১১৭ বছরের পুরনো তামাদি আইন যুগোপযোগী করার প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে

জিয়া হাবীব আহসান | শনিবার , ৫ জুলাই, ২০২৫ at ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ

১৯০৮ সালের তথা ১১৭ বছরের পুরনো তামাদি আইন দিয়ে চলছে আমাদের আইন আদালত। অথচ দেওয়ানীফৌজদারী সকল আইনেই এআইনের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই আইনে ২৯ টি ধারা ও ১নং তফসিলে (সিডিউল) ১৮৩টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এটি একটি বিধিবদ্ধ আইন। তামাদি আইন, ১৯০৮ সালের আইন, যা বাংলাদেশে বর্তমানে প্রযোজ্য। এই আইনের কিছু ধারা বাতিলও হয়েছে, যেমনধারা ৩০, ৩১, ও ৩২। ২০০৪ সালের সংশোধনীতে কিছু অনুচ্ছেদের সময়সীমা ৩ বছর থেকে কমিয়ে ১ বছর করা হয়েছে, যা ২০০৫ সালের ১লা জুলাই থেকে কার্যকর হয়।

তামাদি আইন বিচার ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করে এবং পুরনো বিষয় নিয়ে অহেতুক বিবাদ নিষ্পত্তি করে। এটি বাদী ও বিবাদীর অধিকার রক্ষা করে এবং বিচার প্রক্রিয়ায় দ্রুততা আনে এবং আইনের সঠিক প্রয়োগে সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় থাকে।

তামাদি আইনের মূল বিষয় হলো, মামলার সময়সীমা নির্ধারণ করা, যা একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে মোকদ্দমা দায়ের করতে হয়। এই আইনের মূল উদ্দেশ্য হল, বাদী ও বিবাদীর অধিকার রক্ষা করা এবং বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও দ্রুততা নিশ্চিত করা। এই আইন নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে মামলা দায়ের করার বাধ্যবাধকতা তৈরি করা, যাতে করে বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায় এবং পুরনো বিষয় নিয়ে অহেতুক বিবাদ নিষ্পত্তি করা যায়।

তামাদি আইনের কিছু অসঙ্গতি বা বিতর্কিত দিক রয়েছে; যদি কোনো ব্যক্তি মামলা করার অধিকার পাওয়ার আগেই অক্ষম হয়ে যান (যেমন, নাবালক বা মানসিক ভারসাম্যহীন), তাহলে সেই অক্ষমতা দূর না হওয়া পর্যন্ত তামাদির সময় গণনা শুরু হয় না। তবে, এই অক্ষমতা দূর হওয়ার পরও যদি কিছু সময় বাকি থাকে, তাহলে সেই সময়টিও মূল সময়সীমার সাথে যোগ হবে কিনা এবং যদি কোনো ব্যক্তি প্রতারণার মাধ্যমে কাউকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তাহলে সেই প্রতারণা ধরা পড়ার পর থেকে তামাদির সময় গণনা শুরু হবে। এখানে প্রশ্ন হলো, প্রতারণা ধরা পড়ার সময়সীমা কতটুকু, তা নিয়ে প্রায়ই বিতর্ক হয়। তামাদি আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী, আদালত কিছু যুক্তিসঙ্গত কারণে তামাদির সময়সীমা অতিক্রম করার পরও মামলা গ্রহণ করতে পারে। তবে, এই অতিরিক্ত সময় মঞ্জুর করার ক্ষমতা আদালতের ইচ্ছাধীন তবে তা স্বেচ্ছচারী হবে না। তামাদী আইনের ২৮ ধারায় জবর দখল ও ২৬ ধারায় সুখাধিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধারা দুটি বাস্তব আইন সম্পর্কিত আর বাকী সব ধারাগুলো পদ্ধতিগত আইন। তামাদি আইন অহেতুক বিবাদ নিষ্পত্তি করে, যা বিচার বিভাগের উপর চাপ কমায় এবং বিচার ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করে এবং পুরনো বিষয় নিয়ে অহেতুক বিবাদ নিষ্পত্তি করে।

ফৌজদারি মামলায় আপিলের ক্ষেত্রেও তামাদি আইনের প্রয়োগ হয়ে থাকে। তবে, আপিলের সময়সীমা সাধারণত সংক্ষিপ্ত হয়ে থাকে এবং এখানেও যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখিয়ে সময় বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। তামাদি আইনের ২৬ ধারার বিধান মতে ব্যবহারসিদ্ধ ঊধংবসবহঃ জরমযঃ অর্জন করতে ২০ বৎসর সময় লাগে। তামাদি আইন অনুসারে ২০ বৎসর একাধিক্রমে ভোগজনিত কারণে অর্জিত অধিকারকে বধংবসবহঃ ৎরমযঃ বলে। এ অধিকার লোপ পেতে সময় লাগে মাত্র ০২ বৎসর। তামাদি আইনকে ‘নিষ্ঠুর আইন‘ বলা হয়। কেননা এই আইনের ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, যে কোন সম্পত্তির দখল প্রাপ্তির জন্য মামলা রজু করার ব্যপারে এ আইনে যে মেয়াদ নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে তা উত্তীর্ণ হওয়ার পর সেই সম্পত্তিতে বাদীর মামলা দায়েরের অধিকার বিলুপ্ত হয়ে যায়। তামাদী আইনে দখল উদ্ধারের জন্য তামাদির মেয়াদ প্রথম তফসিলে নির্ধারিত আছে। এ নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলে ঐ সম্পত্তির ওপর দাবীকারীর স্বত্ব লোপ পায়। সুতরাং কোনো ব্যক্তি যদি অন্যের সম্পত্তি প্রকাশ্যভাবে মালিকের গোচরে ১২ বৎসরের উর্ধ্বকাল দখল করে রাখে তবে সে ক্ষেত্রে জবর দখলকারীর স্বত্ব পাকাপোক্ত হয় এবং আসল মালিকের স্বত্ব নষ্ট হয়। অথচ ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩ এর সাথে এবং ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ধারার সাথে সাংঘর্ষিক।

স্বত্ববিলোপ : তামাদি আইনের কিছু ধারায় যেমন; ২৮ ধারা) স্বত্ববিলোপের ধারণা দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে, কেউ যদি দীর্ঘদিন ধরে কোনো সম্পত্তির মালিক বা দখলকার ছাড়াই ভোগদখল করে, তাহলে সেই সম্পত্তির মালিকানা তার হয়ে যেতে পারে। এই স্বত্ববিলোপের ধারণাটি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে এবং তামাদি আইনের ২৮ ধারা ভূমি অপরাধ আইনের সাথে ও সাংঘর্ষিক। এক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী আইনি জটিলতা দূরীকরণে সুস্পষ্ট বিধান থাকা জরুরি।

তামাদী আইনের ১৮ ধারায় প্রতারণার কথা বলা হলেও এক্ষেত্রে ‘প্রবঞ্চনা’ বা ফ্রড এর কোন সংজ্ঞা নেই। তামাদি আইনের ১৮ ধারার আলোকে একথা বলা যায় যে, যদি কোন ব্যক্তিকে তার অধিকার হতে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোন বিষয় গোপন রাখা হয় তবে তাকে ‘প্রতারণা’ বলে। প্রবঞ্চনার কারণে কেউ যেন নিজ অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় সেজন্য প্রতারিত ব্যক্তির অধিকার রক্ষায় ১৮ ধারা এ আইনে সন্নিবেশিত হয়েছে। ইংরেজি পঞ্জিকা অনুযায়ী তামাদি আইনে সময় গণণা করা হয়। ১৫৮২ সালে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী ইংরেজি পঞ্জিকা সংস্কার করেন। সে সময় হতে ইংরেজি সন, তারিখ অনুসরণ করা হয়। মামলা দায়েরের কারণ বা ‘কজ অব অ্যাকশন’ সৃষ্টির সময় থেকেই মামলা দায়েরের অধিকার জন্মে আর তামাদি কালও ঠিক সে সময় হতে শুরু হয়। তামাদির অজুহাত বিবাদীর বিরুদ্ধে নয়, শুধু বাদীর বিরুদ্ধেই উত্থাপন করা যায়। তামাদি আইনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক হলোঃ যদি সরল বিশ্বাসে ভুল আদালতে মামলা দায়ের করার ক্ষেত্রে যে সময় নষ্ট হবে, সে সময় গণনা থেকে বাদ যাবে (ধারা১৪)। মোকদ্দমা স্থগিতকালীন যে সময়, তা গণনা থেকে বাদ যাবে (ধারা১৫)

ফৌজদারী মামলার বিচারে তামাদি আইনের বিধান যুক্ত হয় না। তবে যদি কোনো আইনে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিধান না থাকে, তবে কোন কোন ফৌজদারী আপিলের ক্ষেত্রে ১৫০, ১৫০ক, ১৫৪, ১৫৫ ও ১৫৭ অনুচ্ছেদে বিশেষভাবে তামাদির মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। তামাদি আইনে আইনগত অক্ষমতা বলতে নাবালকত্ব, পাগল, উন্মাদ অবস্থা বা নির্বুদ্ধিতার দরুন মামলা দায়ের করতে অসমর্থ হওয়াকে বুঝায়। এঅপারগতা সমূহ বাদীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, বিবাদীর ক্ষেত্রে নয়। বিবাদী যদি উম্মাদ, পাগল বা অক্ষম হয় তাহলে তার প্রতিকার উক্ত আইনে উল্লেখ করা হয়নি। উক্ত আইনগত অপারগতা সমূহ কেবল মূল মামলা ও ডিক্তিজারীর দরখাস্তের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়, অন্য কোন ক্ষেত্রে নয়। উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তামাদি আইনের এই অসঙ্গতিগুলো সমাধান করার জন্য, এই আইনটির আরও যুগপোযোগী, স্পষ্টীকরণ এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। কেননা সময়ের তালে বৃটিশদের এই আইন এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। যেহেতু তামাদি আইন একটি পদ্ধতিগত আইন, যা দেওয়ানী এবং ফৌজদারী উভয় ধরনের মামলামোকদ্দমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সেহেতু তামাদি আইনের এই অসঙ্গতিগুলো সমাধান করার জন্য, এই আইনটির প্রয়োজনীয় সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের আইন সংস্কার কমিটির আশু দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

লেখক : আইনবিদ, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধহৃৎপিণ্ড ও হৃদরোগ : মিশরের মমি থেকে কায়রোকার্ডিও-২০২৫
পরবর্তী নিবন্ধজয়ার সিনেমার জন্য শুভকামনা জানালেন অমিতাভ বচ্চন