প্রায় এক সপ্তাহ ওরা থেকে গেল বাংলাদেশের দুটি নগরীতে– ঢাকা ও চট্টগ্রাম। কিন্তু এ দুটির কোনটিই তাদের তেমন করে দেখা হয়নি। মীরপুর, ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয় এলাকা, গুলশানের খানিকটা আর রায়েরবাজার ঘুরে এসে ঢাকা দেখা হয়েছে যেমন বলা যাবে না, ঠিক তেমনি চট্টগ্রামের জামালখান, পাহাড়তলী আর শহরের বাইরে রাউজান দেখে চট্টগ্রাম দেখা হয়েছে তেমনটিও দাবি করা যাবে না। আর একটি বাড়তি দিন ওরা থাকতে পারলে হয়তো তাদের আরো কিছু দেখা সম্ভব হতো। যে ক’দিন এখানে ছিল আক্ষরিক অর্থে ওদের দম ফেলার মত কোনো অবসর ছিল না। দিনে বিভিন্ন স্থানে চার থেকে পাঁচটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা চট্টগ্রামে সম্ভব হলেও ঢাকায় চিন্তার বাইরে। ফলে সকাল থেকে অনেক রাত অবধি সবাই ছিল ব্যস্ত। ঢাকায় ওরা ছিল মীরপুর এলাকায় এক এনজিওর নিজস্ব ভবনের ছয় তলায়, রেস্ট হাউজে। ওদের আসার আগে দুবার ঢাকা ক্লাব, একবার উত্তরা ক্লাব ও আর একবার উত্তরার কাছাকাছি একটি হোটেল বুক করা হয়েছিল। কিন্তু সব শেষে ‘প্রাইভেসি’ আমলে নিয়ে বাকি সব বাতিল করে রেস্ট হাউজে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ওই রেস্ট হাউজে ফাইভ–ষ্টার–ফেসিলিটি ছিল না, কিন্তু আরামে থাকার জন্যে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা ছিল। ছয় তলার যে উন্মুক্ত ‘টেরাস’ সে ছিল ওদের সবার পছন্দের। সাত তলার কেন্টিনে বাইরের কোন অতিথি বা অফিসের কেউ না থাকায় অহেতুক ও বিরক্তিকর কৌতূহলী দৃষ্টি ছিল না। ক্লাব বা হোটেলে থাকলে দশজনের মুখোমুখি হতে হতো। রেস্ট হাউজে ছিল সম্পূর্ণ প্রাইভেসী যা ইউরোপীয়রা পছন্দ করে। স্ট্যান্ড–বাই চব্বিশ ঘণ্টা কেয়ার টেকার ও দুজন দারোয়ান ছিল নিচে গেইটে। প্রয়োজনে সব সময় পাওয়া যেত দায়িত্বে নিয়োজিত তরুণ কর্মকর্তা, অংকুর চন্দ্র কুরিকে। বাইরের কারো আসার কোন সুযোগ ছিল না। একবার দলনেতা প্রাক্তন ডাচ সাংসদ হ্যারি ফান বোমেল ও অন্যানদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্থান বদল করবো কিনা। হ্যারির ত্বরিৎ উত্তর, ‘নো নিড এট অল, ইটস ফাইন’।
যাই হোক– লন্ডন থেকে আসা আনসার আহমদ উল্লাহ আগ বাড়িয়ে বলে রেখেছিলেন, ব্যস্ত শিডিউল থেকে অন্তত কিছুটা সময় যেন বের করা হয় যাতে ওরা কিছু কেনা–কাটা করতে পারে, এদিক–ওদিক ঘুরে দেখতে পারে। সেই মোতাবেক যেদিন ওদের মধ্যে লন্ডন থেকে আসা দুজন ঢাকা এসে পৌঁছায়, বিকেলে ঘুরে বেড়ায় মিরপুর আড়ং শপিং সেন্টার ও আশপাশ এলাকায়। কিন্তু মিরপুর আড়ং আহামরি গোছের কিছু নয়। এরপর আর এক বিকেলে টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজে ‘টক–শো’ শেষে সবাই মিলে আমাদের যাওয়া হয়েছিল বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্স। সেটি তাদের ভালো লেগেছিল। ভালো লেগেছিল চিটাগাং সিনিয়র্স ক্লাবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দেশের সংস্কৃতির কিছুটা হলেও তারা স্বাদ পেয়েছে। সিনিয়র্স ক্লাবে ২৫ জুলাই একাত্তর–জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে আয়োজন করা হয়েছিল এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এর দিন কয়েক আগে ক্লাবের সভাপতি ড. সেলিম আকতার চৌধুরী যখন বলেন, সম্মেলন–শেষে সন্ধ্যেয় ‘সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’ করলে কেমন হয়, তখন সাথে সাথে সে প্রস্তাব লুফে নিয়েছিলাম এই ভেবে তাতে এই সপ্তাহ খানেক একটানা সিরিয়াস আলোচনা শেষে ওরা একটু ভিন্ন আমেজ পাবে। খুব ব্যস্ত দিন ছিল পঁচিশে জুলাই। সম্মেলন শেষে লাঞ্চ সেরেই রাউজান। এই ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার প্রদীপ কুমার দত্ত। সেখানে দুটি স্থান পরিদর্শন, যেখানে একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনী হত্যা করেছিল নিরীহ জনগণকে। রাউজান যাবার পথে আমাদের বাহন থেমেছিল একটি স্থানে। রাস্তার ধারেই স্মৃতিস্তম্ভ। গাড়ি থেকেই চোখে পড়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছবি। গাড়ি থামিয়ে ইউরোপীয়দের পরিচয় করিয়ে দেই এই ব্যক্তিকে। বৃটিশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বের হবার জন্যে হাতে কলম তুলে নিয়েছিলেন আমাদের জাতীয় কবি, কাজী নজরুল ইসলাম। সে কারণে তাকে জেলে যেতে হয়েছিল, বৃটিশ ঔপনিবেশ শাসকদের হাতে নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছিল। ডাচদের সাথে বৃটিশ পর্যবেক্ষক, ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন নীরবে শোনে সে গল্প। বছর কয়েক আগে এই স্থানটিতে আমার প্রথম আসা। যে স্থানটিতে এই স্মৃতিস্তম্ভ সেখানে রয়েছে একটি বড় পুকুর। সেই পুকুরে কবি নজরুল স্নান করেছিলেন। সেখানে রয়েছে ছোট্ট একটি লাইব্রেরিও। এই সব কথা জেনেছিলাম সাংবাদিক বন্ধু এম নাসিরুল হকের মুখ থেকে। তাদের বাড়িতেই উঠেছিলেন কবি। সে ১৯৩২ সালের কথা। তিন দিন ছিলেন কবি রাউজানের হাজী বাড়িতে। হাজী বাড়ির উত্তরে বর্তমানে যেখানে পল্লী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অফিস সেখানে টিনের ঘেরা দিয়ে বসেছিল সাহিত্য আসর। কবি সেখানে বক্তব্য রেখেছিলেন, কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। ভাবতে অবাক সেই সময় অর্থের বিনিময়ে টিকেট কেটে প্রচুর দর্শক–শ্রোতার সমাগম হয়েছিল সেই সাহিত্য আসরে। তাতে উপস্থিত ছিলেন বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ। বন্ধু নাসিরুল হকের কাছ থেকে জানতে পারি, কবি নজরুলকে কলকাতা থেকে একশত টাকা সম্মানী দিয়ে ওই অনুষ্ঠানে আনা হয়েছিল। ফিরে আসি বাংলাদেশে আসা ইউরোপীয় প্রতিনিধি দল প্রসঙ্গে।
দলের অন্যতম সদস্য আমস্টারডাম ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এন্টোনি হোলস্ল্যাগ যেন এক ‘এবসেন্ট–মাইন্ডেড প্রফেসর’। তার কোন কিছুই ঠিক নেই, সব এলোমেলো। কাপড়–চোপড়, জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলা, কেমন যেন ভুলোমন। প্রাক্তন ডাচ সাংসদ হ্যারি ফান বোমেলের সাথে তার বেশ সু–সম্পর্ক। কথাটা এই কারণে বলা, বাংলাদেশে আসার আগে প্রফেসরের ভিসা প্রসেস, টিকেট কাটা, এমন কী অন–লাইনে চেক–ইন তার সব কাজ করে দিয়েছিল হ্যারি। তার কথা বলতে গিয়ে হ্যারি বেশ মজা করে বলে, ‘তার সাথে আমস্টারডামে অপেক্ষা করছি। অনেক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন সে আসে না, ফোন করি। তখন সে বলে, আজ কি দেখা করার কথা ছিল? তড়িঘড়ি করে টেক্সী নিয়ে অবশেষে সে আসে’। ঢাকায় অনুষ্ঠান শেষে তাকে অনেকেই ঘিরে ধরে। সে উত্তর দিতে থাকে। এদিকে আমাদের অন্য অনুষ্ঠানে যাবার তাড়া। ওকে ঘিরে থাকা উৎসাহীদের কাছ থেকে তাকে টেনে নেই। পথচারী আর ফুটপাতের উপর এলোমেলো পসরা নিয়ে বসা ভাসমান দোকানের ভিড়ে কথা বলতে বলতে হাঁটছি। হঠাৎ দেখা গেল এন্টোনি দলছুট। আমি পিছু হাঁটি। ভয়ও লাগে। যদি কোন বিপদ ঘটে। সামনে হ্যারি, আনসার উল্লাহ, ক্রিস, আর পেছনে এন্টোনির সাথে আমি। কাপড় চোপড়েও তেমন নজর নেই। আমাকে বেশ কয়েকবার তার কোটের, শার্টের কলার ঠিক করে দিতে হয়েছে। প্রথম দিন রাতে গুডনাইট বলে বিদায় নিয়ে যে যার কামরায় গেছি, এমন সময় আমার দরোজায় মৃদু কড়া নাড়ার শব্দ। খুলতেই দেখি এন্টোনি দাঁড়িয়ে। হাতে দাঁতের ব্রাশ। অপরাধির সুরে বলে, আমি টুথ–পেষ্ট আনতে ভুলে গেছি। যদি তুমি একটু দাও। উত্তরে বলি, এতো সংকোচ করছো কেন। টুথ পেষ্ট দেবার পর কেয়ারটেকার, গোবেচারা টাইপের ধনঞ্জয়কে ডেকে এন্টোনির জন্যে টুথ পেষ্ট কিনে আনতে পাঠাই। তখন রাত প্রায় বারো। আমাকে জড়িয়ে ধরে বার কয়েক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ‘শুভরাত্রি’ বলে বিদায় নেয়।
মজার ব্যাপার হলো, দলনেতা হ্যারির নেতৃত্ব সবাই মেনে নিলেও মনে মনে কিছুটা ক্ষোভ ছিল দলের আর এক সদস্য, বৃটিশ পর্যবেক্ষক, সবে ৪০ পৌঁছা ক্রিস ব্ল্যাকবার্নের। ক্ষোভ এই কারণে ঢাকা চট্টগ্রাম যেখানেই যাওয়া হচ্ছে সব জায়গায় প্রাধান্য পাচ্ছে ডাচ পার্লামেন্ট সদস্য, হ্যারি ফান বোমেল। পত্র–পত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেল সব জায়গায় সে প্রাধান্য পাচ্ছে। অথচ ক্রিস নিজে ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার থেকে ‘ফ্রেন্ড অব বাংলাদেশ’ পদক পেয়েছে। তার এই ক্ষোভ সে প্রকাশ করে লন্ডন থেকে আসা আনসার আহমদ উল্লাহর কাছে। তার এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এক সন্ধ্যায়, যেদিন তার পানাহারের পরিমাণ কিছুটা বেশি হয়েছিল। অবশ্য সবার সামনে সে কিছু বলেনি। হাসি কৌতুকে জমিয়ে রেখেছিল দিনগুলি। তারও রয়েছে মজার ঘটনা। লন্ডনে থাকে সে। ইন্ডিয়ান–ফুড সম্পর্কে ভালোভাবে জানা। এসেই দুপুরে আমরা তিনজন– আমি, আনসার আহমদ ও ক্রিস– রেস্ট হাউজের কাছাকাছি সাধারণ মানের ‘এসি’ আছে এমন এক রেস্টুরেন্ট লাঞ্চের জন্যে গেলাম। ভালো বিরিয়ানি কোথায় পাওয়া যাবে জানতে চাইলে সবাই বলে, রাস্তার পাশেই ‘রাব্বানী’ খুব ভালো। গেলাম। খুব মজা করে ক্রিস বিরিয়ানি ও চিকেন খেলো। চিকেনের সাথে যে মসল্লা ও ঝোল তার সবটি খেলো। খায় আর একটু পর পর বলে, ‘ফ্যান্টাস্টিক’। তার খাওয়া শেষ। হঠাৎ সে তড়িঘড়ি করে উঠে গেল। ফিরে এসে বলে, ‘খুব চাপ পড়েছিল। না গিয়ে পারছিলাম না। মজার ব্যাপার হলো, এখানে টয়লেটে কমোড নেই। মাটিতে বসে কর্মটি করতে হয়েছে’। আমরা হেসে খুন। বলি, কর্মটি করতে পারলে কী করে?
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট