মৎস্য বিভাগের উদাসীনতার কারণে হালদা পাড়ের দুটি হ্যাচারি গত এক দশকের বেশি সময় ধরে পরিত্যক্ত হয়ে আছে। মাছের ডিম সংগ্রহকারীরা যাতে আধুনিক পদ্ধতিতে ডিম থেকে পোনা উৎপাদন করতে পারে সেই লক্ষ্য নিয়ে হাটহাজারী ও রাউজানে হালদার উভয় পাড়ে মৎস্য বিভাগ সর্বমোট ৬টি হ্যাচারি প্রতিষ্ঠা করেছিল। জানা যায়, হাটহাজারী অংশের তিনটি হ্যাচারি ভাল অবস্থায় থাকলেও রাউজানের তিনটির মধ্যে দুটিই অকেজো হয়ে আছে।
দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী এখন সরকার ঘোষিত বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ। এই নদী থেকে প্রতি বছর মাছের ডিম সংগ্রহ করে হাজার হাজার পরিবার জীবন জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।
জানা যায়, বছরের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে সৃষ্ট বজ্রবৃষ্টির মাঝে মা মাছ নদীতে ডিম দেয়। নদী পাড়ের কয়েকশ’ মৎস্যজীবী নৌকা নৌঙর করে জাল পেতে ডিম সংগ্রহ করে অতিযত্নে পোনায় রূপান্তর করেন। সদ্য উৎপাদিত প্রতি কেজি পোনা বিক্রি হয়ে থাকে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত দরে। নদীর পাড়ের মৎস্যজীবীরা বলেছেন আদিকাল থেকে ডিম সংগ্রহকারীরা সংগৃহীত ডিম মাটির কুয়ায় রেখে পোনায় রূপান্তর করে আসছেন। মৎস্য বিভাগ আধুনিক পদ্ধতিতে ডিম ফোটানোর কথা বলে হ্যাচারি প্রতিষ্ঠা করলেও কয়েক বছর না যেতেই রাউজানের তিনটি মধ্যে দুটি হ্যাচারি অকেজো হয়ে পড়েছে।
গতকাল ৯ এপ্রিল নদীপাড়ে ঘুরে দেখা গেছে, ডিম সংগ্রহ করার প্রস্তুতিতে থাকা মৎস্যজীবীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন মাটির কুয়া তৈরি ও আগের কুয়া সংষ্কার করার কাজে। কেউ কেউ জাল, নৌকা প্রস্তুত রেখে অপেক্ষার প্রহর গুণছেন নদীর পাড়ে বসে। ডিম সংগ্রহের জন্য প্রস্তুতি থাকা আজিমের ঘাটের মৎস্যজীবী রোসাঙ্গীর আলমের সাথে কথা বলে জানা যায়, এবার নদীতে প্রচুর সংখ্যক মা মাছের আনাগোনা রয়েছে। তার ধারণা প্রাকৃতিক দুর্যোগমুক্ত পরিবেশে মা মাছ ডিম দিলে এবার কাঙ্খিত পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করতে পারবেন তারা। নিজের অভিজ্ঞার আলোকে তিনি দাবি করেন আধুনিক পদ্ধতিতে হ্যাচারিতে ডিম ফোটানো হলে ডিম নষ্ট হয় কম। কিন্তু মাটির কুয়ায় ডিম রেখে পোনা উৎপাদন করা হলে সেসব পোনা দ্রুত বর্ধনশীল ও শারীরিক গঠন ভাল হয়।
হাটহাজারী ও রাউজান অংশের হালদা পাড়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে কথা হয় অনেকের সাথে। হাটহাজারী ডিম সংগ্রহকারী কামাল সওদাগর বলেছেন, মাছের আনাগোনা দেখে তিনি ৭টি নৌকায় ডিম সংগ্রহের প্রস্তুতি নিয়ে আছেন। মাটির কুয়া করেছেন ৮টি।
জানা গেছে, হাটহাজারী অংশে ডিম সংগ্রহের জন্য ২৫টি গ্রুপ ৭০টি মাটির কুয়ায় তৈরি করে রেখেছে। রাউজানের ২৭টি গ্রুপ ৭৫টি মাটির কুয়া ইতিমধ্যে প্রস্তুত করে রেখেছে।
রাউজান উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছেন, হালদার রাউজান অংশে পশ্চিম গহিরা, মোবারকখীল, কাগতিয়ায় ৩টি হ্যাচারি রয়েছে। তিনটির মধ্যে পশ্চিম গহিরা ও কাগতিয়ার দুটি অকেজো বলে তিনি স্বীকার করেন। হাটহাজারী অংশে মদুনাঘাট বড়ুয়া পাড়া, উত্তর মাদার্শায় শাহ মাদারী ও মাদার্শায় মাছোয়া ঘোনার হ্যাচারি সচল রয়েছে বলে তিনি জানান।
খবর নিয়ে জানা যায়, হালদার মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন কাজে থাকা এনজিও সংস্থা আই.ডি.এফ হালদা প্রকল্পের আওতায় রাউজানের গড়দুয়ারা অংশের চিপাহীঘাট এলাকায় একটি হ্যাচারি নির্মাণ করছে। প্রকল্প ব্যবস্থাপক সজিব হোসেন বলেন, তাদের এই হ্যাচারিতে ডিম ফোটানোর সুবিধা পাবেন ৩০জন ডিম সংগ্রহকারী। এখানে অন্তত দেড়শ কেজি ডিম থেকে রেণু ফোটানো যাবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ডিম সংগ্রহকারীদের সুবিধার্থে সব হ্যাচারি কার্যকর করা উচিত ছিল। ডিম দেয়া প্রসঙ্গে বলেন, সম্প্রতি সিসি ক্যামেরা বসানোসহ প্রশাসনের নজরদারি বাড়ায় হালদার মনিটরিং সহজ হচ্ছে। নিরাপত্তা বেড়েছে। ফলে মাছের আনাগোনা বেড়েছে। তিনি মনে করেন ঝড় বৃষ্টি শুরু হলে অমাবশ্যা অথবা পূর্ণিমা তিথিতে মা মাছ ডিম দিতে পারে। এই বিশেষজ্ঞের অভিমত হ্যাচারির চাইতে মাটির কুয়ায় উৎপাদিত রেণু উৎকৃষ্ট মানের হয়। মৎস্যজীবীদের অভিজ্ঞতা আর পরিশ্রম অনুযায়ী মাটির কুয়ায় ফোটানো ডিম থেকে পোনা উৎপাদনের পরিমাণ কম-বেশি হলেও পোনার মান থাকে উন্নত।
উল্লেখ্য, গত বছর হালদায় বিগত ১৪ বছরের রেকর্ড ভেঙে ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম সংগ্রহ করেছিলেন ডিম আহরণকারীরা। এবছর হালদায় মা মাছের নিরাপত্তা জোরদার করায় কাঙ্খিত ডিম পাওয়ার আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।












