গত ১১ই অক্টোবর ২০২৪ পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি অধ্যাপক জন হপফিল্ড (Jhon Hopfield) প্রিন্সটন নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট আয়োজিত একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। হপফিল্ড একানব্বই বছর বয়সে ‘কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কের সাহায্যে মেশিন লার্নিং সক্ষম করে এমন মৌলিক আবিষ্কার এবং উদ্ভাবনের জন্য’ পদার্থবিজ্ঞানে ২০২৪ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। জন হপফিল্ড নয় মিনিটের সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় তার অসাধারণ গবেষণা বৈশিষ্ট্যের বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, একজন গবেষককে নিজ সাবজেক্টের বাইরে গিয়েও গবেষণা করতে হবে, যা বিজ্ঞানের নতুন নতুন উদ্ভাবনের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় । তিনি ১৬ বছর প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং প্রিন্সটন নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। হপফিল্ড উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধারে লাইফ সায়েন্স ও মলিকুলার বায়োলজির এমেরিটাস প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেখা যায়, তিনি পদার্থবিজ্ঞান, নিউরোসায়েন্স, লাইফ সায়েন্স ও মলিকুলার বায়োলজির গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তিনি যখন প্রাথমিকভাবে পদার্থবিজ্ঞানে ক্যারিয়ারের দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন, তখন তার জ্ঞানকে প্রসারিত করার জন্য রসায়ন, নিউরোসায়েন্স এবং মলিকুলার বায়োলজির মতো বিষয়গুলোকে তার গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এই বহুমুখী গবেষণা তাকে মানব মস্তিষ্কের নিউরনের কার্যকারিতা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করেছিল। কারণ, মানব মস্তিষ্ক হচ্ছে বর্তমানে বিজ্ঞানের জগতে সবচেয়ে জটিল বিষয় যা বহুমুখী গবেষণা ছাড়া বোঝা যায় না। এভাবে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার এই গবেষণা অভিযাত্রা তাকে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, নিউরোসায়েন্স (স্নায়ুবিজ্ঞান) এবং মলিকুলার বায়োলজিতে দীর্ঘমেয়াদী ভূমিকা রাখতে সাহায্য করে।
স্বভাবতই হপফিল্ডের গবেষণাগুলো বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সংযোগস্থলে (intersection) অবস্থিত হওয়ায় তার আবিষ্কারগুলো প্রকৃতিকে বুঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেখা যায়, এই ধরনের আবিষ্কারগুলোর ব্যবহারিক প্রয়োগ মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যার সমাধানে বিশেষভাবে কার্যকর। মেশিনের জন্য শেখার (learning) কৌশল বিনির্মাণে এই বিষয়গুলোর (রসায়ন, নিউরোসায়েন্স এবং মলিকুলার বায়োলজির) মিথস্ক্রিয়ার (interaction) ফলে অর্জিত জ্ঞান এবং পদার্থবিজ্ঞানের নীতির সমন্বিত প্রয়োগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই শেখার কৌশলের ভিত্তি হচ্ছে, মানুষের মস্তিষ্ক সাদৃশ্য কৃত্রিম নিউরনগুলোর মধ্যে একটি শক্তিশালী ও সক্রিয় সমন্বিত নেটওয়ার্ক তৈরি করা, যাকে বলা হয় হপফিল্ড নেটওয়ার্ক। ফলস্বরূপ, হপফিল্ড নেটওয়ার্কের সক্রিয়তার কারণে মেশিনের মধ্যে মস্তিষ্ক সাদৃশ্য অনুপ্রেরণার সৃষ্টি হয়। শুধু তাই নয় মেশিনের মধ্যে এই অনুপ্রেরণা মানুষের ন্যায় স্মৃতি ধরে রাখতে ভূমিকা রাখে এবং মানুষের অনুরূপ শুধুমাত্র খন্ডিত তথ্য ব্যবহার করে পুরো স্মৃতি পুনরুদ্ধার করে। খন্ডিত তথ্য ব্যবহার করে পুরো স্মৃতি পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়াকে এসোসিয়েটিভ মেমোরি অথবা সহযোগী স্মৃতি বলা হয়। জন হপফিল্ডকে হপফিল্ড নেটওয়ার্ক ও এসোসিয়েটিভ মেমোরি ধারণার জন্য নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়। হপফিল্ড মস্তিষ্কের জটিলতাগুলো বোঝার জন্য পদার্থবিদ্যা, জীববিজ্ঞান এবং নিউরোসায়েন্সের পদ্ধতিকে একীভূত করেছিলেন।এছাড়া, স্মৃতি স্মরণের পিছনের প্রক্রিয়াগুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্য কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কগুলো তৈরি করেছিলেন। এভাবে, বিভিন্ন পদ্ধতির সংমিশ্রণে সহযোগী মেমোরি (Associative Memory) সমৃদ্ধ কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কগুলো প্রভূত অগ্রগতি অর্জন করে। এই প্রযুক্তি এখন প্রায়শই স্মার্টফোন এবং স্বায়ত্তশাসিত (Autonomous) যানবাহনের মতো ডিভাইসগুলোতে ব্যবহার করা হয়। এটি লক্ষণীয় যে, অতীতের অভিজ্ঞতাগুলো পুনরুদ্ধার করতে মানুষ প্রায়শই খণ্ডিত তথ্য ব্যবহার করে। এটা মানুষের সহজাত সহযোগী স্মৃতি ব্যবহারের একটি অসাধারণ ক্ষমতাকে প্রতিফলিত করে। পরবর্তীতে, হপফিল্ড নেটওয়ার্কগুলো আরো নতুন উদ্ভাবনের ভিত্তি স্তৈরি করেছে, যা দৃশ্যমান হয়েছে অভিনব এক নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে যাকে বলা হয় ডিপ লার্নিং (Deep Learning)।ডিপ লার্নিং এর ব্যবহার এখন সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে চ্যাট জিপিটির অনুরূপ বিভিন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে। ডিপ লার্নিং এর ফাদার হচ্ছে কানাডার বিখ্যাত টরেন্টো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জিওফ্রি হিন্টন । সেজন্য তাকেও হপফিল্ড এর সাথে পদার্থ বিজ্ঞানে ২০২৪ সালের নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। A Deep Learning Inspired Belief Rule-based Expert System শিরোনামের আমাদের গবেষণা প্রবন্ধে (বিখ্যাত IEEE Access জার্নালে প্রকাশিত), আমরা একটি এক্সপার্ট সিস্টেম এর ইনফারেন্স (Inference) পদ্ধতির মধ্যে সহযোগী মেমোরিকে একীভূত করার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছি ও ভবিষ্যদ্বাণীর নির্ভুলতা বাডানোর ক্ষেত্রে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরেছি। এই পদ্ধতি অধিকতর কার্যকর ভূমিকা পালন করে, যখন বড় আকারের ডেটাসেট (Big Data) নিয়ে কাজ করা হয় সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য, যেমন বায়ু দূষণ নির্ণয়। মূলত: যখন একজন গবেষকের নিজের বিষয়ের (যেমন এক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞান) সীমানা অতিক্রম করার সাহস থাকে, তখন তিনি বিবর্তন, একীকরণ এবং আবিষ্কারের প্রক্রিয়াগুলিকে প্রত্যক্ষ করতে পারেন। যা আমরা হপফিল্ডের ক্ষেত্রে দেখতে পেলাম। আমি এটিকে মিথস্ক্রিয়া (interaction), সংহতকরণ (integration) এবং বিবর্তনের (Evolution) (IIE) একটি কাঠামো হিসাবে দেখতে চাই। দেখা যায়, হপফিল্ডের চিন্তা চেতনায় ওওঊ–এর উপস্থিতি নিউরাল নেটওয়ার্ক নিয়ে তার যুগান্তকারী গবেষণাকে চালিত করেছে। স্বভাবতই, জন হপফিল্ড একজন যুগান্তকারী বিজ্ঞানী হিসাবে আবির্ভূত হন, যিনি প্রচলিত গবেষণার ধারণাকে (যা খুবই এককেন্দ্রিক) অতিক্রম করার সাহস রাখেন। ফলত তিনি তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা এবং অসংখ্য বৈজ্ঞানিক শাখায় বিস্তৃত ঘটনাগুলোর একটি বৈচিত্র্যময় বিন্যাসের মধ্যে গভীর আন্তঃসম্পর্ক অবলোকন করার ক্ষমতা রাখেন। জন হপফিল্ডের এই গবেষণা বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে, আইনস্টাইনও প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ছিলেন।
লেখক : প্রফেসর, ডিপার্টমেন্ট অফ কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ফুলব্রাইট ভিজিটিং স্কলার প্রফেসর, ইউএসএ ও বিশ্বের শীর্ষ দুই শতাংশ বিজ্ঞানীর একজন।