আজ সকালে মেঘলা আকাশ, সূর্য হয়তো উঠবে না। সূর্যমুখী ফুলটি আমার, তাই বলে কি ফুটবে না? সূর্যমুখীর একটি ফুল যেন সৌন্দর্যের রাণী। তাই এ সূর্যমূখী নিয়ে রচিত হয়েছে বহু গান, কবিতা। তেলজাত শস্য হলেও প্রকৃতির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়ে তা এখন বাতাসে দোল খাচ্ছে আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, হাটহাজারীর গবেষণা মাঠে। এ সূর্যমুখী ফুলের অপরূপ দৃশ্য দেখতে প্রতিদিন শতশত পর্যটকের ভীড় চোখে পড়ার মতো। হলদে ফুলের সমারোহ হারিয়ে যেতে পর্যটকরা ভিড় জমাচ্ছেন সূর্যমূখী বাগানে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ফুটে থাকা এ ফুল স্থানীয় ও শহুরে পর্যটকদের টানছে এক অমোঘ আকর্ষণে। এ নিয়ে সোস্যাল মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও প্রিন্ট মিডিয়া প্রতিদিন রীতিমতো হুমড়ী খেয়ে পড়ছে। জানতে চাচ্ছে এ ফুলের চাষ পদ্ধতি ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ ফুলের সম্ভাবনা নিয়ে। স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইদানীং ভোজ্য তেল হিসাবে সূর্যমুখী ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে বাংলাদেশে। মূলত আমদানীর মাধ্যমেই দেশে এর চাহিদা পূরণ হচ্ছে। তাই দেশেই সূর্যমুখীর আবাদ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
সূর্যমুখী দেখতে শুধু রূপময় নয় গুনেও অনন্য। পুষ্টিগুণে অন্যসব তেলবীজ থেকে শ্রেষ্ঠ। সূর্যমুখী ফুলে মেলে স্থাস্থ্যকর তেল। এ তেল স্বাস্থ্যের জন্য অসাধারণ। অন্যান্য তৈল বীজে যেসব ক্ষতিকারক উপাদান (যেমন কোলেস্টরল) থাকে সূর্যমুখী তেলে তা নেই। আন্তর্জাতিক পুষ্টিবিদদের দেয়া তথ্যমতে সূর্যমুখী তেলে আছে প্রায় শতকরা ৯৯ ভাগ উপকারী ফ্যাট। আরো আছে মানব দেহের জন্য উপকারী ওমেগা ৬, ওমেগা ৯, আছে ফলিক এসিড। তাই এ তেলের দামও বেশি। আমরা বিদেশ থেকে রিফাইন্ড সয়াবিন তেল আমদানী করি, তাতে আছে ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান। অথচ আমরা যদি দেশীয় ভাবে সূর্যমুখীর বীজকে প্রাধান্য দিয়ে রিফাইন্ড না করেও শুধু ঘানিতে সূর্যমুখীর বীজ থেকে তেল আহরণ করি তাও অনেক স্বাস্থ্যসম্মত। সূর্যমুখী তেল অন্যান্য সাধারণ তেলের চাইতে একটু আলাদা। প্রচুর পরিমাণে প্রাণশক্তি থাকায় সূর্যমুখী বীজের তেল আমাদের শরীরের দুর্বলতা কাটাতে অত্যন্ত কার্যকর। আমাদের শরীরের কার্যক্ষমতা বাড়াতে এবং শরীরকে দীর্ঘদিন কর্মক্ষম রাখতেও সূর্যমুখী তেলের ভূমিকা অনন্য। এক গবেষণায় দেখা গেছে রান্নার জন্য সয়াবিন তেলের চাইতে সূর্যমুখী বীজ থেকে পাওয়া তেল দশগুণ বেশী পুষ্টিমান সমৃদ্ধ। এই বীজে আছে ভিটামিন ই, যা শরীরের নানা রকম ব্যথা দূর করতে সহায়তা করে, চুলের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখে। সূর্যমুখী তেলে থাকা ম্যাগনেসিয়াম আমাদের মানসিক চাপ দূর করে। মস্তিষ্ক শান্ত রাখতে, ত্বকের লাবণ্য ধরে রাখতে, ওজন কমাতে এবং হৃদপিণ্ড ভালো রাখতে সূর্যমুখী তেলের জুড়ি মেলা ভার। এ তেল সেরা রান্নার তেল হিসাবে বেশ পরিচিত। এছাড়া সূর্যমুখীর খৈল গরু ও মহিষের উৎকৃষ্টমানের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এর বীজ ছড়ানোর পর মাথাগুলো গরুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। গাছ ও পুষ্পস্তবক জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
১৯৭৫ সাল থেকে সূর্যমুখী একটি তৈল ফসল হিসাবে বাংলাদেশে আবাদ হচ্ছে। দেখতে সূর্যের মতো হওয়ায় এবং সূর্যের দিকে মুখ করে থাকায় এর নামকরণ সূর্যমুখী হয়েছে। এ ফুলটি সূর্যদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সূর্যের গতিপথ লক্ষ করে আকাশ পানে চেয়ে থাকে। দেশের উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়া, গাজীপুর এবং নোয়াখালী জেলায় ব্যাপক চাষ হলেও হাটহাজারীতে পরীক্ষামূলকভাবে বীজ উৎপাদনের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয়বারের মতো চাষ হয়েছে। বারি সূর্যমুখী-৩ নামে এক একর জমিতে বীজ উৎপাদনের উদ্দেশ্যে চাষ শুরু হয়। এ জাতের গাছের উচ্চতা ৭৫-৮০ সে.মি.। প্রতি মাথায় বীজের সংখ্যা ৪১০-৮২৯টি। বীজে তেলের পরিমাণ শতকরা ৩৮-৪০ ভাগ। মৌসুম অনুসারে ফসল পরিপক্ব হতে ৯০-১০৫ দিন সময় লাগে। দেশের সকল জেলায় এজাতটি চাষের উপযোগী। এ জাতের গাছ খাটো হওয়ায় সহজে বাতাসে হেলে পড়ে না। মধ্য নভেম্বর থেকে মধ্য ডিসেম্বর পর্যন্ত বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। প্রতি হেক্টরে ১২-১৫ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। উত্তম পরিচর্যা করলে প্রতি হেক্টরে ফলন ১.৫-২.০ টন পাওয়া সম্ভব। সূর্যমুখী সারিতে বপন করতে হয়। সারিতে বপন করলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫০ সে.মি. এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২৫ সে.মি. রাখতে হয়। রোগ-বালাই অপেক্ষাকৃত কম। তবে পাতা ঝলসানো রোগ ও ঢলে পড়া রোগ দেখা যায়। এটা সঠিক উপায়ে দমন করে সুপারিশমাত্রায় সার প্রয়োগ করলে কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া সম্ভব।
দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় চট্টগ্রাম অঞ্চলেও সূর্যমুখী ফুল চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এর উৎপাদন খরচ অপেক্ষাকৃত কম। আমন পরবর্তী পতিত জমিতে সহজেই সূর্যমুখী চাষ করা যায়। তাতে বিঘাপ্রতি বছরে অতিরিক্ত ১০,০০০ টাকা আয় করা সম্ভব। বর্তমানে সূর্যমুখী তেলবীজের মণ প্রতি স্বাভাবিক বাজার মূল্য ১৪০০-১৬০০ টাকা। নিজে তেল ভাঙালে শতাংশ প্রতি উৎপাদিত ১২ কেজি বীজ থেকে ৪ লিটার তেল ও ৮ কেজি খৈল পাওয়া যায়। শতাংশ প্রতি ২৩০ টাকা উৎপাদন খরচ ও ১২০ টাকা তেল ভাঙানো খরচ বাদ দিলে নীট লাভের পরিমাণ বিঘায় ১০ হাজার টাকারও বেশি হবে। সমভূমি এলাকায় শীত ও বসন্তকালে, উঁচু লালমাটি এলাকায় ও সমুদ্র কুলবর্তী এলাকায় শীতকালীন ফসল হিসাবে চাষ করা হয়। বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত উর্বর পতিত জমিতেও এ চাষ বাড়ানো যেতে পারে। সূর্যমুখী মাঝারী লবণাক্ত মাটিতেও চাষ করা সম্ভব। চট্টগ্রাম জেলায় প্রায় ২০০০ একর জায়গা চলতি পতিত রয়েছে। সেসব জায়গায় বারি সূর্যমুখী-৩ জাতটি চাষ করা যেতে পারে। মাত্র একটা সেচেই সূর্যমুখী চাষ করা সম্ভব। ইচ্ছে করলে সূর্যমুখীর মধ্যে লালশাক, পালংশাক, ধনেপাতা প্রভৃতি স্বল্পমেয়াদী শাক-সব্জী আন্ত:ফসল হিসাবে চাষ করে বাড়তি আয় করা সম্ভব। তবে এ জন্য কৃষকদের সঠিক সময়ে বীজ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। আধুনিক চাষ পদ্ধতির উপর, বীজ থেকে তেল আহরণের উপর বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে কৃষক সহজেই উদ্বুদ্ধ হবে। একই সাথে সূর্যমুখীর বীজ থেকে তেল বের করার জন্য যন্ত্র উদ্ভাবনের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। পরিশেষে তেলের ঘাটতি মেটাতে বারি সূর্যমুখী-৩ জাতের চাষ ব্যাপক আকারে আবাদের ব্যবস্থা করতে পারলে দেশের ভোজ্য তেলের ঘাটতি অনেকাংশে লাঘব হবে। আর এ জন্য সংশ্লিষ্ট কৃষি গবেষণা ও কৃষি বিভাগের মধ্যে সমন্বয় থাকাটাও বেশ জরুরি।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এর সাবেক ন্যাশনাল কনসালটেন্ট, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, বারি, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।