১৩২ বছরের পুরনো হাতির বাংলো এখন জরাজীর্ণ

রেলওয়ের ঐতিহ্য : প্রয়োজন সংস্কার

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ৫ জুলাই, ২০২৫ at ৪:৪৪ পূর্বাহ্ণ

চারদিকে উঁচু পাহাড়ে চোখ জুড়ানোমন ভুলানো সবুজের সমারোহ। সকাল থেকেই সন্ধ্যা পর্যন্ত পাখির কিচিরমিচির শব্দ, শান্তছায়া সুশীতল সিআরবির পাহাড়ে এমন প্রাকৃতিক পরিবেশে শতাব্দীর ঐতিহাসিক রেলওয়ের ‘হাতির বাংলোটি’ দেখার জন্য চট্টগ্রামের দূরদূরান্ত থেকে অনেক ভ্রমণপিপাসু দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন। সিআরবির পাহাড়ে দৃষ্টিনন্দন হাতির বাংলোটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে রেলওয়ের শতাব্দীর প্রাচীন ইতিহাস। শতবর্ষ পুরোনো এই ইতিহাস হয়তো অনেকেরই অজানা।

বাংলাদেশ রেলওয়ের জীবন্ত এক ইতিহাস; ব্রিটিশ আমলে নির্মিত চট্টগ্রামে ১৩২ বছরের পুরনো বাংলাদেশ রেলওয়ের ‘হাতির বাংলো’। দীর্ঘ শতাব্দী পেরিয়ে আজও রেলওয়ের এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি এই অঞ্চলের মানুষের কাছে এক অন্যন্য স্থাপনা হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছে। আলাপকালে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের এক অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী জানান, আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের সদর দপ্তর ছিল চট্টগ্রামে। ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বদিক এবং বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলসহ পুরো আসাম প্রদেশে রেললাইন স্থাপন করেছিল আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে। ১৮৯৩ সালে চট্টগ্রাম থেকে ফেনী পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজ শুরু হয় বৃটিশ প্রকৌশলী ব্রাউনজারের অধীনে। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝিতে রেলওয়ে কর্মকর্তাদের বসবাসের জন্য ডুপ্লেক্স এই বাংলোটি নিজেই নির্মাণ করেন প্রকৌশলী ব্রাউনজার। এর নির্মাণ কাজে ফেরো সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। এমন নান্দনিক স্থাপনাটিতে কোনো লোহা ব্যবহার করা হয়নি।

বাড়িটি দেখতে অবিকল হাতির মতো মনে হলেও এটি মূলত ১৩২ বছর আগে ইটপাথরে নির্মিত একটি প্রাচীন ভবন। যা এখন বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। যদিও কালের আবহমানে বাংলোটি আজ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। দৃষ্টিনন্দন এ বাংলোটি ২০২৩ সালে একবার রেলওয়ের পক্ষ থেকে সংস্কার করা হলেও বড় ধরনের তেমন কোনো সংস্কার হয়নি। যার ফলে কালের বির্বতনে ইতিহাসঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে থাকা রেলওয়ের এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি এখন অনেকটা বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। ইতিহাসঐতিহ্যের অংশ হিসেবে এই বাংলোটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রক্ষার উদ্যোগ নিলে এটি হয়তো পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় একটি থাকার স্থানে পরিণত হতো।

এই ব্যাপারে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) প্রকৌশলী মো. সবুক্তগীণ আজাদীকে বলেন, বৃটিশ আমলে নির্মিত হাতির বাংলোটি রেলওয়ের একটি প্রাচীন ভবন। এটি রেলওয়ে ঐতিহ্যের একটি অংশ, ইতিহাসের অংশ। বাংলাদেশ রেলওয়ের এমন অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। যেগুলো আমরা সংরক্ষণ করে থাকি। হাতির বাংলোটি ঊনিশ শতকের মাঝামাঝিতে রেলওয়ে কর্মকর্তাদের বসবাসের জন্য নির্মাণ করেন এক প্রকৌশলী। এটি বিভিন্ন সময়ে সংস্কার করা হয়। এই ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করা হবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বাংলোটির সামনে ও পেছনের অংশ মিলিয়ে মোট ১২টি গোলআকৃতির জানালা আছে। এছাড়া হাতির শুঁড়ের আদলে নির্মিত বারান্দার দু’পাশেও আছে গোলাকার দুটো ছিদ্র, যা দেখতে অনেকটাই হাতির চোখের মতো। ডুপ্লেঙ এই ভবনের নীচতলায় ৪টি ও দোতলায় একটি শয়নকক্ষ আছে। বর্তমানে স্থাপনাটির সবকটি দরজাজানালাই ভেঙে পড়ার পাশাপাশি মরিচা ধরেছে। কাঠ দিয়ে নির্মিত সব জানালাগুলোই পড়ে আছে জরাজীর্ণ অবস্থায়। এছাড়া ভবনের দেয়ালজুড়ে পড়েছে শ্যাওলা, খসে পড়তে শুরু করেছে পলেস্তারা। বাড়ির চারপাশজুড়ে জমে আছে বিভিন্ন ময়লা আর শুকনো পাতা। নান্দনিক এই বাংলোতে এখন একজন রেলওয়ে কর্মচারী ভেতরের একটি শয়নকক্ষে কোনো রকমে থাকেন।

চারদিকে উঁচু পাহাড়ে চোখ জুড়ানোমন ভুলানো সবুজের সমারোহ। পাখির কিচিরমিচির শব্দ, শান্তছায়া সুশীতল এমন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার ইচ্ছে সবার মধ্যেই আছে। বিকেল হলেই চট্টগ্রামের দূরদূরান্ত থেকে অনেক ভ্রমণপিপাসু দর্শনার্থী ছায়া সুশীতল হাতির বাংলোটি দেখতে ছুটে আসেন। বিশেষ করে কলেজবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, প্রকৃতিপ্রেমী ইতিহাসঐতিহ্য গবেষক কবিসাহিত্যিকসাংবাদিকরা সারাবছরই রেলওয়ের হাতির বাংলোর নান্দনিক স্থাপত্য শৈলী ও এই এলাকার চারপাশের প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য ছুটে যান। হাতির বাংলোর এই উঁচু পাহাড়ে উঠেনিচের দিকে থাকালে মনে হবে চারদিকে গহীন বন। চারদিকে শতবর্ষী ঘন গাছের সারি। সকালের রোদ আঁচল বিছিয়ে দেয় রেলওয়ের এই হাতির বাংলোর পুরো সবুজ পাহাড়ের বুকজুড়ে। এটি শুধু বাংলাদেশ রেলওয়ের নয়, দেশের প্রাচীন স্থাপনার নিদর্শনও বটে।

হাতির আদলে নির্মিত এ ডুপ্লেঙ বাড়িটি সাধারণ লোকজনের কাছে ‘হাতি বাংলো’ নামে পরিচিত। সিআরবি রেলওয়ে পুলিশ সুপারের বাংলোর পাশে হাতি বাংলোটির দুইপাশে দুইটি করে চারটি এবং সামনে এবং পেছনে তিনটি করে ছয়টি জানালা রয়েছে। জানালাগুলোও গোলাকার। বাংলোর সামনের দিকে হাতির সুড়ের মত যে বারান্দাটি রয়েছে সেটিতেও গোলাকার দুইটি ফুটো রয়েছে। যা দেখতে অনেকটা হাতির চোখের মত। ভবনটির নিচতলায় দুইটি এবং উপরে একটি কক্ষ রয়েছে। প্রকৌশলী ব্রাউনজার উত্তরমুখী এই বাংলোতে থাকতেন। পরবর্তীতে ডরমেটরি হিসেবে ব্যবহার হত। হাতির গায়ের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে এই স্থাপনাতেও ধূসর রং করা হয়, তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভবনের রং পুরোটাই এখন বিবর্ণ ধারণ করেছে।

রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এটি এখন ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। তবে পাহাড়ের ওপর নির্মিত ভবনটির চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। প্রকৃতি নিজের হাতেই ওই এলাকাকে সাজিয়ে দিয়েছে। নান্দনিক এই স্থাপত্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে এটি দর্শনার্থীদের কাছে আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআ. লীগ নেতার ছেলের বিয়ে, চিটাগং ক্লাবে বৈষম্যবিরোধীদের অবস্থান
পরবর্তী নিবন্ধচবিতে শিক্ষকের পদোন্নতির সাক্ষাৎকার নিয়ে ভিসির কার্যালয়ে হট্টগোল