হৃদয় দিয়ে হৃদরোগ মোকাবেলা

বিশ্ব হার্ট দিবস ২০২০

অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার দাশ | মঙ্গলবার , ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০ at ৪:৪৮ পূর্বাহ্ণ

আজ ২৯ শে সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট দিবস, ইংরেজি হার্ট (যবধৎঃ) মানে হৃদয় এবং হৃদপিণ্ডদু’টোই বোঝায়। তবে শব্দ দু’টোর মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। হৃদয়হীন মানুষ হতে পারে কিন্তুু হৃদপিণ্ডহীন মানুষ অকল্পনীয়। হৃদয় জিনিসটা কি? তা এক কথায় বোঝানো শক্ত বটে। হৃদপিণ্ড হচ্ছে বুকের মধ্যে স্পন্দনশীল রক্ত সঞ্চালক অঙ্গ। ত্রিকোণাকৃতির এই মাংসপিণ্ড অবিরাম, অবিশ্রাম সমস্ত শরীরে রক্ত তথা অঙিজেন সঞ্চালনের কাজে নিয়োজিত । সবল অথচ সংবেদশীল এই হৃদপিণ্ড ব্রুণাবস্থা থেকে আমৃত্যু অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে রক্ত পাম্প করে যায়। হৃদপিণ্ড প্রথম অঙ্গ যা মানবশরীরে কাজ শুরু করে। বস্তুত মানবভ্রুণে হৃদস্পন্দনই প্রাণের অস্তিত্ব নির্দেশ করে। তাই হার্ট এর আভিধানিক অর্থ হৃদয়, হৃদপিণ্ড, মন, প্রাণ ইত্যাদি। হৃদপিণ্ড থেমে যাওয়া মানে প্রাণের স্পন্দন লোপ।

তবে হৃদপিণ্ড শুধু চার প্রকোষ্টের একটা অঙ্গ নয়। তার সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে মানুষের আবেগঅনুভূতি। এটা চিরন্তন বিশ্বাস যে, হৃদপিণ্ড আবেগের উৎস, ভালোবাসার উৎপত্তিস্থল, সাহসের ঠিকানা ও আত্মার আশ্রয়। মহান ব্যক্তিগণ বিশাল হৃদয়ের অধিকারী আর কঠোর ব্যক্তি হৃদয়হীন। প্রথম প্রেমে হৃদয়ই প্রথম সাড়া দেয়। দুর্ভাগ্যবশত তা ভেঙে গেলে হৃদয়টাই ভেঙে যায়। আমরা শেষকৃত্যে যাই ভারী হৃদয়ে এবং হৃদয়ের অন্তস্থলের সমবেদনা জ্ঞাপন করি। এভাবে হৃদপিণ্ড মানুষের আবেগের সাথে গভীরভাবে সম্পর্ক যুক্ত। বিভিন্ন কৃষ্টি ও ধর্ম বিশ্ব্বাসেও তা উদ্ধৃত হয়েছে। আন্তব্যক্তিক সম্পর্কেও এই যোগসূত্র প্রত্যক্ষভাবে ক্রিয়াশীল। মানুষের হৃদয় উৎসারিত আবেগ অন্যের হৃদয়কে নাড়া দেয়। কেউ প্রশংসা বাক্য শুনলে কিংবা কারো মধ্যে কৃতজ্ঞতাবোধ জাগ্রত হলে তাৎক্ষণিকভাবে তা হৃদক্রিয়ার উপর প্রভাব ফেলে। এতে হৃদস্পন্দন মন্থর ও হৃদক্রিয়া ছন্দায়িত হয়ে বুকে এক ধরনের প্রশান্তি তথা ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি হয়। এইভাবে হৃদয় আর হৃদপিণ্ড একসূত্রে আবদ্ধ। এ যেন ‘হার্ট টু হার্ট’।

চলমান কোভিড মহামারীতে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের প্রায় সব দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এক অভাবনীয় সময় পার করছে। এই পরিস্থিতি আমাদের পারিবারিক সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দায়িত্ব বোধের এক নতুন ও পরিবর্তিত ক্ষেত্র উম্মেচিন করেছে। তা আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। কোভিড মহামারীতে হৃদপিণ্ডের শুুশ্রূষা ও সুস্থতা বিধান অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হৃদরোগীদের এই রোগে অধিকহারে সংক্রমণ, তাদের সংক্রমণ জনিত উচ্চ মৃত্যুহার এবং কোভিড সৃষ্ট হৃদরোগ তার অন্যতম কারণ। অন্যদিকে এই মহামারী সৃষ্ট ভীতি হৃদরোগ চিকিৎসা সেবা ব্যাহত করছে বিভিন্নভাবে। তাঁর শুরুর দিকে হৃদরোগীরা কোভিড আক্রান্ত হয়ে পড়ার ভয়ে হাসপাতাল এড়িয়ে চলেছে এবং ভর্তি হতে অনীহা দেখিয়েছে। হৃদরোগসৃষ্ট শ্বাসকষ্ট কোভিডে ফুসফুস সংক্রমণের কারণে বলে ভ্রম হয় এবং এ রোগীকে আলাদা ব্লকে রেখে চিকিৎসা দান ও তাঁর কোভিড ভাইরাস সংক্রমণ নিশ্চিত হবার প্রয়োজন দেখা দেয়। আবার কোভিড সংক্রমিত হৃদরোগীদের ইকোকার্ডিওগ্রাফী, এনজিওগ্রাফী ও ইন্টারভেনশনাল চিকিৎসার জন্য আলাদা ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন হয়। অপ্রত্যাশিত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধেই তা জরুরি। যান্ত্রিক ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে তা প্রায়শ: সম্ভব হয়ে উঠে না। চিকিৎসকদের উল্লেখযোগ্য অংশ কোভিড আক্রান্ত হয়ে পড়া ও মৃত্যুবরণ করাও হৃদরোগ সেবা দানের ক্ষেত্রে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে। এই প্রেক্ষাপটে এবারের বিশ্ব হার্ট দিবস বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সারা বিশ্বে মৃত্যুর প্রধান কারণ হৃদরোগ। কোভিড মহামারীতে হৃদরোগ জনিত মৃত্যুঝুঁকি আরো বেড়েছে। এই অবস্থায় হৃদরোগ চিকিৎসাসেবা নির্বিঘ্ন রাখা না গেলে এই ঝুঁকি আশংকাজনক পর্যায়ে পৌঁছাবে। এসব বিবেচনায় বিশ্ব হার্ট দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘হৃদয় দিয়ে হৃদরোগ মোকাবেলা’ প্রণিধানযোগ্য। হৃদয় উৎসারিত বিভিন্ন উদ্যোগ হৃদরোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গৃহীত হতে পারে।

পারিবারিক :

হৃৎহিতকর খাবার, খাবারের উপাদান ও প্রস্তুতপ্রণালী স্বাস্থ্য সম্মত রাখ। হৃদয়ের ছোঁয়ায় কম তেল ও কম চর্বির খাবারও মুখরোচক হয়ে উঠবে। স্কুল টিফিনে ফাস্ট ফুডের পরিবর্তে ফল, সবজী, কোমল পানীয়ের পরিবর্তে পানি, কম ননী যুক্ত দুধ, তাজা ফলের রস।

গৃহ পরিবেশ ধূমপানমুক্ত রাখা, অ্যালকোহল বর্জন, কোভিডসৃষ্ট দীর্ঘ গৃহ অবস্থান ধূমপান, অ্যালকোহল ব্যবহার ক্ষেত্রবিশেষে বাড়িয়ে দিয়েছিল। এগুলো হৃদরোগ ও কোভিড সংক্রমণের ঝুঁকি দু’টোই বাড়ায়।

শান্তি ও ভালোবাসাপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা । দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকা, পরিমিত বিশ্রাম নিশ্চিত করা।

অবসর সময়ে টেলিভিশন, কম্পিউটার ও মোবাইলে বেশি সময় ব্যয় না করে কর্মমুখর থাকা।

নিয়মিত ব্যায়ামকোভিড পরিস্থিতিতে ঘরের বাইরে ব্যায়াম সম্ভব না হলেও ঘরের মধ্যে নিয়মিত হাঁটা, উঠবস, ট্রেডমিলে দৌঁড়ানো। এতে হৃৎপিণ্ডের সাথে ফুসফুসও সবল থাকে।

চিত্ত বিনোদনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়াও বইপড়া, গান শুনা।

মেডিটেশনতা দুশ্চিন্তামুক্ত করেও মনোবল বৃদ্ধি করে।

নিয়মিত চেক আপকোভিড ভীতি যাতে এটা ব্যাহত না করে। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ হার্ট অ্যাটাকের মৃত্যুঝুঁকি কোভিড জনিত মৃত্যুঝুঁকির চেয়ে অনেকগুণ বেশি। তাই হার্ট অ্যাটাক হলে কালবিলম্ব না করে সিসিইউতে ভর্তি জরুরি।

সামাজিক উদ্যোগ : চলমান কোভিড পরিস্থিতিতে সমাজ অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছে। সমাজের সবাই একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে। একইভাবে হৃদরোগ মোকাবেলায়ও সামাজিক উদ্যোগ ফলপ্রসূ।

সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থাপার্কে, খোলা জায়গায়, সমুদ্র সৈকতে। তা টেনশন মুক্তিতে কার্যকর।

কর্মক্ষেত্র ধূমপান মুক্ত রাখা। হৃৎ হিতকর খাবার পরিবেশন, ব্যায়াম, ফিটনেস কার্যক্রম গ্রহণ।

সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কার্যক্রম গ্রহণ। বিশ্ব হার্ট দিবস, উচ্চ রক্তচাপ দিবস, ডায়াবেটিস দিবস উদযাপনে সামজিক কর্মসূচি গ্রহণ।

ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে হৃৎসুস্থতার বার্তা প্রচার ও জনসচেতনতা সৃষ্টি।

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ:

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর মাধ্যমে হৃদরোগ ও তার বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান।

ধূমপান না রোধী আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

খাদ্যমান নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিএসটিআই) তৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে হৃৎ হিতকর খাবারের বিজ্ঞাপন ও বিপনন উৎসাহিত করা।

জাতীয়ভাবে বিশ্ব হার্ট দিবস পালনের মাধ্যমে জনগণের কাছে হৃদরোগ প্রতিরোধের বার্তা পৌঁছানো, প্রাণঘাতী হৃদরোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি।

আন্তর্জাতিক:

কোভিড পরিস্থিতিতে হৃদরোগ চিকিৎসা ও তার প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সোসাইটির নির্দেশনা প্রদান।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক কোভিড সংক্রমণে হৃদরোগের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অবহিত করা।

বিশ্ব হার্ট দিবস সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিষয়ক দিবসে কোভিড পরিস্থিতি ও হৃদরোগকে গুরুত্ব দিয়ে কর্মসূচি গ্রহণ।

গবেষণা কোভিড ও হৃদরোগের বিভিন্ন দিক উন্মোচন ও তা প্রকাশ।

পরিশেষে, বিশ্ব হার্ট দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য হৃদয়ের জয়গান গায়; হৃদয় দিয়ে হৃদরোগ মোকাবেলার বাণী প্রচার করে। এই হৃদয়ের শক্তি অপরিসীম। তা হৃদরোগের ওষুধ, ইন্টারভেনশন কিংবা শল্য চিকিৎসার চেয়েও অধিক শক্তিশালী। তা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে; মানুষের মনে আশা জাগায়। হৃদরোগ মোকাবেলার পাশাপাশি এ দিবস ভারী হৃদয়ে সহমর্মিতা জ্ঞাপন করে কোভিড চিকিৎসায় জীবন উৎসর্গকারী চিকিৎসকদের স্মৃতির প্রতি, এ দিবস হৃদয়ের অন্তস্থলের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে কোভিড মোকাবেলায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স, সর্বস্তরের স্বাস্থ্য কর্মীদের এবং তার প্রতিষেধক ভ্যাঙিন আবিষ্কারে নিয়োজিত বিজ্ঞানীদের।আসুন আমরা সবাই বিশ্ব হার্ট দিবসের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে হৃদরোগ ও কোভিড মোকাবেলা করি। সবার জন্য সুস্থ, উৎপাদনশীল দীর্ঘ জীবন নিশ্চিত করি।

লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, হৃদরোগ বিভাগ,

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআগামীর নতুন বিশ্ব : দক্ষ, পেশাদারত্ব এবং প্রযুক্তির
পরবর্তী নিবন্ধমেক্সিকোয় বারে ১১ জনকে হত্যা