস্যালাইন না কেনায় আমাদেরকে সাধারণ স্যালাইন দেয়া হচ্ছে না। কেউ কেউ বিক্রি হবে না জেনেও ওরস্যালাইন কিনে বাড়তি দরে সাধারণ স্যালাইন বিক্রি করে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছে। যারা ওরস্যালাইন কিনছে না কোম্পানি তাদের সাধারণ স্যালাইন দিচ্ছে না। ফলে নগরীর শত শত ফার্মেসিতে সাধারণ স্যালাইনের এক কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে।

নগরীর বেসরকারি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসাধীন শত শত রোগী স্যালাইন পাচ্ছে না। একটি বেসরকারি হাসপাতালের ফার্মেসির একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রচুর দামে স্যালাইন বিক্রি হচ্ছে। একেবারে অনৈতিকভাবে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে টাকা। আমরা হাজারীগলি থেকে ৩৫০/৪০০ টাকায় স্যালাইন কিনে এনে ১০/২০ টাকা মুনাফায় তা বিক্রি করতে পারি। এতে আমাদের রোগীদের সুবিধা হতো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হলে বাড়তি দাম নেয়ার অভিযোগ আনা হবে আমাদের বিরুদ্ধে। এতে আমাদের হাসপাতালেরই সুনাম ক্ষুণ্ন হবে। তাই আমরা স্যালাইন রাখতে পারছি না। কোম্পানি থেকেও আমাদেরকে স্যালাইন সরবরাহ একেবারে কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। আসার সাথে সাথে তা শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্যালাইনের কোন স্টক নেই এবং পরিস্থিতি খুবই নাজুক বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা জানান।

গতকাল আগ্রাবাদ, খুলশী, ওমেন কলেজ মোড়, জিইসি মোড়, মেডিকেলের সামনে অসংখ্য দোকানে খোঁজ করে কোন স্যালাইন পাওয়া যায়নি। কোন কোন ফার্মেসিতে অনেকটা চোরাই মালের মতো গোপনে এবং ফিসফাস করে স্যালাইন বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতি লিটার স্যালাইনের জন্য হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা।

সংশ্লিষ্ট একটি ওষুধ কোম্পানির চট্টগ্রামের এরিয়া ম্যানেজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা নির্দিষ্ট এবং আমরা স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন করতে পারছি। কিন্তু বাজারে চাহিদা বেড়ে গেছে ১০ গুনেরও বেশি। এতে করে একটি সংকট তৈরি হয়েছে। ওষুধ ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ সুযোগ নিচ্ছে বলেও তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, চড়া দামে স্যালাইন বিক্রি করার পেছনে কোম্পানির কোন হাত নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

স্যালাইন সংকটের সমাধান করতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে। একাধিক ফার্মেসিকে জরিমানাও করা হয়। অভিযান পরিচালনাকারী জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত গতরাতে দৈনিক আজাদীকে জানান, আমরা অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন ফার্মেসিতে স্যালাইন পেয়েছি। বাজারে স্যালাইন আছে। আমরা গেলে তারা স্যালাইন আছে বলে জানায়। এতে করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের আর কিছু করার থাকে না। তবে আমরা অভিযোগ পেয়েছি যে, সাধারণ ক্রেতারা গেলে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে না, আবার বাড়তি দাম দিলে স্যালাইন দিচ্ছে। বিষয়টি দুঃখজনক বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. ইলিয়াস চৌধুরী সরকারি হাসপাতালে স্যালাইনের কোন সংকট নেই বলে উল্লেখ করে বলেন, সরকারি সব হাসপাতালেই সব ধরণের স্যালাইন আছে। ওষুধের দোকানদারেরা কৃত্রিম একটি সংকট সৃষ্টি করে মানুষের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। তিনি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলেই প্রয়োজনীয় সব স্যালাইন হাসপাতাল থেকে দেয়া হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, স্যালাইন নিয়ে বাজারে যা চলছে তা আমরা জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি। প্রশাসন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। কৃত্রিম এই সংকট থাকবে না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপর্যটক বরণে প্রস্তুত কক্সবাজারের আইকনিক স্টেশন
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়া একসাথে কাজ করতে সম্মত