‘হিম’ উপন্যাসে আকাশছোঁয়া ‘কোটেবল কোটস’ করার মতো বেশ কিছু লাইন আছে, যেগুলির প্রতিটা কথাই কোনও এক সম্পূর্ণ হওয়ার দিকে যাত্রা, যেগুলি পাঠকালে মনে হয় ঔপন্যাসিক সৈকত দে পাঠকদের মনস্তাত্ত্বিক অনুশীলন করার জন্য এসব বাক্য সৃজন করেছেন। যে কথাগুলি পাঠ করলে পরিমার্জিতভাবে পাঠকের ভিতরে ভিন্নমাত্রার আত্মবোধ তৈরি করে। সীমাহীন স্বপ্নের রংগুলিকে তরঙ্গ দেয়। পাশাপাশি এই লাইনগুলি আবার সামাজিক বিদ্রুপও মনে হয়। এসব বিদ্রুপ বাস্তবেরই অংশ অর্থাৎ, ঘটমান বর্তমানের অংশ। কাহিনীর আবরণ পরিত্যাগ করে এই কথাগুলি হয়ে উঠেছে আরও স্পষ্ট, আরও রিপোর্টাজ–ধর্মী ও প্ররোচনামূলক। উপন্যাসের ন্যারেশনের ভিতর থেকে যখন ‘কোটেবল কোটস’ বলেন, তখন লেখকের চোরাগোপ্তা ইচ্ছার একটা আঁচ পাওয়া যায়। এই চোরাগোপ্তা ইচ্ছায় বলতে চাওয়া কথাগুলি হচ্ছে লেখকের এক ধরণের স্বচ্ছ আশ্রয় এবং উপন্যাসে ন্যারেশনের জন্য তুমুল উদ্দীপক। এই চোরাগোপ্তা ইচ্ছা লেখকের অন্তর্গত ব্যথা–আক্রোশ–ক্রোধ নিবারণে এক ধরণের আশ্রয় এবং ন্যারেশনের মহত্ত্বে উপন্যাস তত্ত্বের অনন্য উদ্দীপক। এই কোটেশনের কথাগুলি কাহিনীর ভেতর অন্তর্নিহিত বোধ হিসেবে ধরা দেয়। লেখকের নিজ জীবনে এই বোধকে মিশ্রিত না করতে পারলে, অন্তর্নিহিত এই বোধ কাহিনীর মাধ্যমে সৃজন করা খুব কঠিন। কাহিনী বাড়তে বাড়তে চরিত্ররা ক্রমশ নিঃসঙ্গ বোধ করলে লেখক তখন টের পান এবং তখন অন্তর্নিহিত বোধ থেকে এমন কোটেশন সৃজন করেন। বিষয়ের বিভিন্নতায় এবং কথন ভঙ্গির ভিন্ন অ্যাপ্রোচ তাঁর কোটেশনগুলিকে কখনও একঘেয়ে মনে হয়নি। ঘটনাস্রোতের ক্রমিক জুক্সটাপজিশনে উপন্যাসে ক্রমশ তৈরি হয়ছে এমন কন্ট্রাস্ট ‘কোটেবল কোটস’। এমন সংমিশ্রণের অন্তর্বোধে ‘হিম’ উপন্যাসকে লেখক গড়ে তুলেছেন পাঠকদের জন্য মনস্তাত্ত্বিক অনুশীলনের স্বকীয় এবং ইউনিক ডিসকোর্স। যেন পাঠক ভাবনার রোদের দিকে তাকিয়ে গোছাতে পারে তার চিন্তার ফসল, আর সেই কথাগুলির সাথে পাঠক যেন অনুভব করে রোদের আদর। সৃষ্টিশীল এসব বাক্যবন্ধের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় হওয়া যাক এবার–
[ক] : “ ফ্ল্যাটের একটু দূরে সুধন্যদের বাসায় বালিশে মাথা চেপে রুলি, শব্দহীন কাঁদছিলো, রাত সাড়ে তিনটায় কখনো কার্ল মার্ক্স আর্তকে রক্ষা করতে নেমে আসেন না।” ( পৃষ্ঠা : ১৫)।
[খ] : “চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বড় চমৎকার জায়গা। এখানে প্রতি ইঞ্চি জায়গা টাকা ছাড়া নড়ে না। এখানকার প্রতিটি ভোর, সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, রাত, গভীর রাত আলাদা শেডের।” ( পৃষ্ঠা : ৩২ )।
[গ] : “ মানুষের বেঁচে থাকা মানে তো অজস্র
স্মৃতিকে চাপা দিতে দিতে ভেসে উঠতে না দিয়ে টিকে থাকা” (পৃষ্ঠা : ৪১)।
[ঘ] : “….জ্বর হলে ঘেরের ভেতর ফিরে আসো তুমি, অকপট যেন আমরা একইরকম আছি, একটু পরেই কলাবাগানহীন শিল্পকলায় বসে মামার দোকানের ঝুলে থাকা কলা ছিঁড়ে খাবো, তুমি রবীন্দ্রনাথ পড়বে। প্রত্যেকেই কী দারুণ বাধ্য ভালোবাসতে। বিবাহিত হলে নিজের সমস্ত অনিচ্ছে একত্র করে দৃঢ় হতে হয়, মজ্জার ভেতরকার অসুখ সেরে উঠলেও তোমার শরীর প্রমথ চৌধুরীর সনেটের মত মনে হবে। চুমু খাওয়ার কালে সকল নারীকে কেন যে দন্তসুখ মনে হয়। আমি তো জ্বরনিরপেক্ষ চেয়েছি ম্মল সইজের কবি হতে সিন্ডিকেট রেটেরিক সেক্সসিম্বলহীন।
জ্বরের ঘোরে মনে হয়, তোমার চকিত বিবাহ হতে পারতো ইউরোপিয়ান ফিল্মের মাস্টারপিস। তুমি জানো দু’জনকেই, আকৃতি প্রকৃতি। সে হয়ত হতো ভালো বন্ধু আমার। পিথাগোরাসের উপপাদের কথা মনে পড়ে গেলো। ইদানীং রাতে ভালো ঘুম হতে হতে আমি রোদ পোহানো কুমীরের মত মোটা হয়ে যাচ্ছি। আয়নায় চুল আঁচড়াতে গেলে গলকম্বল চোখে পড়ে। ভাবি, এই গলকম্বল চাটাচাটি আছে সাহিত্যের সুফলা মাঠে। যখন ঘুম হত না ভাবতাম, ওগো কে আছো খানিক ঘুম দাও। বাপের রেজারে দাড়ি কামাতে ভুলে যেতাম, ভুলে যেতাম প্রণয়ের সম্ভাবনা। ভাবি, সেসব অপুষ্টির দিন বড় সুষমাময় ছিলো… যারা সীমান্তের বাইরে যারা সীমান্তের ভেতরে, সকলে কররেখার দিকে তাকায়। মাঝে মাঝে আমি উড়ে যাওয়া জেটের ফেলে যাওয়া সাদা লেজ দেখি, মনে হয় প্রবাসী বন্ধুর হাতে ওড়ানো অতিকায় ঘুড়ির উড়ালপথ…. ”(পৃষ্ঠা : ৫৩ )
[ঙ] : “…মানুষের সভ্যতায় কুকুর এক পূর্ণবান প্রাণ। কুকুরের সভ্যতায় মানুষ এক অভিশপ্ত জীব…”
(পৃষ্ঠা : ৫৬ )
[চ] : “… যখন মানুষ পরস্পরে বিলীন হয়ে যায় তখন অন্য পক্ষের উপস্থিতি খুব একটা জরুরি থাকে না। তুমি আছো এটুকুই যথেষ্ট। পৃথিবীতে তো আছো। কিংবা হয়তো তোমার শরীরটা মৃত কিন্তু স্মৃতি চিরজীবিত। তার মৃত্যু নেই…” (পৃষ্ঠা – ৯১ )
ধারাবাহিকভাবে ত্রয়ী উপন্যাস সৃজনের উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা এবং প্রকাশিত ‘হিম’ হচ্ছে ঔপন্যাসিক সৈকত দে’র প্রথম পর্ব। প্রস্তাবিত এবং প্রকাশিতব্য বাকী দুইটি উপন্যাস পাঠ না করেই পাঠক উপলব্ধি করতে পারেন, ‘হিম’ হচ্ছে লেখক সৈকত দে’র অন্তরাত্মার এবং চিন্তার যৌথতায় উজানযাত্রার সিদ্ধি ও শুদ্ধি। সেই উজানযাত্রার পথে একটি চরিত্রের যে জীবন দর্শনের ঘূর্ণায়ু, সেই ‘সুধন্য’–কে ঘিরেই বাস্তব জীবনের আখ্যানের মতো করে নির্মাণ হয়েছে ‘হিম’ উপন্যাস। কাহিনীর সিংহভাগ আবর্তনই গড়ে উঠেছে ‘সুধন্য’–কে ঘিরে, যার ডাকনাম রাজু। আর প্রতিটি বাক্যের পরিসীমায় ধারণ করে আছে যে শব্দের সংহতি, সেই শব্দের আবর্তনে সমুদ্রসম্ভব ব্যাপকতার মতোন লেখক চট্টগ্রামের এক বড় প্রতিচ্ছবিকে তুলে ধরেছেন এই আখ্যানে। কারণ ‘হিম’–এর লেখক সৈকত দে ঘোড়ার মতো দাপিয়ে বেড়ানো ঘোরতর একজন চট্টগ্রামবাসী এবং এই উপন্যাসের মূল চরিত্র কোনো ব্যক্তি নয়, এর নায়ক চট্টগ্রাম শহর। চট্টগ্রামের মাটি–রস এবং জলবায়ু নিংড়ে তৈরি হয়েছে এমন উপন্যাসের রঙ। জেমস জয়েসের উপন্যাসে যেমন বিহ্বলের মতোন ধরা আছে ডাবলিন শহর, এখানেও বিশ্বস্ত বিস্তারের মতোই দৃশ্যমান হয় চট্টগ্রাম শহর। পাশাপাশি আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং মানব মানবীর সম্পর্কেও বহুমাত্রিকতাকে অনুপুঙ্খ মানবিক ভাবনায় উপস্থাপিত করা হয়েছে এখানে। ‘হিম’–এর সিনট্যাক্স পরিপূর্ণ হয়েছে এই উপন্যাসের কিছু চরিত্রের চেতনায় সিক্ত মানবিক ভাবনার রসায়নে, যে চরিত্ররা মজেছিল মধ্যবিত্তপনার আচ্ছন্ন রসায়নে। কিন্তু প্রায় প্রতিটি চরিত্রই এক ধরণের জটিলতাবোধে প্রস্ফুটিত নিঃসঙ্গতার মতোন যাপন করে কাহিনীতে। অনুভূতির দীর্ঘসূত্রতায় এখানে একজনের স্মৃতি ডুবে আছে অন্য জনের স্মৃতিতে। আর আয়নার দূরত্বে লেখক কাহিনীর ডানায় গুঁজে দেয় স্মৃতির পালক, সেখান থেকে যা বেরিয়ে আসে, পাঠক দুই চোখে পড়ে নেয় তাদের গোপনীয়তা। উপন্যাসের সমাবেশে যেভাবে কাহিনীর বৃত্তান্ত আছে তা পুরোপুরি অচেনা না হলেও এর হাবভাব চালচলন অনেকটাই উদ্ধত, উগ্র আর হিপনোটিক। এই ঔদ্ধত্য, এই তীব্রতা পাঠককে ভীত না–করে আরও এক অমোঘ টানে আকর্ষণের সেই নিউক্লিয়াসের দিকেই ধাবিত করে। উৎসাহী পাঠকগণ একটি অবশ্যপাঠ্য উপন্যাসের তীব্র আঘাত উপলব্ধি করার সুযোগ পাবেন। যারা কোনোদিন দেখেনি চট্টগ্রাম, তারাও চিনে ফেলবেন এই শহরের সামাজিক, ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে অব্যক্ত চট্টগ্রাম।
‘হিম’ পড়তে–পড়তে এমন অনুভব হয় উপন্যাসের ঘরটি যদি হয় কাহিনীর, তবে এর জানালাটি লেখকের। এর শব্দ যদি হয় কাহিনীর, কিন্তু এর ধ্বনি লেখকের। এর সংগীতটি কাহিনীর হলে তবে সুরটি লেখকের। কাহিনীর সাথে লেখক আছেন ছায়ার দ্বন্দ্বে, যা পাঠকালে পাঠক অনুভব করেন সন্দেহের অন্তরঙ্গে। যেন কাহিনীটির গোপন খোলে লেখকের গুপ্তধন। যেন একটি বইয়ের ভেতর জুড়ে দিয়েছে দুইটি আকাশ এবং একটি মেঘ। ‘হিম’ এর নদীতে জন্ম নেয় স্মৃতির আয়না এবং সৈকত দে’র প্রতিবিম্ব। কাহিনীতে লেখককে ছায়ার মতোন স্পষ্টকরণ এক ধরণের অন্তর্ঘাত। এ–ধরণের উপন্যাসে কাহিনীর বালিতে ঝিনুকের গোপন ছায়ায় লেখকের অস্তিত্ব বেড়ে ওঠে। লেখকের অস্তিত্বের বৃদ্ধি টের পেলে তখন উপন্যাসটি বিভাজিত হয়ে যায়, তখন মননের প্লট থেকে লেখকের দূরত্ব বেড়ে যায়। আশা করি পরের পর্বে চরিত্রের সম্পর্কগুলি এবং চরিত্রদের পরস্পরবোধ চুঁইয়ে চুঁইয়ে পূর্ণ করবে মননশীল প্লট।
অবশ্য যখন স্মৃতির পাখিরা ডানার উপর পুরা আকাশ উড়িয়ে নিয়ে যায়, তখন কাহিনীতে নিজেকে আড়ালে রাখাটা গোলোকধাঁধায় ফেলে। ‘হিম’–এ লেখককে নিজের স্মৃতির ভিতরে হারিয়ে যাওয়ার একটি ঔপন্যাসিক উদ্ভাবন মনে হয়েছে।