আমরা কী জানি? বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১৭.৯ মিলিয়ন মানুষ শুধু হৃদরোগের কারণে মারা যায়। কিন্তু কেন এই মৃত্যু, কি–ই বা তার কারণ ?
ক) প্রধান পরিবর্তনযোগ্য কারণগুলো (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রিপোর্ট, ২০০২ অনুযায়ী) :
১। আচরণগত কারণ : তামাকের ব্যবহার, শারীরিক পরিশ্রম না করা, অস্বাস্থ্যকর ডায়েট (ফল ও শাক–সবজি কম খাওয়া; বেশি মাত্রায় লবণ এবং তেল গ্রহণ), ক্ষতিকারক অ্যালকোহল গ্রহণ। ২। চিহ্নিত জৈবিক কারণ : অতিরিক্ত ওজন, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, রক্তে অস্বাভাবিক চর্বি বৃদ্ধির ফলে মোট চর্বির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া,
খ) অ–পরিবর্তনযোগ্য কারণ : বয়স বৃদ্ধি, লিঙ্গ, বংশগত বা পারিবারিক ইতিহাস, জাতি বা জাতিসত্তা।
বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩১% মানুষ হার্ট ডিজিজে আক্রান্ত, কারণ হল– অস্বাস্থ্যকর ডায়েট, কম ফলমূল এবং শাক–সবজি গ্রহণ, বেশি মাত্রায় লবণ এবং অতিমাত্রায় তেলের ব্যবহার। আমাদের দেশে ৯৫.৭ % মানুষ গড়ে দিনে পর্যাপ্ত ফল বা শাক–সবজি গ্রহণ করেন না। ফল ও শাক–সবজি কম গ্রহণের ফলে আক্রান্ত রোগী প্রায় ৮৫ %। এছাড়াও ক্ষতিকারক তেল ও চর্বি এবং লবণ বেশি খাওয়ার ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে।
যারা সঠিক খাদ্যাভাস মেনে চলেন না তাঁদের মধ্যে হৃদরোগের বিভিন্ন রকম লক্ষণ দেখা যায় সেই অনুযায়ী তারা হয়তো চিকিৎসাও গ্রহণ করেন। কিন্তু চিকিৎসার পাশাপাশি যে কি খাচ্ছি কখন খাচ্ছি তাও জরুরি, তা ভুলে গেলে চলবে না। বিশেষত যারা বাইপাস সার্জারি করেছেন তাদের মধ্যে একটি ভুল ধারণা হলো তাদের খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো নিষেধ নেই, ফলে আবার হার্টে ব্লক হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। আসুন জেনে নেই সুস্থ থাকতে কি করতে হবে : স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়ন্ত্রিত ওজন এবং সুশৃক্সখল জীবনধারা হল সুস্থ থাকার প্রধান হাতিয়ার। খাবার অভ্যাসের পাশাপাশি নিজেকে শারীরিকভাবে সক্রিয় রাখতে হবে এবং নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস তৈরি করতে হবে। অনেকেই ভাবেন সার্জারির পর হাঁটাচলা অথবা ব্যয়াম করা যাবে না। কিন্তু তা ঠিক নয়, ইটিটি রিপোর্ট স্বাভাবিক থাকলে সমতলে হাঁটা, হাল্কা ধরনের কার্ডিয়ো এক্সারসাইজ (Cardio exercise) করার সুপারিশ করেছে আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন।
খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সম্পৃক্ত চর্বি এবং ট্রান্স ফ্যাটি এসিড হৃদরোগের অন্যতম কারণ, তাই ডুবো তেলে ভাজা খাবার, ভাজা–পোড়া খাবার, ফাস্টফুড জাতীয় খাবার, অতিরিক্ত তেল ও চর্বি জাতীয় খাবার গ্রহণ হতে বিরত থাকতে হবে।
আপনার স্বাস্থ্য এবং আপনার হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখার জন্য নীচের সহজ পদক্ষেপগুলো মেনে চলবেন
ক্স আপনি কতটুকু খাবেন এটি আপনার খাবারের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করুন ।
ক্স খাওয়ার সময় ছোট প্লেট বা বাটি ব্যবহার করুন। কম ক্যালোরিযুক্ত খাবার, পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার, যেমন ফল এবং শাক–সবজি বেশি এবং উচ্চ ক্যালোরির খাবার প্লেটে পরিমাণে কম রাখুন। এই কৌশলটি আপনার ডায়েটের পাশাপাশি আপনার হৃদপিণ্ডকে ভাল রাখতে সহায়তা করবে।
ক্স প্রতিদিন খাদ্য তালিকায় বেশি বেশি রঙিন শাক–সবজি এবং ফলমূল রাখুন।
ক্স উচ্চ ফাইবারযুক্ত দানা শস্য – আঁশ ও অন্যান্য পুষ্টির ভাল উৎস যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এবং হার্ট সুস্থ রাখতে ভূমিকা রাখে। যেমন : লাল আটা, লাল চাল, ওটস, কাউনের চাল, বার্লি ইত্যাদি ।
ক্স মাছ খাদ্য তালিকায় রাখুন । সপ্তাহে কমপক্ষে দু’বার সামুদ্রিক মাছ খান, বিশেষত ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত মাছ, উদাহরণস্বরূপ– সালমন, কোরাল, সুরমা মাছ, টুনা মাছ, ইলিশ, লাক্ষা, পোয়া মাছ, রূপচাঁদা ইত্যাদি।
ক্স কম চর্বিযুক্ত প্রাণীজ আমিষ গ্রহণ করুন। যেমন : ডিম, মাছ, চামড়া ছাড়া মুরগির মাংস, কম ননীযুক্ত দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, টক দই ইত্যাদি ।
ক্স শিম, মটরশুটি এবং মসুরসহ অন্যান্য ডালগুলোও আমিষের ভাল উৎস এবং এতে কম চর্বি থাকে এবং কোলেস্টেরল থাকে না, তাই এটি মাংসের ভাল বিকল্প। প্রাণীজ আমিষ কমিয়ে উদ্ভিজ আমিষ খেলে চর্বি এবং কোলেস্টেরল গ্রহণ কম হবে এবং ফাইবার গ্রহণ বাড়বে।
ক্স যদি আপনি মাংস খেতে পছন্দ করেন, তেল–চর্বি বিহীন মাংস খাবেন এবং সেগুলো কম তেলে স্বাস্থ্যকর এবং সুস্বাদু উপায়ে রান্না করুন।
ক্স সফট ড্রিঙ্কস ও চিনিযুক্ত খাবারগুলো এড়িয়ে চলুন। যেমন : পেপসি, ফান্টা, কোক, স্প্রাইট, কোলা, কেক, পেস্ট্রি, মিষ্টি, হরলিক্স, মাল্টোভা ইত্যাদি।
ক্স কম লবণযুক্ত (সোডিয়ামযুক্ত) খাবার খাবেন এবং অল্প লবণ দিয়ে খাবার রান্না করুন। রক্তচাপ কমাতে, প্রতিদিন ১ চা চামচের কম লবণ খাওয়ার চেষ্টা করুন।
ক্স উচ্চ রক্তচাপ বা সিভিডি থাকলে প্রতিদিন লবণ গ্রহণের পরিমাণ আধা চা চামচ খাওয়া বাঞ্ছনীয়, কারণ এটি রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
ক্স ধূমপান, তামাক (সাদা পাতা) ও জর্দা পরিহার করুন।
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের হার্ট ডিজিজ অ্যান্ড স্ট্রোক স্ট্যাটিসটিক্স, ২০১৬ আপডেট অনুযায়ী–হৃদরোগ বিশ্বব্যাপী এক নম্বর জনস্বাস্থ্য সমস্যা এবং মৃত্যুর এক নম্বর কারণ। তাই অতিদ্রুত আমাদেরকে সচেতন হতে হবে এবং মনে রাখতে হবে ‘প্রতিরোধ, প্রতিকারের চেয়ে উত্তম’।