আগামী ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ৫৯তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। গোটা বিশ্বে মানুষের জীবনযাত্রার ওপর এই দেশের বড় ধরনের প্রভাব থাকার কারণে এবারের নির্বাচনে কে জয় পাচ্ছেন তা প্রত্যেকের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মাত্র দুটি দলের আধিপত্য। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট। প্রেসিডেন্ট সবসময় হয়ে থাকেন এই দুই দলের কোনও একটি থেকে। রিপাবলিকান পার্টি যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল রাজনৈতিক দল। এ বছর এই দলের প্রার্থী হচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ডেমোক্র্যাট পার্টি যুক্তরাষ্ট্রের একটি উদারনৈতিক রাজনৈতিক দল। এ বছর এই দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হচ্ছেন জো বাইডেন। খবর বিডিনিউজের।
এবারের নির্বাচনের এই দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর বয়স ৭০-এর ওপরে। ট্রাম্প জিতলে তার দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হবে ৭৪ বছর বয়সে। আর বাইডেন জিতলে ৭৮ বছর বয়সে প্রথম মেয়াদে তিনি হবেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট।
জয় নির্ধারণ কিভাবে : যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থী জয়ী নাও হতে পারেন, কম ভোট পেয়েও প্রেসিডেন্ট হতে পারেন একজন প্রার্থী। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ইলেকটোরাল কলেজ নামের ২০০ বছর পুরনো একটি বিশেষ পদ্ধতির কারণেই এমনটি হয়। এই ইলেকটোরাল কলেজে যিনি ভালো করেন তার হাতেই যায় হোয়াইট হাউসের চাবি। এখানে ভোটারদের সরাসরি ভোটে না, বরং পরোক্ষ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হতে প্রার্থীকে সাধারণত দুই ধরনের ভোটে জিততে হয়। এর একটি হচ্ছে জনসাধারণের ভোট, যা ‘পপুলার ভোট’ হিসেবে পরিচিত। আরেকটি হচ্ছে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট। এই দুটির মধ্যে ইলেকটোরাল কলেজের ভোটেই প্রার্থীর জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। চার বছর আগে ট্রাম্প জয়ী হয়েছিলেন। প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন প্রায় ৩০ লাখ বেশি ভোট পেয়েও হেরেছিলেন।
ইলেকটোরাল কলেজ কী : নির্বাচনে ভোটাররা তাদের ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে একদল কর্মকর্তাকে নির্বাচিত করে থাকেন, তাদের বলা হয় ইলেকটর। এই ইলেকটররাই নির্বাচকের ভূমিকা পালন করেন। একটি রাজ্যের ইলেকটরদের একসঙ্গে ইলেকটোরাল কলেজ বলা হয়।
৫০টি রাজ্য ও রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিসহ (ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া) দেশটিতে মোট ইলেকটোরাল কলেজ ৫১টি। এই ইলেকটোরাল কলেজই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষের ভূমিকা পালন করে।
একেকটি রাজ্যে ইলেকটরের সংখ্যা একেক রকম। এটি নির্ধারিত হয় কংগ্রেসে রাজ্যের কতজন প্রতিনিধি ও সিনেটর আছেন তার বিচারে। জনসংখ্যার ওপর রাজ্যগুলোর প্রতিনিধির সংখ্যা নির্ভর করে। প্রতি ১০ বছর পর পর আদমশুমারির মাধ্যম এটি নির্ধারণ করা হয়।
সাংবিধানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সংসদের দুই কক্ষে থাকা আসনের (হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভের ৪৩৫, সিনেটের ১০০) বিপরীতে রাজ্যগুলো তাদের জন্য নির্ধারিত ইলেকটর পায়। ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার কোনও কংগ্রেস প্রতিনিধি না থাকলেও সেখান থেকে আসেন তিনজন ইলেকটর।
নির্বাচনের দিন ভোটাররা পছন্দের প্রার্থীর কথা মাথায় রেখে ভোট দিলেও আসলে তারা ৫১টি ইলেকটোরাল কলেজের ৫৩৮ জন ইলেকটর নির্বাচিত করে তাদের হাতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দায়িত্ব তুলে দেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে একজন প্রার্থীকে ৫৩৮ ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে অন্তত ২৭০টি নিশ্চিত করতে হয়। অর্ধশত রাজ্য ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার ৫৩৮ ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে ২৭০টি পেলেই হাতে আসে হোয়াইট হাউজের চাবি।
সবচেয়ে বেশি ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ায়, ৫৫টি। এরপর রয়েছে টেঙাস ৩৮, নিউ ইয়র্ক ও ফ্লোরিডায় ২৯, ইলিনয় ও পেনসিলভানিয়ায় ২০টি করে। এছাড়া ওহাইওতে ১৮, মিশিগান ও জর্জিয়ায় ১৬, নর্থ ক্যারোলাইনায় ১৫, নিউ জার্সিতে ১৪, ভার্জিনিয়ায় ১৩, ওয়াশিংটনে ১২, আরিজোনা, টেনেসি, ম্যাসাচুসেটস ও ইন্ডিয়ানায় ১১, মিনেসোটা, উইসকনসিন, ম্যারিল্যান্ড ও মিজৌরিতে ১০, অ্যালবামা, সাউথ ক্যারোলাইনা ও কলোরাডোতে ৯, কেন্টাকি ও লুইজিয়ানায় ৮, কনেটিকাট, অরিগন ও ওকলাহোমায় ৭, মিসিসিপি, আরকানস, ক্যানজাস, আইয়োয়া, নেভাডা ও ইউটায় ৬; ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, নিউ মেঙিকো ও নেব্রাস্কায় ৫; নিউ হ্যাম্পশায়ার, মেইন, রোড আইল্যান্ড, আইডাহো ও হাওয়াইতে ৪; মন্টেনা, নর্থ ডেকোটা, ভারমন্ট, ডেলাওয়ার, ওয়াইওমিং, সাউথ ডেকোটা ও আলাস্কায় ৩টি ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে।
উইনার টেইক অল : বেশিরভাগ রাজ্যে নিয়ম হলো ‘উইনার টেইক অল’। মানে কোনও রাজ্যে যদি দশটি ইলেকটোরাল ভোট থাকে, তার মধ্যে যে দল অন্তত ছয়টি, অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ ইলেকটোরাল ভোট পাবে, ওই রাজ্যের সবগুলো অর্থাৎ দশটি ইলেকটোরাল ভোটই সেই দলের বলে গণ্য হবে।
কেন এই পদ্ধতি : ১৭৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান যখন প্রণয়ন করা হয় তখন একটি জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা বাস্তবে অসম্ভব ছিল। এর কারণ ছিল দেশটির আয়তন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার পশ্চাৎপদতা। ওই সময় রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে আইনপ্রণেতাদের প্রেসিডেন্ট বেছে নেওয়ার বিষয়টি অনুমোদন করার উৎসাহও তেমন একটা ছিল না। তাই সংবিধান প্রণেতারা ইলেকটোরাল কলেজ সৃষ্টি করলেন। প্রতিটি রাজ্যকে ইলেকটর দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভূমিকা রাখার সুযোগ দেওয়া হলো। দেশজুড়ে ভোটে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চেয়ে এ পদ্ধতিতে ছোট রাজ্যগুলোর বেশি বক্তব্য রাখার সুযোগ থাকায় তারা ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি সমর্থন করল।
ভোটাররা কাকে বেশি ভোট দিলেন তা বিবেচনা না করে কিছু রাজ্যের ইলেকটররা তাদের পছন্দমতো যে কোনও প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে ইলেকটররা তাদের রাজ্যে যে প্রার্থী বেশি ভোট পেয়েছেন প্রায় সবসময় তাকেই ভোট দেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাজ্যের বেছে নেওয়া প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোট দিলে ওই ইলেকটরকে ‘অবিশ্বস্ত’ বলা হয়। আর যদি কোনো প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায় তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১২তম সংশোধনী অনুযায়ী কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ, প্রতিনিধি পরিষদ ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবে। সিনেট ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবে। তবে এ পর্যন্ত মাত্র একবার এমনটি ঘটেছিল।