হল্যান্ড থেকে

প্রবাসীর দৃষ্টিতে দেশ সাবাশ বাংলাদেশ!

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৩ জুলাই, ২০২২ at ৫:২০ পূর্বাহ্ণ

আমার মত বিদেশে যাদের দীর্ঘদিনের অবস্থান তাদের মাঝে স্বদেশ নিয়ে এক ধরনের উন্নাসিকতা লক্ষ্য করা যায়। স্বদেশ নিয়ে তারা কোন আড্ডা কিংবা কফি-চায়ের আসরে যে আলোচনায় মেতে উঠেন তার সারমর্ম এই- দেশ জাহান্নামে গেছে। রাজনীতিবিদ, আমলা, পুলিশ থেকে শুরু করে সবাই চোর, সবাই লুটপাট করে খাচ্ছে। দেশ চলছে আল্লাহর ওয়াস্তে। কোন সেক্টরে কোন সিস্টেম নেই, সব জায়গায় ‘সিস্টেম লস’। ঢালাওভাবে সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দেশের ‘ফোর্টিনথ-জেনারেশন’ উদ্ধার করেন তারা। কখনো-সখনো যে তাদের সাথে সুর মিলাইনি তেমনটি দাবি করতে পারিনে। তবে দু’বছরের ব্যবধানে দেশে এসে যেন নূতন এক বাংলাদেশকে আবিষ্কার করলাম। মনে মনে বলি, ‘সাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার/তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ তিন সপ্তাহ আগে দেশে এসেছি। এই লেখা যখন ছাপার অক্ষরে বের হবে তখন আমার অবস্থান হবে ওই সমস্ত প্রবাসীদের মাঝে, যারা কথায় কথায় দেশের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেন। কোভিডের কারণে মাঝে দু-বছর দেশে আসা হয়নি। প্রচন্ত গরম, সময় বৈরী। তারপরও ঠিক করি আর দেরি নয়, ঘুরে আসবো দেশ থেকে। এবার দেশে এসে মনে হলো এই দু’বছরে বাংলাদেশ অনেক পরিপূর্ণ হয়েছে এবং ‘পূর্ণতার’ দিকে এগিয়ে চলেছে। আমার এই বোধোদয়ের শুরু ঢাকা বিমান বন্দরে নেমে, ইমিগ্রেশন কাউন্টার, অতঃপর লাগেজ বেল্ট এবং এয়ারপোর্ট এলাকা ছাড়িয়ে উত্তরা যাবার পথটুকু পেরোতে গিয়ে। দু-বছর আগেও এয়ারপোর্ট নেমে সেখানকার বেহাল দশা দেখে, দেশে আসার আনন্দটুকু নিমিষে মিইয়ে যেত। মনে মনে বলে উঠতাম, অনেক হয়েছে, আর দেশে আসা নয়। কিন্তু ফিরে আসতাম দেশের টানে, নাড়ির টানে। এই এবার বোধকরি প্রথমবার, মনে মনে বলে উঠি, বাহ্‌, বেশ তো। এক ধরনের ভালো লাগা পেয়ে বসে। ‘পদ্মা সেতুকে’ ঘিরে গোটা দেশে আনন্দোৎসব। কেউ কেউ একে বাড়াবাড়ি বলেন। হয়তো কিছুটা বাড়াবাড়ি। তা হোক। কিন্তু দেশের জন্যে এটিতো বিরাট অর্জন। বঙ্গবন্ধু কন্যার জন্যে ছিল এ বিরাট বিজয়। তিনি দেশ ও দেশের জনগণকে দেয়া ‘কথা’ রেখেছেন। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তিনি জাতিকে দেয়া তার ‘ওয়াদা’ পূরণে সক্ষম হয়েছেন। তাই পদ্মা সেতুকে ঘিরে দেশব্যাপী উৎসব হতেই পারে।
যাই হোক- পরিপাটি করে সাজানো ঢাকা বিমান বন্দর, ঝকঝকে-তকতকে, অনেক গোছালো। ইমিগ্রেশন বিভাগ অনেক এফিসিয়েন্ট, কয়েক মিনিটেই সে ধাপ পেরিয়ে লাগেজ বেল্ট, সেখানেও খুব একটা দেরি হলোনা। এমনটি যদি ‘ব্যতিক্রম’ না হয়ে নিয়ম-মাফিক প্রতিদিন ঘটে, তাহলে বলতেই হয়, বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। তবে লক্ষ্য করি, দুবাই বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি থেকে আসা বাংলাদেশি অভিবাসীদের, বিশেষ করে শ্রমিক-যাত্রীদের মাঝে মধ্যে অহেতুক হয়রানি করা হচ্ছে। যা মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। লক্ষ্য করি তাদের কাউকে কাউকে আলাদা করে তাদের মালামাল চেক করা হচ্ছে, জেরা করা হচ্ছে। অথচ আমাদের মত সাহেবদের কিছুই জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে না। বিষয়টি আমার কাছে কেবল কষ্টকর নয়, অপমানজনক বলে মনে হয়েছে। বাংলাদেশে ফি-বছর যে ১৬ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আসে, তা আসে এই সমস্ত খেটে-খাওয়া প্রবাসী শ্রমিকদের হাত ধরে। এদের কষ্টার্জিত অর্থের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো সচল ও সক্রিয়। আমাদের মত ধুপ-ধুরোস্ত সাহেবদের কারণে নয়। কেননা এই সমস্ত শ্রমিক নিজে না খেয়ে, কষ্ট করে প্রবাসে দিন নির্বাহ করে তাদের আয়ের সিংহভাগ পাঠান দেশে, নিজ পরিবার, নিকটজনের কাছে। তাদের পাঠানো সেই অর্থে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। আর আমরা যারা তথাকথিত ‘হোয়াইট কালার্ড’ জব-করনেওয়ালা, আমাদের আয়ের বৃহৎ অংশ ব্যয় হয় নিজের, বিদেশে নিজ পরিবারের সদস্যদের আরাম-আয়েশের জন্যে। অথচ যাদের আয়ে বাংলাদেশ আজকের-বাংলাদেশে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে, তারা হচ্ছেন নিগৃহীত, লাঞ্ছিত। আশা করি অচিরে এই অবব্যস্থা দূর হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই ব্যাপারে সজাগ হবে। বাংলাদেশ যেমন আরো অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে, ঠিক তেমনটি এগিয়ে যাবে এই ক্ষেত্রেও।
ফিরে আসি চট্টগ্রামে। আমার অবহেলিত চট্টগ্রাম, বন্দর-নগরী চট্টগ্রাম। যেখানে আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া, বলা চলে আমার সব। দেখে মনে হয় এই নগরীর দশাও সেই ঢাকায় ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিকদের মত। যারা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে, জীবনকে বাজি রেখে কাজ করে অর্থ উপার্জন করে দেশে অর্থ পাঠান। দেশ চলে তাদের টাকায় অথচ তারা অবহেলিত। একই দশা বন্দর নগরী চট্টগ্রামেরও। বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্ত অবস্থান এই নগরীর জন্যে। অথচ ঢাকা কিংবা অন্যান্য জেলার মধ্যে যে উন্নয়ন লক্ষ্য করা যায়, তেমনটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে লক্ষ্য করা যায়না চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে। একই অভিমত পোষণ করেন বাংলাদেশের এক সিনিয়র কূটনীতিক ও সিনিয়র সাংবাদিক। দিন কয়েক আগে তাদের সাথে এই নিয়ে কথা হচ্ছিল। তারা বলেন, এক সময় চট্টগ্রামে যে সমস্ত যানবাহন বিশেষ করে ট্রাক আসতো তাদের থেকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন অক্ট্রয় (কর) পেতো। কিন্তু আশির দশকে এই ব্যবস্থা এরশাদ সরকার তুলে দেন। যেহেতু চট্টগ্রাম ‘গেইটওয়ে অব বাংলাদেশ’, চট্টগ্রাম দাবি করতে পারে যে এই বন্দরের আয়ের একটি অংশ নগরীর উন্নয়নের জন্যে ব্যয় করা হোক। কিন্তু তেমনটি হচ্ছেনা। জ্যেষ্ঠ এই সাংবাদিক বলেন, প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার পর এই বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তিনি চট্টগ্রামের দায়িত্ব নিলেন। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের উন্নয়ন যে একেবারে হয়নি তেমনটি বলা যাবে না। কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে টানেল হচ্ছে, দোহাজারী লাইন হচ্ছে এবং বন্দর এলাকায়ও অনেক উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘদিনের অবহেলিত কালুরঘাট ব্রিজ এখনো অবহেলিত রয়ে গেছে। অনেকে বলেন, কালুরঘাট ব্রিজটি চট্টগ্রামের দুঃখ। যেমনটি ছিল চীনের এক সময়কার দুঃখ হোয়াং হো নদী। এই ব্রিজ হয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামে যাদের চলাচল তাদের প্রতিদিন পোহাতে হয় সীমাহীন দুর্ভোগ। ঘন্টার পর ঘন্টা, অসহনীয় গরমে এই ব্রিজের দু’পাড়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায় সকল ধরনের যানবাহনকে, যাত্রী ও মালামাল সহ। কখনো আবার দেখা যায়, গাড়ি আটকে আছে ভাঙাচোরা ব্রিজের উপর। জ্যেষ্ঠ এই সাংবাদিক বলেন, বন্দরের কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার ভারী যানবাহন চট্টগ্রামে আসা-যাওয়া করছে। এতে চট্টগ্রামের পরিবেশ, আবহাওয়া হচ্ছে দূষিত, রাস্তার ওপর পড়ছে চাপ। পৌর কর্তৃপক্ষ যদি চলমান যানবাহন থেকে কর আদায় করতে পারতো তাহলে নগর উন্নয়নের জন্যে তীর্থের কাকের মত সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতোনা। এই দুই বিশিষ্ট ব্যক্তি বলেন, চট্টগ্রাম থেকে বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতা রয়েছেন, তাদের কেউ কেউ মন্ত্রী, এমপি। কিন্তু তারা এই ব্যাপারে খুব একটা সক্রিয় তেমন বলা যাবেনা। চট্টগ্রামের আজকের যে উন্নয়ন হচ্ছে তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদোগ্যে ও আগ্রহে হচ্ছে বলে তারা মন্তব্য করেন।
তারপরও চট্টগ্রামের বেশ কিছু ভালো লাগার মত ব্যাপার আমার চোখে ধরা পড়েছে। নারীরা অনেক বেশি বাইর-মুখো হয়েছেন। তাদের অনেককে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে দেখেছি। তরুণ-তরুণীদের শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে পাশাপাশি বসে, কোথায়ও কিছুটা নিবিড় হয়ে আড্ডা দিতে দেখেছি। প্রেস ক্লাব, স্টেডিয়াম এলাকা এদের উপস্থিতিতে বেশ প্রাণময় আকার ধারণ করেছে। নারীরা যত স্বাধীন হবে ততই দেশের জন্যে মঙ্গল। মেয়েদের দেখেছি বাইক, স্কুটি এমন কী সাইকেলও চালাতে। তারা এখন অনেক স্বাধীন। দেখে ভালো লেগেছে। তবে মানুষ আর যানবাহনের ভীড় বেড়েছে প্রচণ্ড। ট্রাফিক ব্যবস্থা বলতে কিছুই নেই। সার্টিক হাউজ এলাকাটি এক সময় কী চমৎকারই না ছিল। সেখানে খোলা মাঠে চেয়ার পেতে রাখতো রাস্তার-পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ক’টি রেস্তোরাঁ। তাদের মধ্যে অন্যতম দারুল কাবাব। এখন সেখানে মাছের বাজারের মত মানুষ আর দোকান গিজগিজ করছে। একই ভিড় চোখে পড়লো সিআরবি শিরীষ তলায়। কেন জানি মনে হলো, এক সময়কার প্রকৃতি-ঘেরা সৌন্দর্য হারাতে বসেছে গোটা সিআরবি এলাকা। তবে ভালো লেগেছে প্রেস ক্লাব ভবনের ‘বাতিঘর’। বিভিন্ন বয়েসী পাঠক-পাঠিকা, ক্রেতা, এমন কী দর্শকের ভিড়। ভালো বিক্রি হচ্ছে সেখানে। ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খেতে দেখলাম পুরুষ ও নারী দু কর্মচারীকে। বইয়ে এই প্রজন্মের আগ্রহ বাড়ছে বলে মনে হলো। অনেককে দেখলাম স্রেফ বেড়ানোর উদ্দেশে বন্ধু কিংবা বন্ধুনীকে সাথে নিয়ে আসতে। তারপরও বলবো সেটি ভালো। নিদেনপক্ষে রাস্তার ধারে পাশাপাশি না বসে বইয়ের কাছাকাছি তো এসেছে। সব শেষে বলি, ভালো-মন্দ মিলিয়ে এবারের চাটগাঁকে অনেক বেশি ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে দেশকে। জয়তু বাংলাদেশ।

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমুদ্র মরলে আমরাও মরবো
পরবর্তী নিবন্ধপটিয়ায় শিক্ষা বিস্তার ও আহমদ হোসেন খানের সাধনা