চট্টগ্রামের সাংবাদিক ভুবন থেকে একজন ভালো সাংবাদিক সম্প্রতি হারিয়ে গেলেন। আশির দশকে তিনি কক্সবাজার থেকে এসে দৈনিক আজাদীর রিপোর্টিং বিভাগে যোগদানের মাধ্যমে চট্টগ্রামে তাঁর সাংবাদিক জীবন আরম্ভ করেছিলেন এবং চলতি ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক কর্মচঞ্চল জীবন অতিবাহিত করে পাড়ি জমিয়েছেন নিরুদ্দেশের পথে। যেখানে তিনি গেছেন, সেখান থেকে আর কেউ ফিরে আসে না; সেজন্য কোথায় যায় সেটা এ জগতের কেউ জানতে পারে না।
আমি যাঁর কথা বলছি, নাম না বললেও নিশ্চয়ই কারো বুঝতে বাকি নেই আমি কার কথা বলছি। অবশ্যই তিনি হেলালউদ্দিন চৌধুরী। কক্সবাজার থেকে সাংবাদিকতার সঙ্গে বাঁধা পড়েছিলো হেলালের জীবন। তবে অন্য কিছুও হতে পারতেন। শিক্ষকতায় গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামজাদা শিক্ষক, অথবা বিসিএস কোয়ালিফাই করে জনপ্রশাসনের সচিব বা অন্য কোন পেশার শীর্ষ কর্মকর্তা হলেও হতে পারতেন। কারণ ছাত্র হিসেবে ভালোই ছিলেন। কিন্তু সাগর পাড়ে আছড়ে পড়া বঙ্গোপসাগরের উথাল পাতাল ঢেউয়ের দোলায় নাচানাচি করতে বেড়ে ওঠা হেলাল একদিন বিপ্লবের ডাক শুনতে পেলে তাঁর রক্তে শুরু হয়েছিলো প্রলয়নাচন। নিশুতি পাওয়া মানুষের মতো তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন মাঠের বাঁশি শুনে। সেই বাঁশিওয়ালা ছিলেন সিরাজুল আলম খান। কক্সবাজারে তখন কৃষ্ণ প্রসাদ চৌধুরী, গর্জনিয়ার তৈয়বুল্লাহ চৌধুরী, রামুর ওবায়দুল হক, সুমথ বড়ুয়া, সদরের ছুরত আলম, প্রিয়তোষ পাল পিন্টু, এয়াকুব, শামসু, এড. আবুল কালাম আজাদ, হেলাল, কুতুবদিয়ার সিরাজ, মহেশখালীর সৈয়দ আহমদুল্লাহ, লিয়াকত আলী এবং আরো অনেকে জাসদের বিপ্লবী রাজনীতিতে দীক্ষা নিয়েছিলো।
তখন রক্ত, আগুন, অশ্রুর পাথার পেরিয়ে পূর্বে আরাকান পাহাড়ের ওপার থেকে কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে উঁকি দিচ্ছিলো বহু যুগের ওপর থেকে আসা বাঙালির স্বাধীনতা–সূর্য। তারপর তো সোনা রোদে মাখামাখি ৭১–এর ১৬ ডিসেম্বরের ঝলমলে সকালে। বিপ্লবের মন্ত্রগুপ্তি পেয়ে সেই যে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিলো হেলাল, বিপ্লবের সাময়িক উচ্ছ্বাস–উন্মাদনা খিতিয়ে আসলেও হেলালের জীবনে আর সুস্থিতি আসলো না।
অগত্যা সাংবাদিকতাই ছিলো হাতের পাঁচ; বদিউল আলম সাহেব, নুরুল ইসলাম সাহেবরা তখন সাংবাদিকতায় আলো ছড়াচ্ছেন। এই সময় প্রিয়তোষ পাল পিন্টু, আতহার ইকবালদের অনুগমন করে হেলালও সাংবাদিকতার তীরে তরী ভিড়ালেন। শুরুতে সম্ভবত সৈনিক কক্সবাজার, তারপর জাসদের দলীয় মুখপত্র দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’ বের হলে হেলাল গণকণ্ঠে যোগ দিলেন।
চট্টগ্রামের আজাদী–অধ্যায় হেলালের সাংবাদিকতার স্বর্ণযুগ। চট্টগ্রামের রিপোটিং–এর দীর্ঘ ইতিহাসে আশির দশকে হেলাল, অঞ্জন, মঈনুদ্দিন নাসের–রা (বর্তমানে আমেরিকায় বসবাসরত) নতুন মাত্রা যোগ করে। সময় একটা বড় ফ্যাক্টর। শীতকালে গাছের পাতা ঝরে ডালপালা, শুকিয়ে রুক্ষ্ম, শুষ্ক কাঠ হয়ে যায়, আবার বর্ষাকালে সবুজে আচ্ছাদিত হয়ে ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে ওঠে; তেমনি ডাল সিজনে (মন্দা, মরা মৌসুম) রিপোর্টিং হয় ম্যাড়মেড়ে, প্রাণহীন, অনুত্তেজক, পানসে, সাদামাটা; তখনো রিপোটিং আকর্ষণীয় করা যায়–যেমন প্রতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, অনিয়ম, অপচয় ইত্যাদি খুঁজে খুঁজে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের করার মতো। অনেকে প্রোডাকটিভ রিপোর্ট–এর দিকে নজর দেন। তবে সেসব রিপোর্টে মন ভরে না। ফিচারধর্মী রিপোর্ট একটা সম্ভাব্য বিকল্প হতে পারে। আর ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কিংবা দাঙ্গা–হাঙ্গামা, যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদি অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রিপোর্টারদের পোয়াবারো। আর রাজনৈতিক সংকট, মারপিট, মারমুখী মিছিল, মাঠে জ্বালাময়ী বক্তৃতা যখন শোনা যাবে তখন রিপোটির্ং–এর কদর বেড়ে যায়। হরতাল, ধর্মঘট, ব্যারিকেড, অবরোধ, অনশন, অবস্থান ধর্মঘট, লাঠিচার্জ, গুলি, ১৪৪ ধারা, কারফিউ ইত্যাদি যখন দেশের রাজনীতির নিত্য ঘটনায় পর্যবসিত হয়, তখন রিপোর্টিংয়ের গুরুত্ব ছেড়ে যায়। দক্ষ রিপোর্টাররা এই পরিস্থিতিকে তাদের রিপোর্টিংয়ের মান ও দক্ষতা বৃদ্ধির কাজে লাগান। রিপোর্টারদের মধ্যে তখন এমন একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় যে, ভালো রিপোর্টাররা ভাষার কারুকার্য দেখিয়ে ঠাসবুনুনি বাক্যে যত আবেগ, উত্তেজনা সঞ্চারিত করে রিপোর্টকে আকর্ষণীয়, হৃদয়গ্রাহী ও গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে ক্ষোভ ও উত্তেজনার পারদ চড়িয়ে দুঃখ ও শোকের অশ্রু ঝরিয়ে বেদনায় নীল হয়ে যান। রিপোর্টার তখন রিপোর্টের সাথে একাত্ম হয়ে যান, তিনি তখন আর নিরপেক্ষ থাকেন না। থাকতে চাইলেও পারেন না। যেমন ৫২–এর ২১ ফেব্রুয়ারি, ৬৯–এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১–এর ৭ মার্চ, ৭২–এর ১০ জানুয়ারি কোন বাঙালি রিপোর্টার নিরপেক্ষ ছিলেন না, থাকতে পারেন নি।
আশির দশকে তেমন একটা সময় এসেছিলো সেনাশাসক এরশাদের স্বৈরাচারি শাসনামলে। তবে ৫২, ৬৯, ৭১–এর মতো জাতীয়তা বা স্বাধীনতার প্রশ্ন তখন ছিলো না। আশির দশক ছিলো গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ের সময়। তবে একটা বিশেষ সময়; রিপোর্টিংয়ের বাহাদুরি দেখানোর সেই বিশেষ সময়ে চট্টগ্রামের সংবাদপত্র জগতে হেলালের আবির্ভাব। কার আগে কে কত বেশি নিউজ করতে পারে; কে বেশি নিউজ ব্রেক করতে পারে–এমনি একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা ছিলো রিপোর্টারদের মধ্যে; সেই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে ছিলেন হেলাল, অঞ্জন।
আমাদের চট্টগ্রামের রিপোটিং–এর ইতিহাস বেশ দীর্ঘ, ঐশ্বর্যময় তার অতীত। পাকিস্তান আমলে আজাদ–এর নুরুল ইসলাম চৌধুরী, এপিপি ও অবজারভার–এর ফজলুর রহমান, এবিএম মুসা, আতিকুল আলম, এপিপি’র নুরুল ইসলাম, পূর্বদেশ–এর নুরুল ইসলাম, ইত্তেফাক–এর মঈনুল আলম, দৈনিক বাংলার সায়ফুল আলম, ছৈয়দ মোস্তফা জামাল, জয়নাল আবেদীন (ইনকিলাব), রফিক ভূঁইয়া এবং আরো যাঁদের নাম অজ্ঞতার কারণে উল্লেখ করতে পারলাম না, তাঁরা। স্বাধীনতার পর সৈয়দ মুর্তাজা আলী, ইমামুল ইসলাম লতিফী, নাসিরুল হক, এটিএম মোদাব্বের, জাহিদুল করিম কচি, মোহাম্মদ বেলাল, বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া, স্বপন মহাজন, ওসমান গণি মনসুর, নুরুল আমিন, তমাল চৌধুরী, নুরুল আলম, এনামুল হক চৌধুরী, রণজিত কুমার বিশ্বাস (পরবর্তীকালে সচিব), ও শাহাদাত হোসেন চৌধুরী (ডেইলি লাইফ), আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া, আখতার উন নবী, আমানউদ্দীন খান, প্রদীপ খাস্তগীর, নিজামউদ্দিন আহমদ, মোস্তাক আহমদ, পংকজ দস্তিদার, শামসুল হক হায়দরী, অঞ্জন কুমার সেন, মোশাররফ হোসেন (বর্তমানে কানাডা প্রবাসী), হেলাল উদ্দিন চৌধুরী, সিরাজুল করিম মানিক, কামরুল ইসলাম (খবর, সংবাদ), হেলাল হুমায়ুন, শফিউল আলম, বিশ্বজিত চৌধুরী, ফারুক ইকবাল, ওমর কায়সার, শহীদুল ইসলাম বাচ্চু, সৈয়দ আবদুল ওয়াজেদ, ইকবাল করিম হাসনু, নাসির উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, নওশের আলী খান, অনুপ খাস্তগীর, তৌফিকুল ইসলাম বাবর, শামসুদ্দিন হারুন, সাইফুদ্দিন বাবুল, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, কাশেম মাহমুদ খোকন, জাকির হোসেন লুলু, শহীদুল ইসলাম এবং আরো যাঁরা অনুল্লেখিত থেকে গেলেন তাঁরা।
রিপোর্টার হিসেবে হেলালের যে বৈশিষ্ট্য অভিজ্ঞ লক্ষ্য করেছি, তা হলো তিনি খুবই সৎ, পরিশ্রমী, সাহসী সাংবাদিক ছিলেন। সাংবাদিক জীবনের প্রারম্ভেই তাঁর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা, খেটে খুটে দৌড়ঝাঁপ করে রিপোর্ট তৈরি করার বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, হাবিবুর রহমান খান, সাধন কুমার ধর, বিমলেন্দু বড়ুয়া, নজির আহমদ– চট্টগ্রামের এসব দিকপাল সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁদের মুখে হেলালের রিপোর্টিংয়ের প্রশংসা আমি শুনেছি। স্বৈরাচারবিরোধী রাজনৈতিক ও রক্তাক্ত ছাত্র আন্দোলনের জন্য আশির দশক স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তখন একদিকে আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দল সমূহের তিনটি জোট–১৫ দল, ৭ দল ও ৫ দল এবং সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের প্রায় প্রতিদিনই রাজনৈতিক সভা–মিছিল ও হরতাল, অবরোধ ইত্যাদি আন্দোলনের কর্মসূচি থাকতো।
অঞ্জন, হেলাল এ সব কর্মসূচির প্রতিটিতেই উপস্থিত থাকতো এবং তাদের নিজ নিজ পত্রিকায় ফলাও করে নিউজ পরিবেশন করতো। তাঁরা এ সময় রাজনৈতিক কর্মীর ন্যায় পার্টিজান হয়ে সমস্ত কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতেন। এরপর মহিউদ্দিন চৌধুরীর আন্দোলন ৯১–এর ঘূর্ণিঝড়ের পর দুর্গত মানুষের সেবায় মহিউদ্দিন চৌধুরীর দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম, রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা হাজার হাজার মানুষের লাশ সংগ্রহ করে গোসল করিয়ে কাপড় পরিয়ে খাটিয়া বহন করে কবরস্থানে নিয়ে লাশ দাফন করা–এ সমস্ত কাজ মহিউদ্দিন চৌধুরী নিজ হাতে করতেন। পরে ডায়রিয়া রোগ দেখা দিলে তিনি তাদের চিকিৎসার জন্য দারুল ফজল মার্কেটের আওয়ামী লীগ অফিসে ফিন্ড হাসপাতাল, পরে রোগীর সংখ্য বাড়তে থাকলে মুসলিম হলে স্থানান্তর করে তাদের চিকিৎসা, সেবা–শুশ্রূষার ব্যবস্থা করেন, তাদের স্যালাইনের প্রয়োজন মেটানোর জন্য স্যালাইন তৈরির প্রকল্প চালু করেন। মহিউদ্দিন চৌধুরীর এই মানবিক কর্মযজ্ঞ ও ত্রাণ তৎপরতার খবর পরিবেশনে অঞ্জন–হেলালের বিশ্রাম ছিলো না। বন্দরটিলায় স্থানীয় জনগণের সাথে ভুল বোঝাবুঝির ঘটনায় নৌবাহিনীর গুলিবর্ষণে হতাহত মানুষের পাশে নিয়ে দাড়িয়েছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। সে নিউজ পূর্বকোণ আজাদীতে বিশ্বস্ততায় সাথে পরিবেশন করেছিলেন অঞ্জন, হেলাল। মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রথম মেয়র নির্বাচনে নাগরিক কমিটি গঠনের সঙ্গে অঞ্জন, হেলালের সংশ্লিষ্টতা ছিলো। বন্দরে মহিউদ্দিনের এমএসএ বিরোধী আন্দোলনের মুখপত্র ছিলো আজাদী–পূর্বকোণ। হেলাল, অঞ্জনের কারণেই সেটা সম্ভব হয়েছিলো। অবশ্য এ সময় কামরুল পূর্বকোণের হয়ে এসএসএ বিরোধী আন্দোলনের সংবাদ পরিবেশনে অবদান রেখেছিলো। শুধু আওয়ামী লীগ বা মহিউদ্দিন নয়, তাঁরা মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল নোমান, মীর নাছির, মোর্শেদ খান, আমীর খসরু, কর্নেল অলি’র সংবাদও যথাযথভাবে পরিবেশন করে সৎ ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার নজির স্থাপন করেছে। চট্টগ্রামে সংবাদ কর্মীদের ইতিহাস যদি কখনো লেখা হয়, তাহলে সেখানে হেলালের জন্য একটি বিশিষ্ট স্থান সংরক্ষিত থাকবে। ভালো ও দক্ষ রিপোর্টারদের তালিকা যদি কখনো করা হয়, সেখানেও হেলালউদ্দিন চৌধুরী অগ্রভাগেই অবস্থান করবেন। হেলালের শোকাভিভূত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।
লেখক : সাংবাদিক, সংস্কৃতি সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা