হিটু শেখের প্রাণদণ্ড, ৩ জন খালাস

মাগুরার শিশু ধর্ষণ-হত্যা ওরা ছাড়া পায় কীভাবে, বললেন ক্ষুব্ধ মা মাত্র ১৪ কর্মদিবসে বিচার সম্পন্ন : পিপি

আজাদী ডেস্ক | রবিবার , ১৮ মে, ২০২৫ at ৪:২২ পূর্বাহ্ণ

মাগুরার আট বছরের শিশুর ধর্ষণ ও হত্যার আলোচিত মামলার মূল আসামি হিটু শেখকে প্রাণদণ্ড দিয়েছে আদালত। মামলার বাকি তিন আসামি শিশুটির বোনের জামাতা সজীব শেখ, সজীবের ভাই রাতুল শেখ ও তাদের মা জাহেদা বেগম পেয়েছেন খালাস। গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ৯টায় মাগুরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এম জাহিদ হাসান এই রায় ঘোষণা করেন বলে জানিয়েছেন মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মনিরুল ইসলাম মুকুল। এর আগে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে চার আসামিকে কারাগার থেকে মাগুরার বিচারিক আদালতে নেওয়া হয়। ঘটনার মাত্র দুই মাস ১১ দিনের মাথায় এই মামলার রায় হলো। খবর বিডিনিউজের।

গত ৬ মার্চ মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার শিশুটি তার বোনের বাড়ি বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হয়। সাত দিন পর ১৩ মার্চ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যায় শিশুটি। এরপর ১৩ এপ্রিল মাগুরার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আলাউদ্দিন।

মামলার মূল আসামি হিটু শেখ ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে তিনি মামলার সাক্ষ্যে একাধিক দিন সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, তিনি এর সঙ্গে জড়িত নন।

অভিযোগপত্রে অপরাধীদের সংশ্লিষ্টতা : ধর্ষণ ও হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে প্রধান আসামি হিটু শেখের যে বীভৎসতার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তাতে তার বিকৃত ও পৈশাচিক মানসিকতাই প্রকাশ পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন। আট বছরের শিশুটিকে যৌন নিপীড়ন করতে গিয়ে প্রধান আসামি ধারালো ব্লেড ব্যবহার করেছেনঅভিযোগপত্রের এমন বিবরণ শুনে একজন নারীনেত্রী মন্তব্য করেছেন, এটা শুধু একজন বিকৃত, পৈশাচিক আর জানোয়ারের পক্ষেই সম্ভব। একটা নিষ্পাপ শিশুর সঙ্গে এটা কল্পনাতীত পশুত্বের আচরণ করা হয়েছে।

বাড়িতে একা পেয়ে শিশুটিকে তিনি ধর্ষণ করেন। ধর্ষণের পরেও তিনি স্বাভাবিক ছিলেন। খাওয়াদাওয়া করেছেন এবং মাঠে গিয়ে কাজে যোগ দিয়েছেন। মামলায় হিটু শেখের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আইনের ৯এর ২ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোন ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তাহার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে [ধর্ষণের শিকার] নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত [অনধিক বিশ লক্ষ টাকা] অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।’

শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয়েছে এটা বুঝতে পেরে ঘটনা ধামাচাপা দিতে ও স্বামীকে বাঁচাতে জিনে আছর করেছে বলে সুকৌশলে প্রথমেই হাসপাতালে না নিয়ে ঝাড়ফুঁক করানোর জন্য এক হুজুরের কাছে নিয়ে যান প্রধান আসামি হিটু শেখের স্ত্রী জাহেদা বেগম। কিন্তু সদর উপজেলার নিজনান্দুয়ালি মদিনাতুল উলুম পৌর গোরস্থান মাদ্রাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের হুজুর শিশুটির গলার কালচে দাগ ও বুকে আঁচড়ের চিহ্ন দেখে বলেন, এটি ঝাড়ফুঁকের কাজ না। আপনারা দ্রুত বাচ্চাটাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। তারপরই শিশুটিকে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট মাগুরা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও শিশুটির বড় বোনের শাশুড়ি জাহেদা বেগম (৩৮) চিকিৎসক ও নার্সদের বিভ্রান্ত করেন। ঘটনার প্রকৃত তথ্য না দিয়ে তিনি বলেন, পেটের ব্যাথা নিয়ে শিশুটি মাটিতে গড়াগাড়ি দিয়েছে। এবং হাসপাতালে ভর্তি না করে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি নিয়ে যেতে চান।

অভিযোগপত্রে জাহেদা বেগমের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২০১ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। যারা অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টা করে, সত্য গোপন করে এবং আলামত নষ্ট করে তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২০১ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। এছাড়া হিটু শেখ ও জাহেদা বেগমের দুই ছেলে সজীব শেখ ও রাতুল শেখের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি আইনের ৫০৪ অনুযায়ী অভিযোগ আনা হয়েছে।

ওরা ছাড়া পায় কীভাবে : প্রধান আসামির মৃত্যুদণ্ড হলেও বাকি তিন আসামির খালাসে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা যাওয়া মাগুরার শিশুটির মা। গতকাল সকালে রায় ঘোষণার পর এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, হিটু শেখের সঙ্গে আরও তিনটা আসামি ছিল, তারা আমার মেয়েকে মারতে সহযোগিতা করছে। তারা কীভাবে খালাস পেয়ে গেল? আমি চাই, ওরাও তো দোষী, ওদেরও শাস্তি হোক।

এ সময় নিজের মেয়ের জামাই সজীব শেখের কথা উল্লেখ করে বলেন, তার তো শালী, তার তো একটা দায়িত্ব ছিল। ও তো নিজেই ছেড়ে দিছে। তাইলে আমরা এই রায়ে খুশি হলাম কীভাবে? আমি হাই কোর্টে যাব, যাতে ওই তিনজনেরও শাস্তি হয়।

মাত্র ১৪ কর্মদিবসে বিচার সম্পন্ন : এ মামলার বিচার ১৪ কর্মদিবসে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মনিরুল ইসলাম মুকুল। তিনি বলেছেন, আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট থেকে নির্দেশনা ছিল মামলা এফআইআর করা থেকে ৯০ দিনের মধ্যে বিচার কার্য সম্পন্ন করা। আইন মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা উনি ঘোষণা করেছিলেন, ৩০ কার্যদিবসে বিচারকার্য সম্পন্ন করতে হবে। আমরা এই নির্ধারিত সময়ের পূর্বে এই মোকদ্দমার বিচার কার্য সমাপ্ত করতে সক্ষম হয়েছি। আমরা ১৪ কর্মদিবসে এই মোকদ্দমার সকল প্রসেস মেইনটেন্স করে আজকে আদালত রায় দিয়েছে।

গতকাল সকালে রায় ঘোষণার পর আদালত প্রাঙ্গণে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, প্রধান আসামি হিটুর প্রাণদণ্ডের পাশাপাশি এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছে আদালত। বাকি তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তারা খালাস পেয়েছে। আমরা রাষ্ট্রপক্ষ, রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পরে আলোচনা করে খালাসকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করব, পরবর্তীতে আমরা সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় মামলার বিশেষ কৌঁসুলি এহসানুল হক সমাজী বলেন, হিটু শেখকে বিচারক সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছেন এবং অপরাপর আসামিদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদেরকে খালাস দিয়েছেন। সুতরাং এই রায়ের মাধ্যমে আরেকটি জিনিস প্রমাণিত হলো যে, বিজ্ঞ বিচারিক আদালত স্বাধীনভাবে তার জুডিশিয়াল মাইন্ড অ্যাপ্লাই করে তিনি জাজমেন্ট প্রদান করেছেন।

অ্যাটর্নি জেনারেলের সমমর্যাদাপ্রাপ্ত এই আইনজীবী বলেন, এই মামলায় ফৌজদারি কার্যবিধি ৩৪২ ধারায় আসামিদেরকে যখন পরীক্ষা করা হয়, বিজ্ঞ বিচারিক আদালত পরিষ্কারভাবে তাদেরকে বলেছেন, ‘পরীক্ষাকালে যে আপনাদের জবানবন্দি এবং যে সাক্ষ্য আপনারা শুনেছেন, আপনাদের কোনো বক্তব্য আছে কি না?’ আসামিরা বলেছে, আমাদের কোনো বক্তব্য নাই। (বিচারক জানতে চেয়েছেন) ‘কোনো লিখিত বক্তব্য দেবেন?’, উনারা বলেছেন, না; ‘কোনো সাফাই সাক্ষী দেবেন?’ উনারা বলেছেন, না। সুতরাং প্রসিকিউশন এভিডেন্স ক্লোজ হওয়ার পরে আইনের বিধান অনুযায়ী, সেকশন ৩৪২ অব দি কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের যে ম্যান্ডেটরি প্রভিশনস, সেটাকে যথাযথভাবে বিজ্ঞ বিচারিক আদালত কমপ্লাই করেছেন। আসামি সেটার সুযোগ না নেওয়ায় পরবর্তীতে বিজ্ঞ বিচারিক আদালত আর্গুমেন্ট এবং আর্গুমেন্টের পরবর্তীতে আজকের রায় প্রদান করেন।

মামলার বাদী রায়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে বলে এক সাংবাদিক বিশেষ কৌঁসুলির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জবাবে সমাজী বলেন, দেখুন প্রথমত আমরা রিপ্রেজেন্ট করি স্টেটকে। কাজেই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে স্টেটের ইন্টারেস্টকে প্রটেক্ট করা। আমি বলেছি, যে আসামিদের বিজ্ঞ বিচারিক আদালত একুইট করেছেন বা খালাস করেছেন; সেই একুইটাল অর্ডারে আমরা সন্তুষ্ট নই। আমরা সেই রায়ের কপি সংগ্রহ করে সেটাকে পর্যালোচনা করে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যথানিয়মে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক উপদিষ্ট হলে বা ইনস্ট্রাক্টেড হলে উচ্চ আদালতে আপিল দায়ের করার সুযোগ রয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘তাড়াতাড়ি রশি নিয়ে আসো, আমি আর পারছি না’
পরবর্তী নিবন্ধসরাইপাড়ায় পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে যুবকের মরদেহ উদ্ধার