হালিশহরের সাকি আক্তার এলেন তিন মেয়েকে নিয়ে

সংঘাতে এলোমেলো সুদানে রয়ে গেছেন স্বামী

আজাদী ডেস্ক | মঙ্গলবার , ৯ মে, ২০২৩ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ

শ্রমিক হয়ে যারা গিয়েছিলেন সশস্ত্র সংঘাতের পর তাদের কেউ কেউ কোনো রকমে যেন পালিয়ে বেঁচেছেন সুদান থেকে, ফিরেছেনও একেবারে খালি হাতে। দুর্ভাগ্যের কথা শোনালেন ভাগ্য বদলাতে স্বামীর সঙ্গে আট বছর আগে সুদান পাড়ি দেওয়া চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহরের সাকি আক্তার। কোলের তিন মেয়ে আর নিজের জীবন সঙ্গে করে আরেক অনিশ্চিত জীবনে ফিরতে হওয়ায় কাতর শোনালো তার কণ্ঠও। জানালেন সঙ্গে আনতে পারেননি সেখানকার সংসারের কিছুই। সংঘাতে এলোমেলো সুদানে রয়ে গেছেন তার স্বামী মোহাম্মদ বাহাদুর। এত বলার পরও তাকে সঙ্গে আসতে রাজি করাতে পারেননি।

পোর্ট সুদানে সন্তান ও স্ত্রীকে জেদ্দাগামী উড়োজাহাজে তুলে দিয়ে বিদায় দেওয়ার সময়ও বাহাদুর আশায় রয়েছেন, সেখানকার পরিস্থিতি ভালো হবে। তিনি খার্তুমে ফিরবেন তার ব্যবসার স্থলে। খবর বিডিনিউজের। ভয় আর আতঙ্কে মুষড়ে যাওয়া তিন বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে দেশে ফেরার পর কান্না বিজড়িত কণ্ঠে নিজের স্বামীকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা বলছিলেন সাকি, আমার স্বামী এখনও আসে নাই। ও ওখানেই আছে। সব কিছু শেষ। আমি ওরে ফেলে আসতে চাই নাই। অনেক বলসি চলে আসো। আসলো না। আমি পারলে এক বেলা খাইলে আরেক বেলা খাব না, তবুও চলে আসো। তুমি থাকলে আমার খাওয়ার অভাব নাই।

সশস্ত্র সংঘাত ঘেরা সুদানের রাজধানী খার্তুমে ১৫ বছর ধরে ছোট ব্যবসা করা বাহাদুরের অর্থ আর ভবিষ্যতের চিন্তার কাছে হার মেনেছে স্ত্রীর এমন আকুতি।

সাকি বলেন, ও আমার কথা শুনলো না। বলতেছে, আমি যদি এভাবে চলি যাই, আমার তো কিচ্ছু নাই, আমি সম্পূর্ণ নিঃস্ব। এই অবস্থায় চলে গেলে আমার বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ কী হবে। আমার তিনটা মেয়ে আমি কীভাবে কী করব, তাদের খরচ কই থেকে দেব।

সাকি আক্তার বলেন, এরপরে আমাদের টাইম দিল শারিয়া আল সিত্তিন (খার্তুমের বাসছাড়ার স্থান) যাওয়ার জন্য। আমাদের এই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে রাত সাড়ে তিনটা চারটার সময় বের হতে হতো। কিন্তু এমন পরিস্থিতি যে রাতে বের হওয়া যেত না। এরপরে একটা হোটেলে যেতে বলল। সেখানে অনেকটা সময় আটকে ছিলাম। আমাদের গেটের সামনে অনেক গোলাগুলি। আমরা আবার ভয় পেয়ে গেছি, কোনো খাবার নাই, শুধু পানি, বাচ্চাদের খাওয়ার কিছু নেই। এখানে যদি আটকে যাই।

গতকাল আসা আরেকজন হলেন নিশিকান্ত বিশ্বাস। সংঘাতে বিশৃঙ্খল দেশটি থেকে ফিরিয়ে আনাদের প্রথম দলের সঙ্গে ফ্লাইট থেকে ঢাকায় নেমে হাঁটছিলেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। গতকাল শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিশিকান্ত বললেন, ওরাওরাই, সুদানিরাই মারামারি করতিছে। পাবলিক সামনে পালিই মারতিছে। লুটপাট, ডাকাতি করতিছে। কাইড়েকুইড়ে নিচ্ছে, ডাকাতি কইত্তিছে। খাওয়ার কিছু নেই। আমার স্বর্বস্ব নিয়ে গেছে। পায়ে মারছে। মোবাইলটা বাঁচাইতে চাইছিলাম। পায়ে বাড়ি দিছিল। আমার পায়ে সমস্যা হয়ে গেছে।

আতঙ্কের সময়গুলো পেছনে ফেলে দেশে আসতে পেরে স্বস্তি পেলেও সামনের দিনগুলোর কথা ভেবে চিন্তাভাবনার কোনো খেই পাচ্ছেন না তিনি। জানুয়ারিতে দালাল ধরে গেলেন সুদানে, পাঁচ মাস না যেতেই ফিরতে হলো তাকে। কপাল ফেরার বদলে তার ভাগ্যে নেমেছে ঘোর অমানিষা।

সুদানের দুই বাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে খার্তুম থেকে ২ মে রাতে পোর্ট সুদানে পৌঁছান ৬৮২ বাংলাদেশি, সেখানে তাদেরকে একটি মাদ্রাসায় অস্থায়ীভাবে রেখে ফেরানোর কার্যক্রম চলছে। শুরুতে পোর্ট সুদান থেকে জাহাজে করে জেদ্দায় আনার কথা ছিল এসব প্রবাসীকে। শেষ পর্যন্ত সৌদি বিমান বাহিনীর ফ্লাইটে তিন দফায় ১৩৬ জনকে অন্য দেশের নাগরিকদের সঙ্গে জেদ্দায় পাঠানো হয়। প্রথম দল হিসেবে সেখান থেকে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে গতকাল সকালে তারা ঢাকায় ফেরেন। প্রথম দফায় সুদান ছাড়তে পারা প্রবাসীদের মধ্যে নারী, শিশু ও অসুস্থ যাত্রীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস।

গতকাল সুদান থেকে আসা প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলেন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ। বিমানবন্দরে সুদান প্রবাসীদের ফেরার সময় উপস্থিত ছিলেন তিনি।

আতঙ্কেনির্যাতনে কেটেছে দিন : চার মাসের এক শিশুকে কোলে নিয়ে সুদান থেকে ফিরেছেন সাহারা বেগম। আতঙ্কের ঘোর কাটছিল না তার। তিনি বলেন, এই বাচ্চা নিয়ে প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে ছিলাম। নানা দিক থেকে এসে গুলি পড়তো। ভয়ানক আওয়াজ, পরিস্থিতি ওখানে খুবই খারাপ।

ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা : সুদান থেকে প্রথম দফায় যে ১৩৬ জন বাংলাদেশি ফিরেছেন তাদের কেউ কেউ সুদানে বিভিন্ন কোম্পানিতে শ্রমিকের কাজ করতেন, কেউবা করতে ছোট ব্যবসা। দেশ থেকে পুঁজি জড়ো করে তারা সুদান গিয়েছিলেন নিজেদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করতে। তবে এই সংঘাত পরিস্থিতিতে পড়ে তারা এখন শঙ্কায় পড়েছেন ভবিষ্যৎ নিয়ে।

চলমান পরিস্থিতি সামাল দিতে সুদানফেরত প্রবাসীদের ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বাগত জানানোর সময় প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড প্রত্যেকের হাতে তিন হাজার টাকা তুলে দেয়। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওম) থেকে দেওয়া হয় দুই হাজার টাকা ও খাদ্য সহায়তা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা চলবে
পরবর্তী নিবন্ধসাত বছর পর রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে