হায়রে কপাল : রাস্তার রাজা চিনলি না!

হেলাল উদ্দিন চৌধুরী | রবিবার , ১৬ জুলাই, ২০২৩ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

রাজ্য ছাড়াই এখন রাজা মিলে। রাজা এখন সর্বত্র বিরাজমান। মিডিয়ার কল্যাণে কোলের শিশুটিও গড় গড় করে বলতে পারবে অনেক রাজার নাম। মাছের রাজা ইলিশ, বাত্তির রাজা….। এভাবে অনেক রাজা’র নাম অবলীলায় বলতে পারবে। আমাদের এই সমাজে নিত্যদিন জন্ম নিচ্ছে হাজার পদের “রাজা”। ঘটনা বা দুর্ঘটনাক্রমে হোক সেদিন এমন এক রাজার সন্ধান পেলাম। রাজকাহিনীটা কেন, তাঁর প্রভাব কি তাই বর্ণনা করছি।

যাচ্ছিলাম নগরীর কদম মোবারক হয়ে। ফুটপাতের পাশে জটলা দেখে থামলাম। আমিও জটলায় গা ভাসালাম। দেখলাম এক পঞ্চাশোর্ধ লোক। বসে আছে মাথা নিচু করে। হাতে ধরা একটা ঝুঁড়ি। ঝুঁড়িটাও তার বয়েসী। ঝুঁড়িতে কিছু পেঁয়াজ। আর পাশে এক পোশাকে আশাকে ফ্‌িটফাট সাহেব। অবিরাম বকে চলেছে পেঁয়াজ ব্যাপারীকে। ব্যাটা-“রাস্তা কি তোর বাপের? পেঁয়াজের খোসা ফেলে বরবাদ করে ফেলেছিস! লাথ্‌থি মেরে সব ফেলে দেব।” বকার চোটে বুড়ো মানুষটি দাঁড়িয়ে গেল। লুঙ্গির প্যাঁচ থেকে কি যেন বের করল। আর চট করে ঐ ক্ষ্যাপা মানুষটির হাতে গোঁজে দিল। দেখলাম ঐ গরম মানুষটা এবাউট টার্ন হয়ে গেল। ঘটনা কি জানতে ঐ লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম। জবাব শুনেই আমার “আক্কেল গুড়ুম”। বলল চিনেন না, ঊনি হলেন এ ‘রাস্তার রাজা’। রাস্তা তো আমার বাপের না ঊনা’র। এ রকম ‘রাজা’দের ট্যাক্স দিয়েই আমাদের পেটের ভাত জোগাড় করতে হয়।

এই কাহিনীর এখানে শেষ নয়। রাজা একজন নন। কেউ শেয়ানা রাজা। শেয়ানা রাজার শেয়ানা ট্যাক্স। আইনের ঊর্দি পড়া, প্রভাবশালী গডফাদারের চামচার ট্যাক্স। ইত্যাদি নজরানা দিয়েই ‘এক টুকরী’ পণ্য নিয়ে রাস্তার ধারে বসতে হয়। খাতুনগঞ্জ, রেয়াজউদ্দিনবাজার থেকে পাইকারি পণ্য কেনে ওরা। ভ্যান গাড়ি ভাড়া, কয়েক দফায় ১০ টাকা ৫ টাকা ‘রাজা’দের সালামি আদায়। সব যোগ করে পাইকারিতে কেনা পণ্যের দাম দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যায়। দিন শেষে রাজাদের তুষ্টির পর তাঁর আসল পুঁজিটাও আর থাকে না।

রাস্তার রাজাদের ট্যাক্সের জোগানদার হচ্ছে সাধারণ ভোক্তা। কারণ ঐ কঙ্কালসার মানুষটি ঘামভেজা ঐ টাকাটা পণ্যের বিক্রয় মূল্যের সাথে যোগ করে। সিন্ডিকেট কারসাজিতে নিত্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বি হয়। আর যুক্ত হয় রাজাদের বখশিস। ওপেন সিক্রেট ঘটনার নেপথ্যে আছে আরো চমক। রাস্তার রাজাদের আছেন বস্‌, গডফাদার, আরো অনেক রাজাধিরাজ। রাজা’দের আয়ের একটি অংশ যায় তাদের পকেটে। ওরা আছে আমাদের আশপাশে। তাদের অস্তিত্ব দৃশ্যমান। চলার পথেই ওদের হুংকার। কপালটা মন্দ বলেই হয়তো রাস্তার রাজাকে সেদিন চিনতে পারিনি। রাজদর্শনে নাকি পুণ্য আছে। সে পুণ্য থেকে বঞ্চিত নই এখন। আছিলাম বোকা, হইলাম বুদ্ধিমান। তবে এ রাজা’র কেশাগ্রও ছোঁয়ার সাধ্যি নেই।

হালের ছিটকে রাজাদের চরিত্রের মিল আছে এই রকম একটি প্রচলিত রাজসিক ঘটনা আছে। এক বাদশাহ’র এক চতুর কর্মচারী ছিল। আয়রোজগারে ভীষণ পটু। বাদশাহী’র ছায়ায় সে দিনে দিনে প্রচুর বিত্ত বৈভব গড়ে তুলে। বাদশাহ’র কাছে অভিযোগ যায়। কানে তোলেন না বাদশাহ। কারণ, রাজ কর্মচারীরা তাঁর চাতুর্য দিয়েই মোহিত করে রেখেছে। বাদশাহ একদিন স্বচক্ষেই তাঁর কীর্তি দেখল। বিশাল প্রাসাদটি তাঁর কর্মচারীর বিশ্বাসই করতে পারেননি। খবর নিয়ে জানলেন এইটি নয় শুধু তাঁর অট্টালিকা নামে বেনামে অনেক। তখন বাদশাহ জুবু হলেন। শাস্তিমূলক বদলি করেন। এক নির্জন সমুদ্র তীরে তাঁর ডিউটি দেয়া হল। নতুন দায়িত্বে রাজ কর্মচারী দু’দিনেই পেরেশান। আয়ের রাস্তা বের করতে সময় লাগেনি। দেখলেন সমুদ্রে জাহাজ চলাচলের সময় ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ে। হাঁক ডাক ছাড়লেন। জাহাজওয়ালাদের জরিমানা’র বিধান করলেন। দেখতে দেখতেই তাঁর ঢেউ গুনে ইনকাম আগের তুলনায় কয়েকগুণ বাড়ল। এবার সে প্রাসাদ নির্মাণ শুরু করলো বাদশাহ’র প্যালেসের কাছেই। নজর এড়ালোনা বাদশাহ’র। বাদশাহ’র ডাক পড়ল রাজ প্রাসাদে। বাদশাহ এবার কর্মচারীর বুদ্ধিরই তারিফ করলেন। বললেন জানলে ঢেউ গুনেও আয় করা যায়। আমাদেরও এ রকম ‘বুদ্ধিমান’ এর জন্ম হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাদের কারসাজিতেই দুই অংকের কাঁচা মরিচ রাতারাতি চার অংক ছাড়িয়ে যায়। এভাবেই কেউ ভাগ্য গড়ছে, আর বিস্ফারিত নয়নে আমজনতা’র মতো বাদশাহও বলছে “চেয়ে চেয়ে দেখলাম, আমার বলার কিছু ছিল না।”

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক; সাবেক সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধমানস চিন্তার মগ্ন দৌবারিক