১২ মার্চ ছিলো বিশ্ব কিডনি দিবস। নতুন প্রতিপাদ্য ‘সুস্থ কিডনি সবার জন্য’। বৃদ্ধি পাচ্ছে ন্যায়ঙ্গত সেবার সমান সুযোগ আর নিরাপদ ও সর্বোত্তম ওষুধের অনুশীলন। রোগ নিয়েও ভালো থাকতে হবে। হিমোডায়ালাইসিস এন্ড স্টেজ কিডনি ফেইলিওর অবস্থায় জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা পদ্ধতি। ভালো থাকার এক অন্যতম উপায়। হিমোডায়ালাইসিস ব্যয়বহুল, দজ্ঞ জনশক্তি এবং উচ্চতর প্রযুক্তি নির্ভর। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ সহ দেশের অনেক সরকারি প্রতিহিমোডায়ালাইসিস চালু আছে। যেখানে আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার দৌরাত্মে হিমোডায়লাইসিস কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্নভাবে চলা প্রায়ই ব্যহত হয়। অন্যদিকে অনেক বেসরকারি মেডিকেল চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে হিমোডায়ালাইসিস চালু হয়েছে এবং দিনে দিনে নতুন নতুন ক্লিনিক সমূহে প্রসারিত হচ্ছে। ক্লিনিক সমুহে হিমোডায়ালাইসিসের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। অন্যতম হলো– দক্ষ জনবলের অভাব, স্পেস সেটিং আর সাপ্লাই অপ্রতুলতা, যন্ত্রপাতির মূল্যমানের অবচয়, বিভিন্ন প্রকার করের প্রভাব ও ইনভেস্টমেন্টের ডিভিডেন্ড। এসব কারণে ডায়ালাসিস ব্যয় অনেক বেশি হয় এবং ডায়ালাইসিস প্রদানকারী কেন্দ্রগুলো ব্রেক ইভেন সংকটে নিপতিত থাকে।
সরকারি হাসপাতালগুলোর জনবল, সেটআপ, যন্ত্রপাতি, আনুষঙ্গিক সব কিছুর সুযোগ ও উৎস বিদ্যমান। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা ও কর্ম পদ্ধতি হিমোডায়ালাইসিসের মত সংবেদনশীল সময়াবদ্ধ ক্রিয়াকে পুনঃপুনিক ভাবে বাধাগ্রস্ত করে। সবচেয়ে বারবার যা হয় তা হলো হিমোডায়ালাইসিস মেশিন বিকল হলে তা তাৎক্ষণিক ঠিক করার ব্যবস্থাপনা নেটওয়ার্কের প্রকট অভাব। নিয়মিত চলমান হিমোডায়াইসিস অনিয়মিত বা বন্ধ হওয়া একজন ডায়ালাইসিস নির্ভর রোগীর জন্য জটিলটা বা মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয়ার সামিল।
সরকারি বেসরকারি অংশীদারত্ব আধুনিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি যাতে যার যার সুযোগ, সম্পদ আর সংগতি সম্পুরক আর পরিপূরক সমন্বিত ও সহযোজন করে কার্যক্রম সুচারু ভাবে পরিচালনা করা। চালু রাখা। কার্যকর অংশীদারত্বে পরিকল্পনা থেকে শুরু করে সবকিছু যৌথভাবে হতে হবে। পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ, নিরীক্ষা, পরিচালনা। অন্যদিকে লীজ হলো কোন একটা কার্যক্রমের সবকিছু ঠিক করে একপক্ষ অন্যপক্ষকে পরিচালনার জন্য দেয়া যা থেকে অন্য পক্ষ আয় করে লীজ দাতাকে চুক্তিকৃত মূল্য প্রদান করে। এখানে সম্পূরক বা পরিপূরকভাবে কাজ করা হয় না।
অন্য কয়েকটির মতো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও সবা–র নামে ডায়ালাইসিস কেন্দ্র চালু করা হয়েছে কয়েক বছর থেকে। উদ্দ্যেশ্য হলো নিরবচ্ছিন্নভাবে আর্থিক ব্যয় ক্ষমতার মধ্যে ডায়ালাইসিস করে জীবন ধারণ করবে রোগীগণ। বিদেশী কম্পানির স্থানীয় সাবিসিডিয়ারী তাদের নাম দিয়ে কেন্দ্র হাসপাতালের স্পেস সহ সবকিছু ব্যবহার করে চালাচ্ছে। নেফ্রোলজী বিভাগের সাথে যথাযথ সমন্বয়বিহীন। নামে কম মূল্যে ডায়ালাইসিস দিচ্ছে কিন্তু পুরো মেকআপ মূল্যটা সরকার থেকে নিচ্ছে। নিয়মিত ডায়ালাইসিস এডিকুয়েসি নির্নয় না করা, পেরিডায়ালাইটিক জটিলটা যথাযথ ডাবে মেনেজে ব্যর্থতা, বিশেষজ্ঞের তত্ত্ববধানের অভাব, ডায়ালাইজার রিইউজের সমস্যা জর্জরিত। জনকল্যাণে আউটকাম আর আঊটপুটের কোন পরিবীক্ষণ নিরীক্ষা ছাড়াই চলছে। এ কার্যক্রমকে তাই লীজ বলা যায়। অংশীদারত্ব নয়, নেফ্রোলজী বিভাগের অঙ্গ না হয়ে। অসমন্বিতভাবে হাসপাতালের মধ্যে কেনটিন লীজ নেয়ার মতো। আমার কাছে খুব অবাক লাগে আরও অনেক ব্যয়বহুল চিকিৎসা ব্যবস্থা যেমন ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজী, ক্যান্সার, হাই এন্ড ল্যাব ইত্যাদি বাদ দিয়ে শুধু হিমোডায়ালাইসিসকে লীজে দেয়া হলো কেনো? বাংলাদেশ সরকারের কয়েকটা হিমোডায়ালাসিস মেশিন ও আনুসঙ্গিক সরঞ্জাম সংগ্রহ ও সংশ্লিষ্ট অন্য কিছু দেয়ার কি ক্ষমতা নেই? না এখানে অন্য কোনো ব্যাপার আছে?
সবা–র মাধ্যমে যৌক্তিকভাবে অনেক কিছু করা যেতে পারে। চট্টগ্রামের সকল বেসরকারি ডায়ালাইসিস কেন্দ্র সমূহকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নেফ্রোলজী বিভাগের নেতৃত্বে হিমোডায়ালাইসিস এলায়েন্স করা যায়। সকল ডায়ালাইসিস কেন্দ্র সমূহের অবস্থা নিরীক্ষা করে একটা স্টান্ডার্ড বেঞ্চমার্ক তৈরী করে সবকেন্দ্রকে সেই পর্যায়ে উন্নীত করে একটি ইউনিফরম ও স্টান্ডার্ড অপারেশন প্রটোকলের অনুসরণ করে ডায়ালাইসিস চালানো। আর তা করতে জনবল, সরঞ্জাম, সামগ্রী, সম্পদ, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি শেয়ারিং ও নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে সম্পূরক ও পরিপূরক ভাবে সজ্জিত করা। যে যেখানে ডায়ালাইসিস করুক ফিসের রোগীর অংশ রোগী দেবে বাকী সরকার প্রদেয় অংশ সরকার থেকে কেন্দ্র বিল করে নেবে। এবং সরকারি প্রদেয় অংশ পেতে হলে বেঞ্চ মার্ক মান অর্জন ও বজায় রাখতে হবে। কেন্দ্র সমূহকে এক্রিডেটেড হতে হবে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের নেফ্রোলজীর বিভাগের প্রধানের নেতৃত্বে একটি ব্যবস্থাপনা ও পরিবীক্ষণ এবং নিরীক্ষা কমিটি হিমোডায়ালাইসিসের সব পরিচালনা করবে। এতে মানসম্মত ডায়ালাইসিস আর্থিক ক্ষমতার মধ্যে রোগীগণ পাবেন। এই কার্যক্রম আরও গতিশীল ও জনকল্যাণমূলক হবে যদি সমাজসেবা বিভাগের চিকিৎসা সহায়তার অনুদান সরকারি প্রদেয়র সাথে যোগ করে ডায়ালাইসিস ইন্সিওরেন্স তহবিল করা যায়। চিকিৎসকদের গতানুগতিক চিকিৎসা মানসিকতা আর আমলাদের গণ্ডিভূত ধারনায় এসব ফলনধর্মী কর্মকাণ্ড কখনই হবে না।
এবারের বিশ্ব কিডনি দিবসের প্রতিপাদ্যের ফলনধর্মী প্রয়োগ হিমোডায়ালাইসিসে যথাযথ সরকারি বেসরকারি অংশীদারত্ব। স্বাধীনতার আহবানে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো’। কিডনী বিকল রোগ নিয়ে ভালো থাকার জন্য নিরবচ্ছিন্ন হিমোডায়ালাইসিস পেতে যথাযথ উদ্ভাবনীমূলক কার্যকর সরকারি বেসরকারি অংশীদারত্বে তার অনুরণন উঠুক চারিদিকে। এবং গণ্ডির বাইরে দেখতে হবেই।
লেখক: কিডনি বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক, ইন্টারনিস্ট ও নেফ্রোলজিস্ট এবং গবেষক।