গেল বছর চট্টগ্রামের বই মেলায় একটি স্টলে বসে বই দেখছিলাম। ফাল্গুনের পড়ন্ত বিকেলে তখনো ভিড় জমে ওঠেনি। হবে হবে করছে। খোপ খোপ স্টলগুলোর মাঝে পাতলা পর্দার দেয়াল। এপাশের কথা ওপাশে সহজেই শোনা যায়। পাশের স্টল থেকে পাঠক ও বিক্রেতার কথোপকথন কানে আসছিল। আলোচনার বিষয় সম্ভবত বই আর পাঠক। পাঠক ভদ্রলোক বলছিলেন, ‘আজকাল পাঠক কমে গেছে। ভালো বইও নেই। হুমায়ূন আহমেদের বইগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ি। সেসবই কিনি। কী বলব, একটা বই খুললে কি শেষ না করে ওঠার উপায় আছে? এই হাসতে হাসতে পেটে খিল, আবার কেঁদে বুক ভাসাচ্ছি। নিজেও পড়ি, আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়েরাও পড়ে।’
পাশের স্টলে গিয়ে পাঠকটিকে আর ধরা গেল না। মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে মেলার গেট দিয়ে বের হয়ে গেলেন তিনি।
চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামসংলগ্ন জিমনেসিয়াম মাঠে অমর একুশের বইমেলায় গত বছর সারি সারি স্টলে হাজার হাজার বই দেখেছি। বিষয়–বৈচিত্র্যের দিক থেকে বিবেচনা করলে তাকে বিপুলই বলতে হবে। এত সব বইয়ের ভিড়ে হতাশ পাঠকটির কথা মনে করে মন খারাপ হয়। এত আয়োজন তবে কি বিফলে যাচ্ছে? এই যে এত সব প্রকাশনা সংস্থা, এত এত লগ্নি, মেধা ও শ্রম–এর সবই অপচয়?
সেই বইমেলায় এক পাঠিকার সঙ্গে আলাপ হয়। নাম পরিচয় প্রকাশ করতে মানা। কথোপকথনের সারটুকু তুলে ধরা যাক। তাঁর কাছে জানতে চাই, হুমায়ূনের জাদু শেষ বলে পাঠক কি কমে যাবে? তিনি বলেছিলেন, ‘সমগ্র পাঠকশ্রেণিকে যদি এক শ একক ধরে নিই, তবে এর অন্তত নব্বই ভাগই হুমায়ূনের পাঠক। বাদবাকিদের ভাগ করে নিয়েছেন সমকালের কথাসাহিত্যের জনপ্রিয় লেখকেরা। এর বাইরে এক শতাংশের মতো পাঠক নতুন সাহিত্য, সমাজ–ইতিহাস ও দর্শনের বইয়ের খোঁজ করেন।’
ওই পাঠিকার কথায় মনে পড়ল সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক বার্টন পেইনের একটি উক্তি। তিনি বলেছিলেন, ‘সেই সব কল্পকাহিনি সারা পৃথিবী ছেয়ে ফেলছে, যার কোনো উৎসমূল নেই। এগুলো কোনো সংস্কৃতি নয়, সাহিত্য নয়, একধরনের বাণিজ্যিক প্রকরণমাত্র।’
তবু আশার কথা যে আজকের এক শতাংশ পাঠকের মধ্য দিয়ে পাঠরুচির এক বিরাট অদলবদল ঘটছে। একসময় কবিতা, কথাসাহিত্য, ছোটগল্পের বাইরে মননশীল বইয়ের জগৎ বেশ ছোটই ছিল। এখন ধীরে ধীরে হলেও তা বাড়ছে। পরিবর্তন আসছে বিষয়বৈচিত্র্যেও।
গত বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাকের বই ‘পলিটিক্যাল পার্টিস ইন ইন্ডিয়া’ প্রকাশিত হয় ইউপিএল থেকে। আশ্চর্যজনকভাবে এই বইটির প্রতি পাঠক আগ্রহ দেখিয়েছে। যেসব পাঠক আকবর আলি খান, নওম চমস্কি আর স্লাভয় জিজেক পড়েন, সেই পাঠকেরাই বইটি কিনেছেন। অল্প হলেও পাঠক ভাগ্য জুটেছে বইটির কপালে।
মনে পড়ে আহমদ রফিক ‘বই পড়ার আনন্দ ও তার বিকল্প ভাবনা’ প্রবন্ধে বলেছেন, বিগত শতকের একেবারে শেষ দিক থেকে বর্তমান শতকে পৌঁছে, তরুণেরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই সামাজিক পরিবেশ ও তার উপকরণ, এমনকি রাজনীতিকেও ভিন্ন মাত্রায় বিচার করতে চাইছে। মন ও মননশীলতার সমীকরণ ঘটাতে চাইছে ভিন্ন হিসাবে। নব্য বিষয়াদি তাকে প্রলুব্ধ করছে অধিকতর টানে। তাই জীবনযাত্রার ধরনধারণও বদলাতে শুরু করেছে, বরং বলা যায় বদলাচ্ছে। তাই পাঠরুচির বদলও অনিবার্য।
বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের ওপর লেখা আকবর আলি খানের ‘গ্রেশামস ল সিনড্রোম অ্যান্ড বিয়ন্ড’, ‘আর্চার কে ব্লাডের ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ’, ফারুক আহমেদের ‘বিলাতে বাঙালি অভিবাসন,’ আফসান চৌধুরীর ‘হিন্দু জনগোষ্ঠীর একাত্তর’ বইগুলো তরুণেরা যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে কিনছেন। লেখক মহিউদ্দিন আহমদ, আলতাফ পারভেজ, মনজুরুল হকের বইও সমান আগ্রহ নিয়ে কিনছেন পাঠকেরা।
মননশীল বইয়ের বাড়বাড়ন্ত এখন নতুন ট্রেন্ড। প্রধানত তরুণেরাই এসব মননশীল বইয়ের পাঠক। এরা এখন আরও তলিয়ে জানতে চান। রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, ইতিহাস–নানা বিষয়েই তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে।
তবে শেষমেশ এই হিসাব তো এক শতাংশ পাঠকের। বিবেকানন্দ যেমন বলেছেন, সত্য সংখ্যালঘুদের দিয়েই শুরু হয়, তেমন আশা করতে ইচ্ছে হয়। হয়তো এই এক শতাংশ শত শতাংশে পরিণত হবে একদিন।