হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলার অর্ধেকই অকেজো

নগরীর চার হাসপাতাল

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ২৯ জুন, ২০২১ at ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ

শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য ভেন্টিলেটরের চেয়ে হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলাই (এইচএফএনসি) সবচেয়ে বেশি জরুরি। এর মাধ্যমে শ্বাসকষ্টের রোগীকে উচ্চ মাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহ করা যায়। তাই শ্বাসকষ্টের জটিলতা বা অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাওয়া রোগীদের জন্য এই হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলাই জীবন রক্ষাকারী হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু বছর না যেতেই বিত্তশালীদের কাছ থেকে দান-অনুদান হিসাবে পাওয়া এসব ক্যানুলার প্রায় অর্ধেকই অকেজো হয়ে পড়েছে।
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে করোনার বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে এসব হাই ফ্লো ক্যানুলার মাধ্যমে অনেক রোগীর জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন চিকিৎসকরা। যদিও প্রথম দিকে এই হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলার জন্য হাহাকার ছিল চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে। সরকারিভাবে কোন বরাদ্দ ছিল না। অনেকটা দামি এ যন্ত্র পেতে তাই বিত্তশালীদের দান-অনুদানই ছিল ভরসা। চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টরা জানান, মান ভেদে এ যন্ত্রের দাম ৫ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা। একদিকে, করোনা আক্রান্ত ও শ্বাসকষ্টের রোগীর অস্বাভাবিক চাপ হাসপাতালে। অন্যদিকে, আইসিইউ ও হাই ফ্লো ক্যানুলা সংকট। অনেকটা নিরুপায় হয়ে হাই ফ্লো ক্যানুলা নিয়ে রোগীদের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসার জন্য বিত্তশালীদের প্রতি আহ্বান জানান চিকিৎসক ও হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা। এ নিয়ে গত বছরের ১৯ জুন ‘এ মুহূর্তে বেশি জরুরি হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা/বিত্তশালীদের প্রতি এগিয়ে আসার আহবান চিকিৎসকদের’ শিরোনামে প্রধান প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক আজাদী। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরপর সমাজের বিত্তশালী অনেক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।
দান-অনুদান হিসেবে জীবন রক্ষাকারী হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা হস্তান্তর করেন হাসপাতালগুলোতে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ও বিআইটিআইডি হাসপাতাল অনুদান হিসেবে এই যন্ত্র পায়। পাশাপাশি বেসরকারি মা ও শিশু হাসপাতালেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা দান করেন বিত্তশালীরা। সবমিলিয়ে অন্তত শতাধিক হাই ফ্লো ক্যানোলা অনুদান হিসেবে পায় এই চারটি হাসপাতাল। এই যন্ত্রে অনেক শ্বাসকষ্টের রোগীর জীবনও রক্ষা হয়েছে। কিন্তু বছর না যেতেই এসব যন্ত্রের প্রায় অর্ধেকই অকেজো হয়ে পড়েছে। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন- অনুদান হিসেবে পাওয়া এই যন্ত্রের বেশির ভাগই চায়না কোম্পানির। যা নিম্মমানের। তাই অল্প কদিনের মধ্যেই বেশ কিছু পার্টস (যন্ত্রাংশ) নষ্ট হয়ে গেছে। পার্টস নষ্ট হওয়ায় যন্ত্রটিই অকেজো হয়ে পড়েছে। সেটি আর ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বেশ কিছু যন্ত্র আবার রিপেয়ারিংও (মেরামত) করা যাচ্ছে না। এ নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলছেন- এখন করোনা পরিস্থিতিও ফের উদ্বেগজনক পর্যায়ে। পরিস্থিতি আগের চেয়েও খারাপ হতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। সেটি হলে আবারো এই হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলাই জরুরি ও অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চমেক হাসপাতালের ৬১টি হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলার মধ্যে ২১টি-ই অকেজো হয়ে গেছে। বর্তমানে ৪০টি সচল রয়েছে জানিয়ে হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর আজাদীকে বলেন, এঙেসরিজ পেলে হাতে গোনা কয়েকটি হয়তো সচল করা যাবে। কিন্তু কিছু সংখ্যক একদম অকেজো হয়ে পড়েছে।
৩০টি হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলার মধ্যে অর্ধেকই (১৫টি) বর্তমানে অকেজো বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা টিমের ফোকাল পারসন ডা. আব্দুর রব মাসুম। পুনরায় জটিল রোগীর চাপ বাড়ছে। কিন্তু অর্ধেক হাই ফ্লো ক্যানোলা নষ্ট হয়ে আছে। এটি চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেন এই চিকিৎসক।
যদিও অকেজো এসব যন্ত্র মেরামতের চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানান জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে থাকা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা এরইমধ্যে কথা বলেছি। বিভাগীয় করোনা প্রতিরোধ কমিটির কাছে মঙ্গলবারই (আজ) এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হবে।
ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি হাসপাতালে সবমিলিয়ে ৮টি হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা রয়েছে। এর মধ্যে ২টি অকেজো বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের করোনা টিমের ফোকাল পারসন ডা. মামুনুর রশীদ।
অন্যদিকে, দান-অনুদান হিসেবে অর্ধশতাধিক হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা পায় বেসরকারি মা ও শিশু হাসপাতাল। কিন্তু ১৪টি যন্ত্র এরই মধ্যে অকেজো হয়ে গেছে বলে জানান হাসপাতালের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. নুরুল হক। তিনি বলেন, এগুলোর অধিকাংশই চায়না কোম্পানির। বেশির ভাগ যন্ত্রের পার্টস নিম্মমানের। সহজে রিপেয়ারিংও করা যাচ্ছেনা। এগুলো নিয়ে বেকায়দায় পড়েছি।
চিকিৎসকরা বলছেন- শ্বাসকষ্ট দেখা দিলেই সংশ্লিষ্ট রোগীকে ভেন্টিলেটর দিতে হাহাকার করতে দেখা যায়। কিন্তু শ্বাসকষ্টের রোগীর জন্য বেশি প্রয়োজন হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা। এটি পেলে শ্বাসকষ্টের অনেক রোগীকে বাঁচানো সম্ভব। যদিও আইসিইউ কিংবা এইচডিও শয্যায় রেখেই রোগীকে এই হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলার মাধ্যমে উচ্চ মাত্রায় অঙিজেন দিতে হয়। আইসিইউ কিংবা এইচডিও শয্যা ছাড়া এই অঙিজেন দেয়া যায় না। তাছাড়া রোগীকে এই হাই ফ্লো অঙিজেন দিতে হলে অ্যানেসথেসিস্টের পাশাপাশি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অঙিজেন প্লান্ট থাকা অপরিহার্য।
স্বাভাবিকভাবে সেন্ট্রাল অঙিজেন লাইনের মাধ্যমে ১৫ লিটার পর্যন্ত অঙিজেন সরবরাহ দেয়া হয় রোগীকে। কিন্তু শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে কিংবা অঙিজেনের স্যাচুরেশন একদম কমে গেলে রোগীকে আরো উচ্চ মাত্রায় অঙিজেন সরবরাহের প্রয়োজন পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে রোগীর জন্য একটি আইসিইউ-ভেন্টিলেটরের জন্য হাহাকার করেন স্বজনরা। কিন্তু এমন জরুরি মুহূর্তে ভেন্টিলেটর নয়, শ্বাসকষ্টের রোগীর জন্য হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলাই বেশি কার্যকর এবং জরুরি বলে জানান চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা টিমের ফোকাল পারসন ও মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. আব্দুর রব মাসুম। তিনি বলেন, করোনা আক্রান্ত জটিল রোগীদের জন্য বেশি প্রয়োজন হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা। এটির মাধ্যমে স্যাচুরেশন কমে যাওয়া রোগীকে ৭০-৮০ লিটার পর্যন্ত অঙিজেন সরবরাহ করা যায়। যেখানে সেন্ট্রাল অঙজেন লাইন বা সিলিন্ডার দিয়ে ১৫ লিটারের বেশি অঙিজেন সরবরাহ দেয়া সম্ভব হয় না।
শঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা আবারো জরুরি ও অপরিহার্য হয়ে উঠতে পারে মন্তব্য করে চিকিৎসকরা বলছেন- অকেজো হয়ে পড়া যন্ত্রগুলো সারানো না গেলে আরো হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা প্রয়োজন হতে পারে। তবে দান বা অনুদান হিসেবে এই যন্ত্র দিলে একটু ভালো মান দেখে দেয়ার জন্য দাতা ও বিত্তশালীদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনগরজুড়ে রিকশার দাপট
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে সর্বোচ্চ সংক্রমণ হার