দেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে ১০০তম ম্যাচ খেলছেন মুশফিকুর রহিম। যদিও টাইগার এই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার নিজেও বিশ্বাস করেননি যে, তিনি এই মাইলফলক স্পর্শ করতে পারবেন। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে শততম টেস্টে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে আজ সংবাদ সম্মেলনে আসেন মুশফিক। সেখানে মুশফিক বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ! এটা তো আসলে আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারি না… বিশেষ করে একজন বাংলাদেশি ক্রিকেটার ১০০ টেস্ট খেলবে। তো এটা সত্যিই অনেক বড় অর্জন।’ ‘শুধু আমার জন্য হয়েছে বলছি না। যে কোনো দেশের, যে কারও জন্য এটা গর্বের মুহূর্ত। অবশ্যই ভালো লাগছে যে সেই ব্যক্তিটা আমি হতে পেরেছি।’–যোগ করেন তিনি।
এই ৩৮ বছর বয়সেও দলের সবচেয়ে ফিট ক্রিকেটারদের একজন মুশফিক। অনেক সময় বরং তার অনুশীলন অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে কি না, এমন প্রশ্ন উঠেছে। তিনি বাইরের এসব আলোচনায় কান দেননি। বাইরের জীবনের হাতছানিতে ক্রিকেটের সঙ্গে আপোস তিনি করেননি খুব একটা। সাড়ে ২০ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ১০০ টেস্টের ঠিকানায় পৌঁছে পেছন ফিরে তাকিয়ে মুশফিক বললেন, জীবনের সবকিছুতেই একটি ছকে নিজেকে পরিচালনা করেন তিনি। ‘দেখুন, আমি একটা কথা বলি, সত্যি বলতে, আমি আসলে একজন বোরিং পারসন। আমি প্রত্যেকদিন অনুশীলন করিৃ যদি বলেন, একই জিনিস আমি বারবার করতে পারি। সেটা ২০ বছর হোক বা যদি বেঁচে থাকি আরও ৪০ বছর, একই কাজ করে যেতে পারি, যদি নিজের জন্য ও দলের জন্য প্রয়োজন হয়। পেশাদারিত্বে আমার কাছে কোনো ছাড় নেই। আমি একশ করি বা শূন্য, আমার এই প্রক্রিয়া চলবেই। সাফল্য আমার নিয়ন্ত্রণে নেই, কিন্তু প্রচেষ্টা, প্রক্রিয়া ও সততা তো আমার হাতে। সেটিই আমার জীবনের একমাত্র ব্রত। এটা শুধু ক্রিকেটের ক্ষেত্রে নয়, সবকিছুতেই।’
‘বাংলাদেশের হয়ে পরের টেস্ট খেলাই কঠিনতম মুহূর্ত। এটা হচ্ছে সবচাইতে বড় বাস্তবতা। ব্যাটসম্যান হিসাবে এটা ছাড়া আমার আর কোনো দিক নাই, তাই এটা সবচাইতে কঠিন দিক। প্রতিটি ইনিংস যেমন আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনি প্রতিটি ইনিংসই আবার আমার কাছে বিশেষ।’ ১০০ টেস্ট খেলার মতো বাংলাদেশের ক্রিকেটে ‘প্রথম’ জন্ম হয়েছে তার হাত ধরে। দেশের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি এসেছে তার ব্যাট থেকে। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম কিপার–ব্যাটসম্যান হিসেবে করেছেন একাধিক ডাবল সেঞ্চুরি। বাংলাদেশের হয়ে করেছেন তিনটি দ্বিশতক, একটির বেশি নেই আর কারও। ক্যারিয়ারের মধুরতম স্মৃতি হিসেবে বেছে নিলেন সেটির একটিকেই। ‘আমার মধুর মুহূর্ত সামনে টানলে আমার কাছে, যে ইনিংসটায় আমি প্রথম দ্বিশতক করেছি। আমার লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেটটাকে কিভাবে ওপরে নিয়ে যাওয়া যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার চোখের সামনে প্রত্যাশা পূরণ হবে না, ততক্ষণ আপনার বিশ্বাস জন্মাবে না। আমি দুইশ রান করার পর থেকে সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে চাইলে বড় রান করা সম্ভব।’ ক্যারিয়ারে মুশফিক কোথায় গিয়ে থামবেন সেই প্রশ্নের উত্তরে সহসাই শেষের ইঙ্গিত নেই। তবে ২০ বছর আগে যে সময় ক্রিকেট শুরু করেছেন, সেখান থেকে এই সময়ে এসে বাংলাদেশের জন্য প্রত্যাশার চেয়ে পিছিয়ে থাকা নিয়ে খানিক আক্ষেপে ঝরে তার কণ্ঠে। ‘আক্ষেপ তো যদি বলেন, এখানে আসলে উন্নতি…। মানে মানুষের চাহিদার কোনো শেষ নেই। কিন্তু সিনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে আমি টেস্ট ক্রিকেটে দীর্ঘ সময় খেলার পর আশা করি, যখন আমি দলের সঙ্গে থাকব না, তখনও বাংলাদেশ অন্তত শীর্ষ ছয় দলের মধ্যে থাকতে পারবে। এটিই আমার একটি লক্ষ্য। আল্লাহ কতটুকু পূরণ করেন, সেটা দেখা যাক।’ দীর্ঘ ক্যারিয়ারে মুশফিকুর রহিম বাংলাদেশের হয়ে ৩৪টি টেস্টে অধিনায়কত্ব করেছেন, যা দেশের ক্রিকেটে সর্বাধিক। সবথেকে বেশি ম্যাচ জেতার রেকর্ডও (৭টি জয়) তার নেতৃত্বে, যা এখনও অক্ষত। নানা সমালোচনার মুখে শেষ হয়েছিল তার নেতৃত্বের অধ্যায়। পেছন ফিরে তাকিয়ে বললেন, এটা নিয়ে আফসোস নেই তার। তবে কথায় সেই সুরটা ঠিকই ফুটে উঠল। ‘নাহ, কোনো আক্ষেপ নেই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অধিনায়ক থাকা স্বাভাবিকভাবেই চ্যালেঞ্জিং ছিল, কারণ প্রতিটি অধিনায়কের জন্য প্রয়োজন যথাযথ রিসোর্স আর স্পষ্ট নীতি, যা তখন পুরোপুরি আমাদের পেশাদারিত্বের ধারায় ছিল না। সেই প্রেক্ষাপট থেকে আমি নিজে কতটা করতে পেরেছি, তা নিয়ে নিশ্চিত না। তবু সেই দায়িত্ব নেওয়ায় নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।’ ‘চ্যালেঞ্জ অবশ্য ছিল, তবে আমার বিশ্বাস, যেকোনো অধিনায়ককে দীর্ঘ সময় দেওয়া হলে দলকে পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিচালনা করা সহজ হয়। যদি টিম ম্যানেজমেন্ট বা যারা দায়িত্বে আছেন এই দিকটায় আরও ফোকাস করে, আমি নিশ্চিত দলের ফলাফল আরও ধারাবাহিক ও শক্তিশালী হবে।’
দেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে মাইলফলক ছোঁয়ার পর দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন মুশফিক। নিজের অবসরের আগে তরুণদের তৈরী করে রেখে যেতে চান অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটার। মুশফিক বলেন, ‘আমার ওপর দায়িত্বটা এখন অন্যরকম বেশি। সেটা চেষ্টা করব। আর যে কয়টা ম্যাচই হয়তো যেভাবেই খেলতে পারি, ইনশাআল্লাহ চেষ্টা থাকবে যেন সেটার প্রতিফলন দিতে পারি। আর এর সঙ্গে যেন আমি অবসরে যাওয়ার পরেও ড্রেসিং রুমে যেন এক–দুইজন ক্রিকেটার রেখে যেতে পারি, যাতে সেই গ্যাপটা যেন পূরণ হয়ে যায় ইনশাআল্লাহ।’ মুশফিক বলেন, ‘প্রতিটি ম্যাচেই আমার চেষ্টা থাকে নিজের সেরাটা দেওয়ার, দলের জয়ে যতটা সম্ভব বড় ভূমিকা রাখার। গতকালও (বুধবার) বলেছি ক্যারিয়ার ১০০ ম্যাচ হোক বা যে কারও যে কোনো মাইলফলক, সবকিছুর আগে থাকে দলের প্রয়োজন। আমি শুধু সেটাই মনে করিয়ে দিতে চেয়েছি।’ ‘বাংলাদেশের জন্য আমি মুশফিকুর রহিম, সমুদ্রের দুই–একটা ফোঁটার মতোই। নাম বড় কি না, সেটা আসলে আলাদা বিষয়। দেশের কথাটাই আগে, দলের কথাটাই আগে। আমরা দেশের জন্য খেলি এই বার্তাটাই দিতে চেয়েছি। এই ম্যাচে জয়ই হবে আমার সবচেয়ে বড় উপহার। আমি রান করি কি না, সেটা খুব বড় বিষয় নয়। আলহামদুলিল্লাহ, ভালো লাগছে যে কিছু অবদান রাখতে পেরেছি। আর অবশ্যই চাই, যেন এই ম্যাচটা জিতি এবং সবাই মিলে উপভোগ করতে পারি।’








