৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও ভোলা যায় না কলেজ জীবনের স্মৃতি

ওমর কায়সার | রবিবার , ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৭:২০ পূর্বাহ্ণ

স্কুল জীবনের ছোট পরিসর পেরিয়ে ওরা কলেজের বড় আঙিনায় পা রেখেছিলেন ১৯৭৫ সালে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা নতুন মুখের সঙ্গে পরিচয়। তারপর বন্ধুতা। এরপর মহাকালের গর্ভে অর্ধ শতাব্দী কাল কেটে গেল। কিন্তু সেই বন্ধুতায় মরচে ধরেনি। ক্ষয়ে যায়নি ভালোবাসা। মুছে যায়নি স্মৃতি। দুটো বছর তারা একসঙ্গে কাটিয়েছে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কলেজে। ১৯৭৭ সালে এইচ এস সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে দেশের নানা প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছেন। শিক্ষাজীবন শেষে নানা পেশায় জড়িত হয়ে কীর্তিমান মানুষগুলো যে যার ক্ষেত্রে হয়েছেন খ্যাতিমান। ছড়িয়ে পড়েছেন দেশবিদেশের নানা স্থানে। নিজের ক্যারিয়ার গড়েছেন, পাশাপাশি দেশকেও দিয়েছেন। কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে পার করে দিলেন অনেকটা বছর। কিন্তু তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে ভরা সেই দিনগুলো সজীব রয়ে গেল মনের ভেতর। তাই জীবনের অপরাহ্ন বেলায় যখন নিজের পেশাগত কাজের চাপ কমেছে, যখন উত্তরসূরীর কাঁধে সংসারের দায় চেপেছে, তখন ভেতরে সুপ্ত সত্তর দশকের সেই প্রাণ জেগে উঠেছে। ওরা খুঁজে নিলেন কে কোথায় আছে। দেখা গেল চট্টগ্রাম কলেজের ১৯৭৭ সালের এইচ এস সি ব্যাচের পরীক্ষার্থীরা এখন বিখ্যাত চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিল্পপতি, অধ্যাপক, ব্যবসায়ী, সৈনিক, নাবিক, আমলা, গায়ক, শিল্পী, কথাসাহিত্যিক, কবি এবং সাংবাদিক। এখন জীবনের অবসর বেলায় তারা ঐক্যবদ্ধ হলেন কিছু একটা করার প্রেরণায়। তারা এই পুনর্মিলনের নাম দিয়েছেন ভালোবাসার ’৭৭। এই নামে সংগঠিত হয়ে নিজেদের নিয়োজিত করলেন চিকিৎসা, বৃত্তি প্রদান, বানভাসিদের পাশে দাাঁড়ানো সহ নানা সেবামূলক কাজে।

২০২৫ সালে এসে বন্ধুতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে তারা এক হয়েছেন কক্সবাজারে পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকতে। ১০, ১১, ও ১২ জানুয়ারি তিনদিন নানা আয়োজনে মাতিয়ে রেখেছেন তারা সৈকত নগরী। আয়োজকদের অন্যতম একজন নৌ প্রকৌশলী এস. এম এ. হান্নান, বলেন, এবারের আয়োজনটা বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে, কারণ এ বছর আমাদের বন্ধুতার ৫০ বছর পার হয়েছে। বয়স যত বাড়ছে, আমাদের তারুণ্য তত বাড়ছে। যৌবনের শক্তি, কাজের প্রেরণা আমরা ধরে রেখে প্রচলিত ধারণাকে ম্লান করে দিতে চাই।’

ভালোবাসার ৭৭ এর অন্যতম বন্ধু দেশবরণ্য কণ্ঠশিল্পী নকীব খান বলেন, চট্টগ্রাম কলেজের দিনগুলো ছিল অসামান্য সৃজনশীল এক সময়। জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি আমরা মগ্ন ছিলাম সৃষ্টিশীল কাজে। তখন অনেক বিখ্যাত গান রচিত হয়েছে চট্টগ্রাম কলেজে। সোলস এবং কুমার বিশ্বজিতের গাওয়া গান ‘তোরে পুতুলের মতো সাজিয়ে’ গানটি শ্রেণিকক্ষেই বসে লিখেছে আমাদের বন্ধু আবদুল্লাহ আল মামুন। ‘এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে’ এর মতো বিখ্যাত গানটিও ওই সময়ে সে লিখেছিল। আমাদের অনেক বন্ধু সেই অল্প বয়সে ছড়া, কবিতা লিখে দেশ জোড়া নাম কুড়িয়েছে। তাই সেই সেরা দিনগুলোকে স্মরণ করতে কক্সবাজার এসেছি।’ তিনদিনের আয়োজনের দ্বিতীয় দিন নকিব খান গান পরিবেশন করে মাতিয়ে রেখেছিলেন সবাইকে। নকিবের গানের মায়ায় তারা যেন অলৌকিক সময়যন্ত্রে পৌঁছে গেল সেই সময়ের চট্টগ্রাম কলেজের ক্যাম্পাসে।

বন্ধুতার টানে কানাডা থেকে চলে এসেছেন মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন, যুক্তরাষ্টের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে এসেছেন রাফি চৌধুরী, আজম চৌধুরী, ওয়াজিউল্লাহ্‌ লিটন, আবুল মনসুর খান, মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছিলেন খোরশেদ আলম। তারা জানালেন,‘ হাজারো মাইল পাড়ি দিয়ে এসে মনে হলো নিজের জীবনটাকে ফিরে পেলাম।’

আয়োজকদের অন্যতম নজমুল আলম চৌধুরী জানালেন, তিনদিনের কক্সবাজার ভ্রমণটাকে উপভোগ্য ও বন্ধুতার সুবর্ণ জয়ন্তীকে স্মরণীয় করতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও, সৈকতে নানা ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। মেজবানেরও ব্যবস্থা ছিল। আমাদের বন্ধুরাই এসব আয়োজনের স্পন্সর করেছেন। ইনানি সৈকতের কাছে পাহাড়ের পাদদেশে ঘনগাছপালা বেষ্টিত একটি চিংড়ি হ্যাচারিতে ৭৭এর বন্ধুদের জন্য মেজবানের আয়োজন করেছেন কবি জয়নুল আবেদীন মুকুল। তিনি বললেন, যখন তরুণ ছিলাম, তখন বন্ধুদের গুরুত্ব বুঝতে পারিনি। এখন বুঝতে পারছি। এরকম একটা আয়োজনে বন্ধুদের জন্য কিছু করতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। দুপুরের সেই আয়োজনের আগে হ্যাচারির মাঠে ফুটবল নিয়ে মাতামাতি করে হৈচৈ বাঁধিয়ে দেন ষাটোর্ধ এইসব তরুণ। মুকুলের মতো একই অনুভূতি ও আনন্দ প্রকাশ করলেন ব্যাংকার লেখক আমীরুল ইসলাম, প্রখ্যাত ই এনটি বিশেষজ্ঞ ডা. এম আলমগীর চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক ফেরদৌস হাসান রানা, অধ্যক্ষ মো. আবুল হাসান, ডা. নজিবুন নাহার, মেজর ( অবঃ) আসলাম হায়দার, প্রকৌশলী কাজী ইয়াকুব সিরাজ উদ দৌলা, এনামুল হক, শেলী বড়ুয়া, নিলুফার শিরিন নিলু, নীলা দত্ত, কণ্ঠশিল্পী মালবিকা নন্দী জবা, রায়হান মজিদ ওয়াহেদী, রুহ আফরোজ সালমা, হামিদুল হক চৌধুরী, ব্যাংকার সোহেল খান, বনানাী হোড় প্রমুখ।

তিনদিনের আয়োজনে নানা কাজে সর্বক্ষণ ব্যস্ত ছিলেন কবি কামরুল হাসান হারুন, হাবীবুল মুহিত, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন, নজমুল হক, মনজুরুল ইসলামসহ আরো অনেকে।

ভালোবাসার ৭৭ এর আরেক সতীর্থ শিল্পপতি শাহাবুদ্দীন আলম বলেন, ইতিমধ্যে অনেক বন্ধুকে আমরা হারিয়েছি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কার কখন ডাক আসে ঠিক নেই। এমন একটি পর্যায়ে এই সম্মিলন আমাদের কাছে সঞ্জীবনীর মতো।

প্রাণময় এই সম্মিলনে গিয়ে মনে হলো মানুষ নানা কারণে নানা পেশায়, জড়িত হয়, নিজের সীমানা পেরিয়ে চলে যায় দূর দূরান্তে। কিন্তু তার ভিত্তিটা গড়ে ওঠে তারুণ্যের সময়। তার পরিসর যতই বড় হোক, কেন্দ্র কিন্তু সেই তারুণ্যের বেলা। এই জন্যই ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও কলেজের জীবনটাকে তারা ভুলতে পারে না।

১১ জানুয়ারি শনিবার পৌষের বিকেলে সৈকতে দাঁড়িয়ে অ্যাডভোকেট এ টি এম আফতাব উদ্দীন বললেন, জীবিকার তাগিদে আমরা এতদিন কে কোথায় ছিটকে গিয়েছিলাম। এখন সমুদ্রের পাড়ে এসে মহাজীবনের স্বাদ অনুভব করছি। প্রিয়মুখগুলোর সঙ্গে তিনটা দিন কাটালাম। এমন সুযোগ জীবনে সবসময় আসে না।’তখন কুয়াশার আকাশ থেকে পশ্চিম দিকে হেলে পড়া সূর্যটা লাল আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। যেন মনে হলো বিস্মৃতির অতল থেকে কেউ যেন মায়ার আলো বিলিয়ে দিল। সে আলোয় উদ্ভাসিত জীবনের প্রান্তে আসা কিছু মানুষ । তাদের প্রাণখোলা হাসি ছড়িয়ে গেল ঝাউবনের শাখায় শাখায়। তাদের উল্লাসে তোলপাড় হয়ে সমুদ্রের ঢেউ বার বার আছড়ে পড়ছে বালুকাবেলায়।

লেখক : কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ