৫৮ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সমাবর্তন মাত্র ৪ বার, প্রাপ্তিও কম নয়

চবি প্রতিনিধি | শনিবার , ১৮ নভেম্বর, ২০২৩ at ৫:২৬ পূর্বাহ্ণ

শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে গড়ে ওঠা এই ক্যাম্পাসজুড়ে যেন এক মৌনতা। সকালে শাটলের আওয়াজে ঘুম ভাঙে এ ক্যাম্পাসের। শাটলের বুকেপিঠে চড়ে ক্যাম্পাসের পথে পা বাড়ায় হাজারো শিক্ষার্থী। তেমনই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা মোহনীয় এক ক্যাম্পাসের নাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। পুরো ক্যাম্পাস যেন সবুজের সৌন্দর্যে মোড়ানো। ক্যাম্পাসের বাঁকে বাঁকে রয়েছে জীববৈচিত্র্যের বিশাল সমাহার।

প্রায় পৌনে ঘন্টার জার্নি শেষে শিক্ষার্থীরা শাটল থেকে নামতেই যেন আড়মোড়া ভাঙে ক্যাম্পাসের। মৌনতা ভেঙে যেন প্রাণ ফিরে আসে ক্যাম্পাসজুড়ে। নির্জীবনীরব ক্যাম্পাস নিমিষেই যেন প্রাণ ফিরে পায়। ভরে যায় লোকারণ্যে। দেশের তো বটে, সারা বিশ্বে বতর্মানে একমাত্র শাটলের ক্যাম্পাস হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে সবুজ ঘেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়। হাটহাজারীর ফতেপুরের জোবরা গ্রামে পাহাড়ঘেরা ২৩শ একর সমতল ও উঁচুনিচু পাহাড়ি ভূমিতে ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়।

জানা যায়, মাত্র চারটি (বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও অর্থনীতি) বিভাগে ২০৪ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের। যাত্রালগ্নে শিক্ষক ছিলেন হাতেগোনা ৮ জন। প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পান প্রফেসর ড. আজিজুর রহমান (এ আর) মল্লিক। তবে হাঁটি হাঁটি পা পা করে ৫৭ বছর শেষ করে ৫৮ বছরে পদার্পণ করছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। যাত্রালগ্নের চারটি বিভাগের স্থলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ৯টি অনুষদের অধীনে ৪৮টি বিভাগ রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে ৬টি ইনস্টিটিউট, ৫টি গবেষণা কেন্দ্র, অধিভুক্ত অনুষদ ১টি, অধিভুক্ত ইনস্টিটিউট ১টি এবং অধিভুক্ত কলেজ রয়েছে ২৫টি। মোট শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ২৮ হাজার। মোট শিক্ষক রয়েছেন প্রায় এক হাজার জন। কর্মকর্তা কর্মচারী রয়েছেন ২ হাজারের বেশি।

শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে ১৪টি আবাসিক হল। এর মধ্যে ৯টি ছাত্রদের এবং ৫টি ছাত্রীদের। রয়েছে একটি হোস্টেল। অন্যদিকে চট্টগ্রাম শহরের বাদশা মিয়া সড়কে অবস্থিত চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি ছাত্রাবাস রয়েছে। সবমিলিয়ে প্রায় ৭ হাজার শিক্ষার্থী এসব হলে থাকার সুযোগ পাচ্ছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিভিন্ন বাসা ও কটেজে থাকছে প্রায় ৮ হাজার শিক্ষার্থী। বাকি সিংহভাগ শিক্ষার্থী শহরের বিভিন্ন বাসা ও মেসে থেকে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। শহরে থাকা এসকল শিক্ষার্থীর যাতায়াতের সুবিধার্থে একজোড়া শাটল ট্রেন দিনে সাত বার আসাযাওয়া করে ক্যাম্পাসে।

ক্যাম্পাসে আসাযাওয়ার পথে পুরোটা সময়জুড়ে গানেগানে মুখর থাকে শাটলের সবকয়টি বগি। এটাকে বলা হয় চলন্ত ক্যাম্পাস। দিনের পর দিন বগি চাপড়িয়ে গানেগানে শাটল মাতিয়ে রাখেন শিক্ষার্থীরাই। রকর‌্যাপের পাশাপাশি জারিসারি, ভাটিয়ালি, প্যারোডি, পাহাড়ি ও বাংলা সিনেমার গানসহ এমন কোন গান হয়তো বাদ নেই, যা শাটলে গাওয়া হয়না। এ শাটলে বগি চাপড়িয়ে গান গেয়ে ইতোমধ্যে দেশবরেণ্য তারকার খেতাবও কুড়িয়েছেন অনেকেই। এর মধ্যে রয়েছেন কণ্ঠশিল্পী নকিব খান, পার্থ বড়ুয়া ও এস আই টুটুলের মতো দেশ বরেণ্য শিল্পীর নাম। বিভিন্ন রকম ছড়া, কবিতা, গান আর আড্ডায় মুখোরিত থাকে শাটল ট্রেন। শিক্ষার্থীদের আবেগের মিশেলে এটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গী হিসেবে পরিণত হয়েছে।

সময়ের পালাবদলে ৫৮ বছরে পা রাখতে যাচ্ছে এই বিদ্যাপীঠ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে উচ্চশিক্ষার পঠনপাঠনের পাশাপাশি অসংখ্য শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদসহ সচেতন মানুষ তৈরি করে দেশের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখছে এই প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ ৫৭ বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি করেছে অনেক রথীমহারথীর। বিশ্বখ্যাত ভৌত বিজ্ঞানী প্রফেসর ইমিরেটাস জামাল নজরুল ইসলাম এর মধ্যে অন্যতম। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। ছাত্রজীবনে তিনি বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংসহ অনেকের সান্নিধ্যে ছিলেন। জামাল নজরুলের অনেক গ্রন্থ আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। বিশ্বের খ্যাতনামা বেশকয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসেও তাঁর গ্রন্থগুলো পাঠ্যক্রম হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছে।

এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৭ বছরে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন হয়েছে মাত্র ছয়বার। প্রথম চাকসু নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালে এবং প্রথম ভিপি নির্বাচিত হন মোহাম্মদ ইব্রাহিম এবং জিএস আবদুর রব। সর্বশেষ চাকসু নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। তখন ভিপি নির্বাচিত হন তৎকালীন ছাত্রদল নেতা নাজিম উদ্দিন, জিএস নির্বাচিত হন আজিম উদ্দিন ও এজিএস নির্বাচিত হন মাহবুবুর রহমান শামীম। ওই কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিল ২৭ জন। একই বছর ডিসেম্বরে নির্বাচনে হেরে যাওয়াকে কেন্দ্র করে ছাত্র ঐক্যের নেতা ফারুকুজ্জামান খুন হয়। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে চাকসুর সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় তৎকালীন প্রসাশন। বন্ধ হয়ে যায় চাকসুর হল সংসদের কার্যক্রমও। ৩৩ বছর পার হয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত হয়নি চাকসু নির্বাচন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংগঠন চাকসু নির্বাচনের দাবি তুললেও প্রসাশনের সদিচ্ছার অভাবে নির্বাচন হয়নি বলে দাবি সাধারণ শিক্ষার্থীদের। তাদের দাবি ভিপি আর জিএসসহ পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধি পদাধিকার বলে সিনেট মেম্বার। শিক্ষার্থীদের জন্য কষ্টসাধ্য কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হলে তারা বাদ সাধতে পারেন। তাছাড়া সরকারের সদিচ্ছা না থাকলেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্ভব নয় বলে দাবি অনেকের।

জানা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রালগ্নে প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পান প্রফেসর ড. আজিজুর রহমান (এ আর) মল্লিক। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮তম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার।

৫৭ বছরে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র চারবার। নিয়মিত সমাবর্তন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জিত ডিগ্রির সনদ আনুষ্ঠানিকভাবে হাতে নেওয়ার সুযোগও হচ্ছে না অনেক শিক্ষার্থীর। এ নিয়ে আক্ষেপ জানিয়েছে সাবেক শিক্ষার্থীরা।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আজ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সকালে আনন্দ শোভাযাত্রা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চত্ত্বরে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার। এরপর বিকালে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিনব্যাপী অনুষ্ঠান শেষ হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে আঘাত হানেনি মিধিলি
পরবর্তী নিবন্ধজেয়ার-ভাটার সময়সূচি