২০২৩ সালে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় থাকুক

নাসের রহমান | রবিবার , ১ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৪:৩৯ পূর্বাহ্ণ

২০২৩ সাল কেমন যেতে পারে? বাইশ সাল যেভাবে গিয়েছে সেভাবে, নাকি এর সাথে সংযোজনবিয়োজন হবে। যে কোনও কিছু হোক না কেন, একটা ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। হঠাৎ করে খুব ভাল বা খুব খারাপ এরকম হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বাইশের চলমান সমস্যার অইেশ তেইশেও বিরাজমান থাকবে। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সংকট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা। একটা পর্যায়ে এসে বিদ্যুৎ সমস্যা কিছুটা লাঘব হলেও দ্রব্যমূল্য লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে। কোনও কোনও পণ্যের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা জনজীবনে দুর্ভোগ বাড়ালেও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থেকেছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আসেনি। আমদানী নির্ভর এসব গুরুত্বপূর্ণ খাতের উপর উৎপাদন ব্যবস্থা অনেকটা নির্ভরশীল। কোনও কারণে উৎপাদন ব্যাহত হলে সরবরাহের উপর চাপ পড়ে। এতে অর্থনীতির স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়। যার প্রভাব পরবর্তী বছরের অর্থনীতির উপর গিয়ে পড়ে।

বিভিন্ন ধরনের ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যেও ২০২২এ অর্থনীতির চাকা সচল থেকেছে। দ্রব্যমূল্য, জ্বালানি সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা কোনোটাই উৎপাদনকে খুব একটা ব্যাহত করতে পারেনি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের কোথাও কোথাও বাম্পার ফলন হয়েছে। যদিওবা বাজার মনিটরিং যথাযথভাবে কার্যকর না থাকায় দ্রব্যমূল্য তেমন কমেনি। আশার কথা উৎপাদন ভাল হওয়ায় চাহিদা ও সরবরাহে মোটামুটি ভারসাম্য অবস্থা বজায় থাকবে। খাদ্য পণ্য আমদানীর উপর বাড়তি জোর না দিলেও চলবে। তবে ভোজ্য তেল, ডাল, ছোলা প্রভৃতি যেসব ভোগ্যপণ্য আমদানী করতে হয় সেসব পণ্য বিদেশ থেকে আনতে হবে। উৎপাদন মূখী বিভিন্ন শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত মেশিনারিজ আমদানীও অব্যাহত রাখতে হবে। আমদানী নির্ভর অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর একটা চাপ থাকে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধিতে এই চাপ আরো প্রকট হয়। এতে করে আমদানী মূল্য বৃদ্ধি পায়। আমদানী মূল্য বৃদ্ধি পেলে উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যায়। উৎপাদনের ব্যয় বাড়লে স্বাভাবিকভাবে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। যা শেষ পর্যন্ত ক্রেতা সাধারণের ঘাড়ের উপর গিয়ে পড়ে।

সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে স্মার্ট বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অর্থাৎ ডিজিটাল বাংলাদেশের উত্তোরণ ঘটবে র্স্মাট বাংলাদেশে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইটি সেক্টরের উল্ল্যেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে দেশ র্স্মাট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার গুরুত্ব অনেক বেশি। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় যুগান্তকারী পরিবর্তন হয়েছে। দেশে বর্তমানে অনেকগুলো পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেল চালু রয়েছে। একই সাথে অনলাইন ভার্সনগুলোর চাহিদাও অনেক বেড়েছে। দৈনিক পত্রিকাগুলোতে সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি ফিচার, প্রবন্ধ, নিবন্ধ প্রতিনিয়ত প্রকাশ পাচ্ছে। বিভিন্ন সংবাদ পরিবেশনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। লাইভ প্রতিবেদনসহ সংবাদ পরিবেশন মানুষের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছে। নানারকম বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচারের সাথে টকশোর মধ্যদিয়ে সমসাময়িক ঘটনাবলি নিয়ে আলোচনা সমালোচনা দর্শকদের কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর ভূমিকা অপরিসীম। ব্যাংক পেপারলেস ব্যাংকিং শুরু করবে। এখনো কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুরু হয়েছে। কাগজে লেখার কোনও প্রয়োজন হবে না। ব্যাংকের ক্যাশ লেনদেনও অনেকাংশে হ্রাস পাবে। ক্যাশ লেনদেনকে নিরুৎসাহিত করা হবে। এখনো অনেকে বিভিন্ন কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করে থাকে। ক্যাশ লেনদেনের ঝুঁিক থাকবে না। মানুষের ভোগান্তি কমে আসবে। সবকিছু সহজে হাতের কাছে পেয়ে যাবে। ব্যাংক, বীমা, শিল্প কারখানা, অফিস, আদালত সর্বত্র কাগজের ব্যবহার কমে আসবে। বিভিন্ন ডিভাইস ও অ্যাপস্‌ এর মাধ্যমে কর্ম সম্পাদন হবে।

যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে বাইশে। বহু চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে স্বপ্নের সেতু পদ্মা নির্মিত হয়েছে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশের সক্ষমতা বহির্বিশ্বে প্রকাশ পেয়েছে। মানুষ যা কখনো কল্পনাও করতে পারেনি কর্ণফুলীর তলদেশে ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’ তৈরী হয়েছে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অসংখ্য সেতু, কালভার্ট ও রাস্তা নির্মিত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন জায়গায় উড়াল সেতু, এলিভেটেড রোড, এক্সপ্রেস ওয়ে, ফ্লাই ওভার নির্মিত হয়ে যোগাযোগকে সহজ করেছে। মেট্রো রেলের সংযোজন ঢাকা শহরের যানজট কমিয়ে আনতে পারবে। দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এসব স্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। বিভিন্ন মালামাল ও পণ্য সামগ্রী এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সহজে নিয়ে যেতে পারবে। অনায়াসে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে জেলা সদর ও শহরমুখী হতে পারবে। উৎপাদনকারী পণ্যের ন্যয্য মূল্য পাবে, উৎপাদনে আরো উৎসাহি হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত থাকলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে। এতে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, উৎপাদনও বেড়ে যাবে। অর্থনীতিতে দীর্ঘ মেয়াদী ফল বয়ে আনবে। এসব কিছুর সুফল শুধু তেইশে বা চব্বিশে নয় পরবর্তীতেও বিরাজমান থাকবে। পদ্মা সেতু ও বঙ্গবন্ধু টানেলের মাধ্যমে দেশের বাইরের প্রতিবেশি কয়েকটি দেশের যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহন সহজ করবে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় এ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

কোনও দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ২০২২এ রাজনৈতিক অঙ্গন কিছুটা উত্তপ্ত থাকলেও কখনো অস্থিতিশীল হয়ে উঠেনি। যার ফলে নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারী মাসে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা এসেছে। নির্বাচনের প্রতি মানুষের উৎসাহ আগ্রহের শেষ নেই। মানুষ ভোট অধিকার প্রয়োগ করে সরকার পরিবর্তন করতে পারে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক উত্তাপ উত্তেজনা সবসময় থাকে। ২০২৩এর পুরো বছর জুড়ে নির্বাচনের প্রচারণা থাকার কথা। তবে রাজনৈতিক পক্ষগুলো সমঝোতায় না আসা পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারণার চেয়ে আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথ উত্তপ্ত থাকবে। বিরোধী পক্ষের আন্দোলন সংগ্রাম হিংসা হানাহানির পথে এগিয়ে গেলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যাবে। বেশিদিন ঘোলাটে পরিস্থিতি থাকলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হতে পারে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে স্বাভাবিক কর্মকান্ড বাধাগ্রস্থ হবে পড়বে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত, শিল্প কারখানায় বিরূপ প্রভাব পড়বে। জনদুর্ভোগ চরম পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। দীর্ঘসময় ধরে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করলে ব্যবসাবাণিজ্য ও উৎপাদন ব্যহত হবে। অর্থনীতির চাকাকে পুরোপুরি সচল রাখতে না পারলে প্রবৃদ্ধি অর্জন কোনও মতেই সম্ভব হবে না। এই জন্য উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে ২০২৩এ রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার কোন বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে জনগণ ও দেশের স্বার্থকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। জাতীয় স্বার্থকে দলীয় স্বার্থের উর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। দলমত নির্বিশেষে মিমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি না করে অন্যান্য বিষয়ে একমতে আসতে পারলে জাতীয় ঐক্যমত গড়ে তোলা সম্ভব। এ ঐক্যমতের ভিত্তিতে উদ্বুত সমস্যার সমাধান এবং দাবী দাওয়াসমূহ আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে। শাসকদল ও বিরোধী দলের এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্যে বা সমঝোতায় আসা খুবই প্রয়োজন। যা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পাশাপাশি অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখে প্রবৃদ্ধি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতারুণ্য, মুক্তচিন্তা এবং অগ্রসরমান বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধআদানির নিয়ন্ত্রণে যাওয়া এনডিটিভির পরিচালনা পর্ষদ থেকে পদত্যাগ ২ প্রতিষ্ঠাতার