চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লাসহ দেশের ১১ জেলায় ৪৫ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। অন্য জেলাগুলো হচ্ছে– খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, সিলেট, লক্ষীপুর ও কঙবাজার। আকস্মিক এই বন্যায় ২ জন নারীসহ ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। কয়েক দিনের টানা ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে এ বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যা দুর্গত এলাকার ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় হালদা নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। ফটিকছড়ি ধুরুং ও সর্তা খালের বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। দুই উপজেলায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। কুমিল্লা বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুড়বুড়িয়া এলাকায় গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে উপজেলার বহু গ্রাম তলিয়ে গেছে। বাড়ছে সিলেটের বিভিন্ন নদ–নদীর পানি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান গতকাল মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে দেশের চলমান বন্যা সম্পর্কে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে বলেন, বন্যায় দেশের ৫৮৪টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার ৮ লাখ ৮৭ হাজার ৬২৯ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ৪৪ লাখ ৯৭ হাজার ৫৩৫ জন। ১৩ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে কুমিল্লায় ৪ জন, ফেনীতে ১ জন, চট্টগ্রামে ২ জন, নোয়াখালীতে ১ জন, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় ১ জন, লক্ষীপুরে ১ জন ও কঙবাজারে ৩ জন রয়েছেন।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধার ও তাদের মাঝে পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে সচিব বলেন, পানিবন্দী ও ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় প্রদানের জন্য মোট ৩ হাজার ১৬০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭৩৯ জন লোক ও ১৭ হাজার ৮৪৮টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এছাড়া, ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য মোট ৬৩৭টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে।
তিনি জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন জেলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৩ কোটি ৫২ লাখ নগদ টাকা, ২০ হাজার ১৫০ মেট্রিক টন চাল এবং ১৫ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ৩৫ লাখ টাকা ও ১ হাজার ৬শ’ মেট্রিক টন চাল; কুমিল্লায় ৪৫ লাখ টাকা ও ২ হাজর ৬শ’ মেট্রিক টন চাল; ফেনীতে ৬২ লাখ টাকা, ২ হাজার ৯শ’ মেট্রিক টন চাল ও ৬ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার; নোয়াখালীতে ৪৫ লাখ টাকা, ২ হাজার ৬শ’ মেট্রিক টন চাল ও ১ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার; সিলেটে ৪৫ লাখ টাকা, ২ হাজার ৬শ’ মেট্রিক টন চাল ও ৪ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার; মৌলভীবাজারে ৩০ লাখ টাকা, ২ হাজার ৩৫০ মেট্রিক টন চাল ও ১ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার; হবিগঞ্জে ৩৫ লাখ টাকা, ২ হাজার ৪শ’ মেট্রিক টন চাল ও ৩ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার; ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় ১৫ লাখ টাকা, ১ হাজার ৬শ’ মেট্রিক টন চাল; লক্ষ্মীপুরে ১০ লাখ টাকা, ৫শ’ মেট্রিক টন চাল; খাগড়াছড়িতে ১০ লাখ টাকা, ৫শ’ মেট্রিক টন চাল এবং কঙবাজারে ২০ লাখ টাকা, ৫শ’ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া, দেশের সকল জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী মজুদ রয়েছে।
বন্যা আক্রান্ত জেলাসমূহের জেলা প্রশাসককে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, মেডিকেল টিম ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে সমন্বয় করে এক সাথে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে সার্বক্ষণিক কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। তথ্য ও সহযোগিতার জন্য ০২৫৫১০১১১৫ নম্বর চালু রয়েছে।
ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ ও লক্ষীপুর জেলার বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোষ্ট গার্ড ও বিজিবি জেলা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে উদ্ধার কাজে নিয়োজিত রয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিব বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য বন্যা উপদ্রুত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন বলে জানানো হয়।
ফেনীর পরিস্থিতি : ফেনীর বন্যা পরিস্থিতি এখনো ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে। পানিতে ভাসছে ফেনী শহর। বিডিনিউজের খবরে বলা হয়– গোটা জেলায় প্রায় এক লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
দুই দিন ধরে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট না থাকায় গ্রামে থাকা পরিবারের সদস্যদের অবস্থাও জানতে পারছেন না স্বজনরা। অসহায় অবস্থায় অনেকে নাম–ঠিকানা দিয়ে পরিবারের খোঁজ জানতে এবং উদ্ধার তৎপরতার জন্য সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে পোস্ট দিচ্ছেন। তারা চেষ্টা করেও পরিবারের সদস্যদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না।
স্থানীয়রা বলছেন, ফেনীতে এমন ভয়াবহ বন্যা আগে কখনো দেখেননি তারা। বিশেষ করে ফেনী শহরে পানি ওঠায় রীতিমতো অবাক সবাই। জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলা বন্যা কবলে পড়েছে। তবে ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী ও পরশুরাম এই তিন উপজেলা পুরোটাই বন্যাকবলিত। পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলা এখনো বিচ্ছিন্নই বলা চলে। এখানে সবচেয়ে বেশি মানুষ দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন।
পানিবন্দী মানুষেরা জানাচ্ছেন, তারা খাবার ও সুপেয় পানির সংকটে পড়েছেন। তবে বানভাসি মানুষকে উদ্ধার করতে কাজ করছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), ফায়ার সার্ভিস ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
শুক্রবার সকালে ফেনী সদরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ স্থানেই পানিতে ডুবে আছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, চাষের জমি। অনেক গ্রামে বাড়িঘর খালি পড়ে আছে। বেশিরভাগ ভবনের নিচতলায় পানি ঢুকেছে। কেউ কেউ দোতালা ও তিনতলায় আশ্রয় নিয়ে বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। ভেসে গেছে বেশিরভাগ পুকুর ও জলাশয়ের মাছ। অনেকে বন্যার পানির মধ্যে মাছ ধরছেন। এ ছাড়া ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী অংশে কোথাও হাঁটু সমান, কোথাও বুক সমান পানি। এ কারণে যান চলাচল করতে পারছে না।
ফেনী সদরের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ৬৫ বছরের জীবনে এত পানি দেখিনি। বিশেষ করে জন্মের পর কখনো দেখিনি ফেনী শহরে বন্যার পানি উঠতে। এবারের মত মহাসড়কে পানি উঠতেও কখনো দেখিনি। মানুষের দুর্ভোগ চরম আকারে পৌঁছেছে। আল্লাহ ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।’
এদিকে জেলা প্রশাসন জানায়, ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী ও পরশুরাম এ তিন উপজেলার পুরোটাই বন্যাকবলিত। সদর ও দাগনভূঞা উপজেলার ৮০ শতাংশ এলাকার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সোনাগাজী উপজেলার সব ইউনিয়নে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ দুর্ভোগে আছেন।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন–বিটিআরসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ফেনী জেলায় ৯২ শতাংশ টাওয়ারই অচল হয়ে পড়েছে। তারা আরও জানিয়েছে, বিদ্যুৎসংযোগ না থাকা এবং টাওয়ার এলাকা ডুবে যাওয়ায় নেটওয়ার্ক সচল করা যাচ্ছে না।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপ–সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, আমাদের বেশ কয়েকটি টিম ফেনীতে কাজ করছে। এখনো অন্তত এক লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে।
নোয়াখালীর পরিস্থিতি : নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। তবে বৃষ্টি কমে যাওয়ায় বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। কিন্তু খুব ধীরগতিতে পানি নামছে। উজান থেকে এখনও আসছে স্রোত। এখনও প্রায় ২০ লাখ বাসিন্দা পানিবন্দী অবস্থায় আছে। বেশিরভাগ মানুষের ঘরবাড়ি ডুবে আছে। শুক্রবার বিকালে দেখা গেছে, সদর, বেগমগঞ্জ ও সেনবাগ উপজেলার সবগুলো সড়ক এখনও পানির নিচে। একইভাবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, সিভিল সার্জন কার্যালয়, জেলা জজ আদালত, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ও সার্কিট হাউজ সড়কসহ মাইজদী সদরের প্রায় সব সড়ক হাঁটুপানির নিচে তলিয়ে আছে। শহরের বেশিরভাগ বাসাবাড়িতে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা জাহিদ হাসান খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জেলার ৯টি উপজেলায় ২০ লাখের বেশি মানুষ বর্তমানে পানিবন্দী অবস্থায় ঘরে আছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন প্রায় ৭৬ হাজার মানুষ। এখন পর্যন্ত নোয়াখালীতে দুজনের মৃত্যুর খবর জানতে পেরেছি আমরা। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরকারি বরাদ্দ হিসেবে এ পর্যন্ত ৫০৫ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ২৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’
প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল : এদিকে ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে অনুদান পাঠাতে আগ্রহীদের স্বাগত জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। আগ্রহীদের সোনালী ব্যাংক কর্পোরেট শাখা, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ‘প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল’ নামের অ্যাকাউন্টে (হিসাব নম্বর : ০১০৭৩৩৩০০৪০৯৩) অনুদান পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে।