৬০ শতাংশ টেক্সির রেজিস্ট্রেশন নেই!

চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়ক গণপরিবহনের দাবি

জগলুল হুদা, রাঙ্গুনিয়া | শনিবার , ৪ মে, ২০২৪ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামকাপ্তাই সড়কে রেজিস্ট্রেশনবিহীন টেক্সির দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। ২০ ফুট প্রস্থের এই সড়কে প্রতিদিন অন্তত ১০ হাজারের অধিক সিএনজিচালিত টেক্সি চলাচল করে। জানা যায়, ৬০ শতাংশ গাড়িই রেজিস্ট্রেশনবিহীন অবৈধ এবং ৭০ ভাগ চালকেরই নেই কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স। ফলে এসব ট্যাক্সির কারণে কাপ্তাই সড়কে যেমন নিত্য যানজট লেগে থাকে তেমনি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে আশংকাজনক হারে।

জানা যায়, সংশ্লিষ্টদের তদারকির অভাবে বাড়ছে অবৈধ ট্যাক্সির সংখ্যা। আবার বিভিন্ন টোকেন বাণিজ্যের কারণে লাইসেন্স নিতেও আগ্রহী নন এসব গাড়ির চালকরা। অবৈধ এসব গাড়ির চলাচল বন্ধসহ সড়কে কঠোর মনিটরিংয়ের দাবি যাত্রী সাধারণের।

সূত্র জানায়, চট্টগ্রামকাপ্তাই সড়কে প্রতিদিন রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, হাটহাজারী উপজেলা ও কাপ্তাইসহ আশেপাশের উপজেলার লাখ লাখ যাত্রী চলাচল করে। যাত্রীবাহী লোকাল বাস চালু থাকলেও ২০০৯ সালের দিকে তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে স্বল্প দূরত্বে চলাচল করা যাত্রীদের ভরসা টেক্সি। সড়কে ট্রাফিক পুলিশ মাঝেমধ্যে মোবাইল কোর্ট চালালেও তা নিয়মিত নয়। আবার ট্যাক্সি সংগঠনের মাধ্যমে মাসিক টোকেন নিলেই গাড়ি চালাতে আর রেজিস্ট্রেশন কিংবা চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রয়োজন হয় না। গাড়ির ডকুমেন্টস থাকুক আর না থাকুক নির্ধারিত অর্থ প্রদান করা অনেক ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক বলে জানান চালকরা। চট্টগ্রাম রাস্তারমাথা থেকে রাঙ্গুনিয়ার লিচুবাগান পর্যন্ত ১৫টি সিএনজি অটোরিকশা সংগঠন রয়েছে। এসব সংগঠনের অধীনে ১০ হাজারের বেশি ট্যাক্সি রাখার জন্য নির্ধারিত কোনো জায়গা নেই। ফলে প্রতিটি স্টেশনে সড়কের দুই পাশ দখল করে রাখা হয় গাড়িগুলো।

সরেজমিনে দেখা গেছে, স্বল্পদূরত্বের যাত্রীরা চলাচল করছেন টেক্সি ও ব্যাটারি রিকশায়। ট্যাক্সিতে যাত্রী পরিবহন করা হয় পাঁচজন করে। অনেক সময় অতিরিক্ত আরও একজন যাত্রী বামপাশে ঝুলিয়ে নেওয়া হয়, সাথে পণ্যও পরিবহন করা হচ্ছে। অদক্ষ চালকরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চালাচ্ছে এসব গাড়ি। যত্রতত্র যাত্রী উঠানামা, যেখানে সেখানে গাড়ি থামানো, আবার চলার সময় লাইন না মেনে উল্টো লাইনে গাড়ি চালানো কিংবা প্রতিযোগিতা করে ওভারটেকিং এই সড়কের অদক্ষ চালকদের গাড়ি চালানোর নিত্য দৃশ্য বলে জানান স্থানীয়রা।

রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, হাটহাজারী, কাপ্তাই ও চান্দগাঁও থানার তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রামকাপ্তাই সড়কে গত এক বছরে অন্তত ৭০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছে ৩০ জন। আহত হয়েছেন শতাধিক যাত্রী। শুধুমাত্র গত চার মাসে এ সড়কে ১০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছেন ৬ জন। আহত হয়েছেন ২০ জন।

নোয়াপাড়া অটোরিকশাচালক সমিতির সভাপতি মো. সেকান্দর জানান, তাদের ৪০০টি গাড়ি রয়েছে। এরমধ্যে অর্ধেকের বেশি গাড়ির নাম্বার রয়েছে বলে তার দাবি। লাইসেন্স আছে শতকরা ৬০ জনের বেশি। রাস্তারমাথা গেলে তাদের মাসিক নির্ধারিত হারে টাকার বিনিময়ে টোকেন নিয়ে যেতে হয়।

চন্দ্রঘোনা লিচুবাগান সিএনজিচালক সমবায় সমিতির সভাপতি মো. ইয়াকুব আলী জানান, তাদের ৬০০ নিবন্ধিত গাড়ি রয়েছে। সমিতির নিবন্ধন ছাড়া আছে আরও ১০০ গাড়ি। অর্ধেকের বেশি গাড়িতে ডকুমেন্টস আছে এবং ৫০ শতাংশ চালকের লাইসেন্স নেই বলে জানান তিনি।

মরিয়মনগর চৌমুহনী সিএনজি অটোরিকশা সমিতির সভাপতি আবদুল মোনাফ বলেন, তাদের সংগঠনের রয়েছে অন্তত ৫০০টি গাড়ি। বেশিরভাগ গাড়ি নাম্বরওয়ালা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডকুমেন্টস হালনাগাদ নেই। কিছু অন টেস্ট গাড়িও আছে। তিনভাগের দুই ভাগ চালকের লাইসেন্স নেই। কারণ লাইসেন্স করতে জটিলতা বেশি। অশিক্ষিত চালকরা ইন্টারভিউ দিতেও ভয় পায়। তবে চালকদের নিয়মিত সভাসমাবেশে সচেতন করা হয় বলে জানান তিনি।

এই সড়কের যাত্রীদের অভিযোগ, অদক্ষ চালক ও অবৈধ টেক্সি চট্টগ্রামকাপ্তাই সড়কের যন্ত্রণা হয়ে উঠেছে। রাঙ্গুনিয়ার রোয়াজারহাট এলাকার ব্যবসায়ী মো. নাছির উদ্দিন জানান, সড়কে একসময় বাস চলাচল ছিল। তখন সড়কে এতো গাড়ির চাপ ছিলো না। চন্দ্রঘোনার কদমতলী গ্রামের বাসিন্দা মো. রেজাউল করিম বলেন, নানা কাজে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়, এতে সড়কে সিএনজি অটোরিকশাই একমাত্র ভরসা। আগে লোকাল বাস, টেম্পোসহ অনেক ধরনের গণপরিবহন ছিলো। এতে ভাড়াও ছিল কম, চলাচলও ছিল নিরাপদ। মো. সুমন নামে এক ব্যাংকার বলেন, কাপ্তাই সড়কে গণপরিবহন না থাকায় সিএনজি অটোরিকশায় ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। এসব গাড়ির বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চালায় অদক্ষ চালকরা। তারা কে কার আগে যাবে, কে কাকে অতিক্রম করবে, এই প্রতিযোগিতায় দুর্ঘটনা হয়।

রাঙ্গুনিয়ার রোয়াজারহাট অটোরিকশা সমবায় সমিতির সভাপতি নুরুল ইসলাম মনু বলেন, প্রশিক্ষিত চালক ও বৈধ গাড়ি নিশ্চিত করা গেলে এই সড়কে দুর্ঘটনা কমবে। এক্ষেত্রে প্রশাসন উদ্যোগ নিলে আমরা সাহায্য করবো।

লোকাল বাস সার্ভিস বন্ধ করা প্রসঙ্গে জেলা পরিবহন বাস ও মিনিবাস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, ২০০৮ সাল থেকেই লোকাল বাসে যাত্রী কমতে থাকে। তখন হাতেগোনা কয়েকজন যাত্রী পাওয়া যেত। দিনদিন লোকসান বাড়ায় মালিকরা লোকাল বাস চলাচল বন্ধ করে দেন। এখন এবি ট্রাভেলস ও শাহ আমানত নামে দুটি স্পেশাল সার্ভিসের পাশাপাশি বিরতিহীন বাস চলছে কাপ্তাই সড়কে।

সড়ক ও জনপদ বিভাগের ওয়ার্ক সুপারভাইজার রাসেল দেওয়ান জানান, সড়কটি ২০ ফুট প্রস্থ। কিন্তু সড়কের অনেক অংশ দখল হয়ে নানা স্থাপনা হওয়ায় সড়কটি দিনদিন বিশৃক্সখল হয়ে ওঠছে, ফলে বাড়ছে দুর্ঘটনা। তবে খুব সম্প্রতি সড়কটি চারটি পর্যায়ে প্রশস্থ করা হবে। এতে দুই লাইনের সড়কে উন্নীত করা হবে প্রথম পর্যায়ে রাস্তারমাথা থেকে মদুনাঘাট, এরপর পর্যায়ক্রমে মদুনাঘাট থেকে ধরেরটেক, সেখান থেকে গোডাউন এবং সর্বশেষ গোডাউন থেকে চন্দ্রঘোনা পর্যন্ত দুই লাইনের সড়কে উন্নীত করতে কাজ চলছে বলে তিনি জানান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের এক কর্মকর্তা জানান, একটি গাড়ি রেজিস্ট্রেশনবিহীন কিংবা নাম্বার না থাকলে ৫০ হাজার টাকা এবং চালকের লাইসেন্স না থাকলে ২৫০০০ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। কঠোর তদারকির মাধ্যমে সড়কে অবৈধ যানবাহান চলাচল বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে বলে এই কর্মকর্তা জানান।

এ ব্যাপারে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রায়হান মেহেবুব বলেন, স্বল্পদূরত্বে চলাচলের জন্য বাস না থাকায় বিপাকে পড়ছেন সাধারণ যাত্রীরা। ফলে বেড়েছে সিএনজি ও ব্যাটারি রিকশা এবং অদক্ষ চালকের সংখ্যা। তবে এসবের বিরুদ্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে তিনি জানান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ২৫ জেলায় আজ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছুটি
পরবর্তী নিবন্ধকিশোর গ্যাং দমাতে তিন উপায়ের কথা ভাবছে পুলিশ