নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় আগামী তিন মাসের মধ্যে বিভাগীয় সম্মেলন এবং নারী সংস্কার কমিশন বাতিলসহ চার দফা দাবিতে আগামী ২৩ মে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসমাবেশে নতুন এই দুই কর্মসূচি ঘোষণা করেন সংগঠনটির মহাসচিব সাজিদুর রহমান। তিনি বলেন, নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় আগামী তিন মাসের মধ্যে বিভাগীয় সম্মেলন করা হবে। এছাড়া আগামী ২৩ মে বাদ জুমা চার দফা দাবিতে দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হবে। হেফাজতের চার দাবি হচ্ছে– নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন ও এর প্রতিবেদন বাতিল করা; সংবিধানে বহুত্বদের প্রস্তাব বাতিল আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহাল করা; হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলা প্রত্যাহার ও শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডসহ সব গণহত্যার বিচার করা; ফিলিস্তিন ও ভারতে মুসলিম গণহত্যা ও নিপীড়ন বন্ধে সরকারের ভূমিকা রাখা। খবর বিডিনিউজ ও বাংলানিউজের।
এর আগে ১২ দফা ঘোষণাপত্র পাঠ করেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নায়েবে আমির মাওলানা মাহফুজুল হক। ঘোষণাপত্রের প্রথম দফাতে নারী সংস্কার কমিশন ও প্রতিবেদন বাতিলের পাশাপাশি আলেম ও নারী প্রতিনিধি নিয়ে নতুন কমিশন গঠনের দাবি করা হয়। বাকি দফাগুলো হলো– সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন ও বহুত্ববাদ বাদ দিতে হবে। শাপলা ও জুলাই গণহত্যার বিচারে ট্রাইব্যুনালের গতি আনতে হবে, নির্বাচনের আগে বিচার করতে হবে। আওয়ামী লীগের বিচার ও তৎপরতা নিষিদ্ধ করতে হবে। চট্টগ্রামে উগ্র হিন্দুত্ববাদের হাতে নিহত সাইফুলের হত্যাকারীদের বিচার করতে হবে। শেখ হাসিনার আমলে দায়ের করা সব রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার ও যারা গুম–খুন করেছে তাদের বিচার করতে হবে। গাজায় হামলা নিয়ে সরকারের অবস্থান ও ভূমিকা রাখতে হবে। প্রাইমারি থেকে সর্বোচ্চ পর্যন্ত ইসলাম শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। মানবিক করিডরের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলে ভিনদেশিদের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে এবং কাদিয়ানীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে।
সংগঠনের নায়েবে আমির আহমদ আবদুল কাদের বলেন, আমাদের দাবি স্পষ্ট, আমরা মুসলিমদের পক্ষ থেকে দাবি করছি, যে নারী সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে, তা অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। রাখাইনে মানবিক করিডোর দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, দেশের জনগণের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তাদেরকে এড়িয়ে, না জানিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ জনগণ মানবে না, মানবে না। শাপলা চত্ত্বরে গণহত্যা হয়েছে অভিযোগ করে ওই ঘটনার বিচার চান তিনি। আহমদ আবদুল কাদের বলেন, আমরা দাবি করেছি, জুলাই–আগস্টের গণহত্যার বিচার করতে হবে। সাথে সাথে আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে বিচার করতে হবে। বিচারের আগ পর্যন্ত তার কোনো নির্বাচনে অংশ নেয়ার কোনো সুযোগ থাকতে পারে না।
সমাবেশে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী। তিনি বলেন, সম্প্রতি নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন কোরআন বিরোধী প্রতিবেদন দাখিল করেছে। সাম্রাজ্যবাদের ফান্ডখোর কুখ্যাত নারীবাদীরা এদেশের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, বিধি–বিধান, ঐতিহ্য ও পরিবার কাঠামো ধ্বংস করার পশ্চাত্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে হুঁশিয়ার করে তিনি বলেন, এনজিওবাদী গোষ্ঠীর প্ররোচনায় এমন কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিবেন না, যা কোরআন–সুন্নাহর বিরুদ্ধে যায়। এক্ষেত্রে আমরা কোনো ছাড় দেব না। এই বিতর্কিত কমিশন ও কোরআন বিরোধী প্রতিবেদন অবিলম্বে বাতিল করে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের অন্যতম অংশীদার আলেম–ওলামার পরামর্শ নিয়ে নতুন কমিশন গঠন করুন। হেফাজতের আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয় এই মহাসমাবেশ।
এর আগে সমাবেশে যোগ দিয়ে বক্তব্য রাখেন দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ প্রমুখ। মাওলানা মামুনুল হক তার বক্তব্যে বলেন, চব্বিশের জুলাইয়ের স্বাধীনতা সংগ্রামের পর আমি বলতে চাই, আমরা দিল্লির দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছি, নিউ ইউর্কের গোলামি করার জন্য নয়। যদি বাংলাদেশকে ওয়াশিংটনের দাসে পরিণত করার কোনো চক্রান্ত করা হয়, হিউম্যানিটরিয়ান করিডরের নামে বাংলাদেশের বুকের উপর দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব হরণ করার জন্য অপতৎপরতা চালানো হয়, তাহলে সারা দেশের মানুষের প্রতি আমার আহ্বান, যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও, দেশের জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও। তিনি আরো বলেন, বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে আমরা বলতে চাই, নারী সংস্কারের নামে আল্লাহর কোরআনকে, ইসলামকে কটাক্ষ করা হয়েছে। ধর্মীয় উত্তরাধিকার বিধান, পারিবারিক বিধানকে নারী–পুরুষের বৈষম্যের প্রধান কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করে নারী বিষয়ক কমিশন এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত প্রদান করেছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত প্রদান করার অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে আমরা রাষ্ট্রের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দেখতে চাই। হেফাজতে ইসলাম বলতে চায়, এই তথাকথিত পশ্চিমা ধ্যান–ধারণায় বিশ্বাসী, বিতর্কিত নারীবাদীদের আদর্শ ও দর্শন নয় বরং হেফাজতে ইসলাম ইসলাম আল্লাহ ঘোষিত নারীর ন্যায্য অধিকারে বিশ্বাসী।
তিনি আরো বলেন, আমরা পরিষ্কারভাবে বলি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছরের মাথায় এসে সংবিধানসহ রাষ্ট্রের ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সংস্কার কার্যক্রম চলাকালে বহুত্ববাদের মতো বিতর্কিত, একত্ববাদ বিরোধী কোনো ধারণা বাংলার মানুষ গ্রহণ করবে না। আমরা সংবিধানে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস পুনর্বহালের দাবি করেছি। এই দাবি বাস্তবায়নের জন্য আগামী দিনে কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে হেফাজতে ইসলাম সেই সিদ্ধান্তই নেবে, ইনশাল্লাহ।
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠনের জন্য কেউ জুলাই বিপ্লবে জীবন দেয় নাই মন্তব্য করে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান তার বক্তব্যে বলেন, হেফাজত ইসলাম নারীবাদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আমি এখানে ড. ইউনূস সরকারের প্রতি প্রশ্ন করতে চাই, আপনারা কেন অপ্রয়োজনীয় ইস্যু তৈরি করছেন? আমি বলতে চাই, নারী কমিশন তৈরির জন্য জুলাই বিপ্লবে কেউ জীবন দেয় নাই। তারা জীবন দিয়েছিল এদেশ থেকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করার জন্য। কাজেই আপনারা সরকারে বসেছেন যাতে করে বাংলাদেশে আর ফ্যাসিবাদ ফিরে আসতে না পারে। বাংলাদেশ থেকে ভারতের আগ্রাসন মুক্ত করার জন্য। মাহমুদুর রহমান বলেন, আমি মনে করি আপনাদের দায়িত্ব শুধু সে সংস্কারগুলো করা– যে সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশে আর ফ্যাসিবাদ ফিরে আসতে পারবে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, বাংলাদেশের একজন প্রবীণ নাগরিক হিসেবে আমার অনুরোধ, আপনারা অপ্রয়োজনীয় ইস্যু তৈরি করবেন না। আমরা দেখেছি, আপনারা অনেকগুলো সংস্কার কমিশন করেছেন– যেগুলোর কোনো প্রয়োজনই ছিল না। হেফাজত ইসলামের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর বলেন, আপনারা নারীবাদ নিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন থেকে আপনারা সরে যাবেন না। আমাদের বৃহত্তর লড়াই ভারতের সাম্রাজ্যবাদীর বিরুদ্ধে লড়াই। আমাদের বৃহত্তর লড়াই ইসলামের জন্য আমাদের লড়াই। তিনি বলেন, আপনাদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা একটু ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। আমি মনে করি, বাংলাদেশের আলেমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকেন– তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না।