দলিল শব্দের অর্থ-কোন বিষয়ের লিখিত প্রমাণ এবং এর ইংরেজি প্রতিশব্দ উববফ, তবে ভাষাগত প্রয়োগের কারণে উববফ এর বাংলা প্রতিশব্দ অনেক ক্ষেত্রেই “পত্র” বা “নামা” হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। যেমন উববফ ড়ভ এরভঃ হলো ‘দান পত্র’, উববফ ড়ভ চধৎঃরঃরড়হ হলো ‘বন্টননামা’ বিভিন্ন প্রকার দলিলের উদ্ভবের বিষয়ে ইংল্যান্ডের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দু’রকম উববফ বা দলিলের সন্ধান মেলে। একটি “ডিডপোল” এতে একটি মাত্র পক্ষ থাকে। যেমন- অছিয়ত নামা, উইল ইত্যাদি। পক্ষান্তরে “ইনডেনচার” এ অন্যূন দু’টি পক্ষ থাকে। যেমন- হেবা ঘোষণার দলিল, দান পত্র দলিল, সম্পত্তি হস্তান্তর দলিল ইত্যাদি। রেজিস্ট্রাশন আইনে সম্পত্তি হস্তান্তর করার ক্ষেত্রে যে সকল দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রেশন করা আবশ্যক সেগুলো হলো স্থাবর সম্পত্তির দানপত্র, হেবানামা দলিল, লীজ দলিল, এওয়াজনামা বা বিনিময় দলিল, অছিয়তনামা, ছাফ বিক্রয় কবলা, ওয়াকফ্ দলিল, অংশনামা দলিল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আমমোক্তারনামা, নাদাবী, মুক্তিনামা, পাট্টা (ভূমিস্বত্বের দলিল), কবুলিয়াত (চুক্তি দলিল) ইত্যাদি স্বত্ব হস্তান্তর দলিল নয়। বন্ধক দলিলকে হস্তান্তর দলিল বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এটা সম্পত্তির ঋণের অতিরিক্ত সহায়ক জামানত হিসেবে ঋণ দাতা বা বিনিয়োগ প্রদানকারী এই বিধানের বরাবরে নির্দিষ্ট শর্তে দায়াবদ্ধ করে রাখার নাম। সাধারণ মানুষেরা হেবা, দান, ওয়াক্ফ ও অছিয়ত বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা না থাকায় নানা সমস্যায় পতিত হয়। এ জন্য এখানে এ চারটি দলিল সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেয়া হলো।
হেবা এবং দান-হেবা শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো অন্যের প্রতি অনুগ্রহ করা। এর সাধারণ অর্থ দান। কোন মূল্য ব্যতীত স্বেচ্ছায় অন্যকে সম্পত্তির মালিক বানিয়ে দেয়াই হচ্ছে হেবা। হেবা সুস্পষ্ট ও সুউচ্চারিত হতে হবে। সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১২২ ধারা অনুযায়ী স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে কোন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তির বরাবরে বিনাপণে কোন স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর করাকেই দান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ঐ ধারা অনুযায়ী দান লিখিত, সাক্ষী দ্বারা সমর্থিত এবং রেজিস্ট্রীকৃত হতে হবে। এখানে দখল প্রমাণের বিষয়টি এতটা প্রাধান্য পায় না। কিন্তু সম্পত্তি হস্তান্তর আইন হেবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। দান বা হেবায় তিনটি উপাদান অবশ্যই থাকতে হবে, তাহলো- (১) দাতা কর্তৃক দখল করার প্রস্তাব (২) গ্রহীতা কর্তৃক তা গ্রহণের সম্মতি (৩) দানকৃত সম্পত্তির দখল বুঝে নেওয়া। অন্তত দু’জন সাক্ষী দ্বারা দান প্রত্যয়িত হওয়া প্রয়োজন। মুসলিম আইন অনুযায়ী উপরোক্ত কার্যাদি সম্পাদিত হলেই দান সম্পন্ন হয়ে যায়। দান এবং হেবা দুটি শব্দে কিছু পার্থক্য বিদ্যমান।
একজন সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি তাঁর সমুদয় সম্পত্তি বা সম্পত্তির যেকোনো অংশ যে কাউকে হেবা করতে পারেন। সম্পত্তির আয় জীবনকালীন ভোগ করার অধিকার হেবা করা যায়। মুসলিম আইন অনুযায়ী একই ওরশজাত ও গর্ভজাতের মধ্যে মোট ১৪ জন ব্যক্তিকে হেবা করা যায় যেমন- স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা, সহোদর ভাই-বোন, দাদা-দাদী, নানা-নানী, আপন নাতি-নাতনী প্রমুখ। হেবা ঘোষণার দলিল সম্পাদন করার ক্ষেত্রে নন-জুডিসিয়াল ২০০ টাকার স্ট্যাম্প সাথে ২০০ টাকার শপথনামা প্রদান করতে হয়।তবে দানপত্র দলিল সম্পাদন করার ক্ষেত্রে দলিলের মূল্যমানের উপর ১.৫% স্ট্যাম্প ফি সহ মোট ৪.৫% পে-অর্ডার মাধ্যমে সরকারি ফি পরিশোধ করতে হয়। বর্তমানে হিন্দুদের ক্ষেত্রেও হেবার হলফনামা রেজিস্ট্রি বিধান চালু হয়েছে। ফলে তারাও কম খরচে নিকটতম আত্মীয়দের মধ্যে হেবার ঘোষণা দলিল রেজিস্ট্রি করতে পারে।
দান বা হেবা কে করতে পারে : সুস্থ মস্তিষ্কের এবং নাবালক নয় এমন প্রত্যেক মুসলমানই দান বা হেবা দ্বারা সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারে। এর অর্থ হচ্ছে কোন নাবালক বা মানসিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তি হেবা দাতা হতে পারে না। মারজ-উল-মওত বা মৃত্যুশয্যায় দান বা হেবা করা জায়েয নয়। এই অবস্থায় কেউ হেবা করলে তার এক-তৃতীয়াংশের উপর কার্যকর হবে।
যেসব বস্তু হেবা করা যায় এবং যা করা যায় না : সাধারণত হেবা দুই প্রকার। হেবা-এ-তামলীক, হেবা-এ-ইসকাত। যে কোন বৈধ সম্পত্তি হেবা করা যায়। সেটা স্থাবর সম্পত্তিও হতে পারে বা অস্থাবর সম্পত্তি হতে পারে। যে সম্পত্তি ভাগ করা যায় না এবং ভাগ করা হলে তা আর ব্যবহারযোগ্য থাকে না, এ জাতীয় অবিভক্ত ও অবিভাজ্য সম্পত্তিও হেবা করা যায়। কিন্তু বন্টনযোগ্য সম্পত্তি বন্টন না করে হেবা করলে ঐ হেবা সহীহ হবে না। তবে যে সম্পত্তি বন্টন করা যায় না এ জাতীয় অবিভক্ত সম্পত্তি হেবা করতে হলে শর্ত হলো এর পরিমাপ জানা থাকতে হবে। যদি পরিমাপ জানা না থাকে তাহলে হেবা জায়েজ সহি-শুদ্ধ হবে না।
ওয়াকফ : ওয়াকফ শব্দটি আরবি। এটি হাবুস নামেও পরিচিত ইসলামী আইন শাস্ত্রে সাধারণত একটি ভূমি, ভবন বা সম্পদ ধর্মীয় বিষয়ের প্রতি মানসিকতা রেখে দাতব্য প্রতিষ্ঠান তৈরির উদ্দেশ্যে দান করাকে ওয়াকফ হিসেবে চিহ্নিত করে। ওয়াকফকৃত সম্পদ ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত হয়। এই ধরনের দানশীল ব্যক্তি ওয়াকিফ বা দাতা হিসাবে পরিচিত। ওয়াকফ হলো নিজের মালিকানাধীন সম্পদকে আল্লাহর মালিকানায় নিবেদিত করা। এর মাধ্যমে এ সম্পদের মালিকানা ব্যক্তির কাছ থেকে বিলুপ্ত হয়। যে সম্পদ থেকে তিনি বা তার বংশধর কোনো মুনাফা ফিরে পেতে পারে না।
ওয়াকফ দুই প্রকার- ওয়াকফ বি সাবিলিল্লাহ (সম্পূর্ণ আল্লাহর রাস্তায় ব্যবহারের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত), ওয়াকফ আল আওলাদ (আল্লাহর ওয়াস্তে ওয়ারিশেরা সুবিধাভোগী হবেন) সম্পত্তি বেচা কেনে করা যায় না। তবে ওয়াকফ প্রশাসনের অনুমতিক্রমে উন্নয়নের স্বার্থে অথবা অধিক লাভজনক কারণে বিক্রি করা যায়। ওয়াকফ সম্পত্তি ওয়াকফ প্রশাসনের কার্যালয়ে তালিকাভুক্ত করতে হয়, না করা একটি ফৌজধারী অপরাধও বটে।
ওয়াকফ প্রশাসন : সাধারণত ওয়াকফ পরিচালনা জন্যে রাষ্ট্রীয় কিছু বিধান ও প্রতিষ্ঠান থাকে। সেখানে একজন প্রশাসক নিযুক্ত থাকেন। (মুতাওয়াল্লি বা আইয়াইম নামক) নিয়োগ করে এবং পরবর্তী প্রশাসক নিয়োগের জন্য নিয়মগুলো নির্ধারণ করে। প্রতিষ্ঠাতা নিজের জীবনকালে ওয়াকফ পরিচালনা করতে পারেন। কিছু ক্ষেত্রে, তবে, সুবিধাভোগী সংখ্যা বেশ সীমিত। সেক্ষেত্রে প্রশাসক ছাড়াও সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান নিজেদের ওয়াকফের যত্ন নিতে পারে। ইসলামী আইনের অধীনে ওয়াকফ প্রশাসক দায়িত্বশীল অন্যান্য ব্যক্তিদের মতো, আইন ও চুক্তি করার ক্ষমতা থাকতে হবে। উপরন্তু, বিশ্বস্ততা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা প্রয়োজন হয়। ইসলামী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রশাসক মুসলিম হওয়া শর্ত জুড়িয়ে দিয়েছেন। তবে হানাফি মাজহাব এর প্রয়োজনীয়তা গুরুত্ব দিয়েছেন।
বিলুপ্ত : ওয়াকফ চিরস্থায়ী হতে এবং চিরতরে স্থায়ী উদ্দেশ্যে করা হয়। তা সত্ত্বেও, ইসলামী আইনটি এমন শর্তগুলোর উপর নজর রাখে যার অধীনে ওয়াকফ বাতিল করা যেতে পারে।
অছিয়ত : ইসলাম ধর্মানুসারী কোন ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় তার সম্পত্তির মালিকানা বা ব্যবস্থাপনা সম্পর্কের তার মৃত্যুর পর কার্যকর হবে- এরূপ আইনসম্মত ঘোষণাপত্র বা সিদ্ধান্তমূলক পত্রকে অছিয়তনামা বলে। অছিয়ত কার্যকর হয় অছিয়তকারীর মৃত্যুর পর। একজন মুসলমান তার সমুদয় সম্পত্তির তিন ভাগের এক ভাগের বেশি উত্তরাধিকার নয় এমন কাউকে উইল করতে পারে না। তবে উত্তরাধিকারদের মধ্যে মোট সম্পত্তির তিন ভাগের এক ভাগের বেশি উইল করতে পারে। ১৯৯৬ সালের হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ মোতাবেক আইনত বৈধ। অছিতনামার দলিলের জন্য কোন নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্প নেই অর্থাৎ সরকারি কোন পে-অর্ডার দিতে হয় না। দলিলটি কার্টিজ পেপারে প্রিন্ট করতে হয়। রেজিস্ট্রির সময় ২০০ টাকার শপথনামা দিতে হয়।
অছিয়তের শর্ত
১। অছিয়তকারী তার সকল সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশের বেশি অছিয়ত করতে পারবেন না। ২। অছিয়ত, অছিয়ত দাতার মৃত্যুর পর কার্যকরী হয়। ৩। সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন যে কোন সাবালক ব্যক্তি উইল করতে পারেন। ৪। অছিয়তকারীর ইচ্ছা সুস্পষ্ট ও সঠিকভাবে নির্ণয়যোগ্য হতে হবে। ৫। অছিয়ত যে কেউ গ্রহণ করতে পারেন।
উইলে বিকল্প অর্পণ
একটি বিকল্প উইল বা উইলে বিকল্প অর্পণ বৈধ। এক ব্যক্তি তার কন্যার বরাবরে উইলে সম্পত্তি প্রদান করলো এবং তার মৃত্যুর সময় কন্যা মৃত থাকলে কন্যার সন্তানগণ সম্পত্তি পাবে। এই ধরনের উইল বৈধ এবং কন্যার মৃত্যুর কারণে তার সন্তানগণ উইল মূলে সম্পত্তি প্রাপ্ত হবে। মৌখিকভাবে উইল করা হলে উইলের সাক্ষীদের সহকারী কমিশনার (ভূমি) নোটিশ দিয়ে ডেকে পাঠাবেন। হাজির হলে তাদের জবানবিন্দ নিয়ে উইলের সত্যাসত্য যাচাই করে মিউটেশন করে দিতে পারবেন। উইল করা হলে উইলকারীর মৃত্যু না হলে উইল গ্রহীতার নাম কোন অবস্থাতেই মিউটেশন করে দেয়া যাবে না। উইলকারীর মৃত্যুর পরই উইল কার্যকরী হয়।
ওয়ারিশগণ না মানলে উইল দলিল হয়ে যায়। তবে ওয়ারিশগণের উচিৎ অছিয়তকারীর অছিয়তকে সম্মান করা। উপরের আলোচনায় আশা করি হেবা, দান, ওয়াকফ ও আছিয়তনামা সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যাবে।
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সু-শাসন কর্মী