আজ ২৪ জানুয়ারি। চট্টগ্রাম গণহত্যা দিবস। ১৯৮৮ সালের এই দিনে চট্টগ্রাম লালদিঘির ময়দানে যাওয়ার পথে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালালে ২৪ জন মারা যান। আহত হন কমপক্ষে দুই শতাধিক কর্মী। শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টা হিসেবে ঘটনাটি ব্যাপক আলোচিত। এই ঘটনার নির্দেশদাতা হিসেবে আলোচিত তৎকালীন পুলিশ কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদা মৃত্যুবরণ করায় মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। তবে ‘হুকুমদাতা’ গোবিন্দ চন্দ্র মণ্ডলের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছে। সেইসঙ্গে আরও চারজন তৎকালীন পুলিশ কনস্টেবলের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। কারাগারে থাকা এসব আসামিরা হলেন- মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, শাহ মো. আব্দুল্লাহ এবং মমতাজ উদ্দিন।
আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নেতা এইচ এন আশিকুর রহমান তাঁর এক স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ২৪ জানুয়ারি ১৯৮৮ আমরা সকালে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পৌঁছালাম। বিমানবন্দর লোকে লোকারণ্য। আমাদের ও নেত্রীর জন্য খোলা ট্রাকের বহর। নেত্রী এক ট্রাকে এবং আমি অন্য এক ট্রাকে। নেত্রী কী মনে করে জানি না আমাকে তার ট্রাকে ডেকে নিলেন। আমরা জনসভার উদ্দেশে রওনা দিলাম লালদীঘির পথে। ১৫ দলীয় জোটের ওই প্রস্তাবিত সভায় তিনি ছিলেন প্রধান অতিথি।
মাত্র কয়েক মাইল রাস্তা। যাওয়ার সময় যে অভূতপূর্ব দৃশ্য তা ভোলার নয়। রাস্তার দু’পাশে এবং পার্শ্ববর্তী ঘরবাড়িতে মহিলা-পুরুষ, ছাত্রছাত্রী, শিশু-কিশোর অগণিত মানুষ। চারদিকে শুধু পুষ্পবৃষ্টি ও স্লোগান। মনে হয় সেদিন পুরো দেশ ভেঙে পড়েছিল রাস্তার ওপরে শেখ হাসিনাকে অভিবাদন, অভ্যর্থনা ও সমর্থন জানানোর জন্য। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এরূপ আবেগ ও ভালোবাসার জোয়ার আর কোনোদিন আমার চোখে পড়েনি। আধা ঘণ্টার রাস্তা আমরা ৩ ঘণ্টায় অতিক্রম করলাম। ক্রমে ক্রমে পৌঁছলাম লালদীঘি ময়দানে। চারদিকে জনতার ভিড় ভেঙে ছুটে আসছে জনতা। শেখ হাসিনা হাত নাড়িয়ে অভিনন্দনের জবাব দিচ্ছেন এবং আমাদের ট্রাকগুলো মন্থরগতিতে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে মূল মাঠে। হঠাৎ দেখি জনাব আখতারুজ্জামান চৌধুরী, তিনিও ওই ট্রাকে ছিলেন- আমার হাত ধরে টানছেন, বলছেন গুলি হচ্ছে। আমি অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে ঘুরলাম, কেননা গুলি হতে হলে অবশ্যই তার পূর্ব সতর্কবার্তা ঘোষণা করতে হবে; আমার আমলা জীবনের অভিজ্ঞতা বাস্তবতার কাছে হার মানল। মুহূর্তের মধ্যে চারদিকে লুটিয়ে পড়েছে অনেকে- অনেকের মগজ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে চারদিকে। সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন আহত, গাড়ি থেকে নিচে পড়ে গেছেন। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম কয়েকজন পুলিশ মাত্র ১০-১২ হাত দূর থেকে আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার দিকে রাইফেল তাক করেছে- তারা বলছে ‘গুলি করি, গুলি করি’। সে মুহূর্ত মনে হল অনন্তকালের জন্য সময় স্তব্ধ হয়ে গেল- চরম পরিণতি এলো বলে। কিন্তু কানে এলো নেত্রীর বজ্র কঠিন কণ্ঠ, ধমক দিলেন-‘কাকে গুলি করবে? বন্দুক নামাও’। মুহূর্তের মধ্যে যেন ত্বরিত স্পর্শে বজ্রাহত তারা রাইফেল নামিয়ে ফেলল। আমার মনে হয় পুলিশদের মাদক খাইয়ে সেদিন কর্তব্যে নিয়োজিত করা হয়েছিল এবং তারা চরম নির্দেশ নিয়েই এসেছিল- তা না হলে কী করে সম্ভব তারা সরাসরি বন্দুক উঁচিয়ে নেত্রীকে বলছে ‘গুলি করি, গুলি করি’। স্পষ্টতই তাদের মাদকসেবন করানো হয়েছে এবং তারা সরাসরি নির্দেশ পালন করছিল। দেখলাম নেত্রীর অসীম সাহস, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব্ব, রাইফেলের গুলির মুখে দৃঢ়তা ও অবিচল বিচক্ষণতা। সত্যি অভাবনীয় এবং আমার জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা। মনে হয় সেদিন আরেক জন্ম হল। জননেত্রী শেখ হাসিনা শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি বয়ে চলেছেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন এবং তার দায়ভার। তিনি বহুবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন, চেষ্টা হয়েছে বারবার তাকে হত্যা করার। তার সাহসিকতা, দৃঢ় সংকল্প তাকে অনন্য করেছে।…পুরো বাংলাদেশ স্তম্ভিত, চট্টগ্রাম মুহূর্তে ভুতুড়ে শহরে পরিণত হল। এ ঘটনায় ২৪ জন মুহূর্তের মধ্যে নিহত হন এবং দুই শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। এটি ছিল গণহত্যা। গণহত্যা পূর্বপরিকল্পিত ও শেখ হাসিনাই নিঃসন্দেহে ছিলেন আসল লক্ষ্য।
আসলে ২৪ জানুয়ারির গণহত্যা ছিল সুপরিকল্পিত। সেদিন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করে স্বৈরশাসন চিরস্থায়ী করার পরিকল্পনা ছিল। যারা এ হামলা করেছিল, তাদের উত্তরসূরিরা কিন্তু এখনও সক্রিয়। আমাদের এ জন্য এখনও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।