হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৬ জুন, ২০২১ at ৭:০১ পূর্বাহ্ণ

মুক্তিযোদ্ধা ভাষা সৈনিক সাংবাদিক কামাল লোহানীকে যেভাবে দেখেছি : ১
গেল ২০ জুন ছিল তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। অনেকটা নীরবে চলে গেল বাংলাদেশকে একটি অসামপ্রদায়িক দেশ হিসাবে গড়ে তোলার জন্যে আজীবন লড়ে যাওয়া একুশে পদক প্রাপ্ত এই নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষা সৈনিক, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী, কামাল লোহানীর প্রথম এই দিনটি। শারীরিক গঠনের মত তার পোশাকী-নামটিও বেশ বড়, আবু নাঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। কিন্তু সবার কাছে তিনি কেবল ‘কামাল লোহানী’ নামেই পরিচিত। প্রথম দর্শনেই সবার দৃষ্টি কাড়তেন এমনই ছিল তার ব্যক্তিত্ব, শারীরিক সৌন্দর্য, চলন-বলন এবং আচার-ব্যবহার। ঋজু শারীরিক গঠন, চোখে মোটা ফ্রেমের কালো চশমা, আজানু লম্বা সাদা পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা, পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল, ভারি গলা, দেখতে অনেকটা বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের মত। দেখলেই সমীহ ও শ্রদ্ধাভাব জেগে উঠতো দর্শনার্থীর। তার নাম শুনেছি অনেক এবং অনেক আগ থেকে। কিন্তু সম্মুখ-সাক্ষাৎ ঘটলো অনেক পর, ১৯৮৪ সালে, যখন আমি চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক, ‘ডেইলী লাইফ’ ছেড়ে দ্বিগুণ বেতনে যোগ দিলাম ঢাকার ইংরেজি সাপ্তাহিক, দি টাইডে। তারপর মাস কয়েকের মাথায় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, সাংবাদিকদের জন্যে জাতীয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশে (পিআইবি) রিপোর্টার পদে নিয়োগ দেয়া হবে। পদমর্যাদায় প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা, বেসিক সেলারী ৭৫০ টাকা, প্লাস ঘরভাতা, বোনাস, গ্রাচুইটি, বাসা-অফিস গাড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি। লিখিত পরীক্ষায় দুজন টিকে গেলাম। অন্যজন ঢাকা হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজের এক তরুণ ইংরেজি শিক্ষক। মৌখিক পরীক্ষা হলো, টিকে গেলাম। ঢাকায় তখন মাত্র মাস ছয়েক, তেমন কাউকে চিনিনে, প্রেস ইনস্টিটিউটেরও কাউকে না। তবে একবার খুব সম্ভবত ১৯৮১ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে পিআইবিতে আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী এক প্রশিক্ষণ কোর্সে যোগ দিয়েছিলাম। সেবার চট্টগ্রাম থেকে আমার সাথে আরো দুই সাংবাদিক এই আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ কোর্সে যোগ দিয়েছিলেন। এদের একজন দৈনিক আজাদীর তৎকালীন স্টাফ রিপোর্টার আজকের প্রবীণ সাংবাদিক নাসিরুল হক এবং দৈনিক জমানার (মঈনুল আলম সম্পাদিত) নরেন চৌধুরী। যোগ দিলাম পিআইবিতে। অনিয়মের সাংবাদিকতা-জীবন ছেড়ে সাড়ে সাতটা-দুটো অফিস-বাসা, নুতন লাইফ স্টাইল। মন্দ নয়। ছকে বাঁধা জীবন যাকে বলে। চাকরির নিশ্চয়তা। সেই থেকে তাঁকে অর্থাৎ লোহানী ভাইকে আমার চেনা, কাছে আসা এবং একসাথে কাজ করা। প্রতিদিন অফিসের মিনি-সাইজ সুজুকিতে চড়ে বাসা-অফিস-বাসা করেছি বছর তিনেক- ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৭ সাল তক। আমাদের উভয়ের বাসা ছিল একই ডাইরেকশনে, ড্রাইভার ওয়াজিউল্লাহ প্রথমে আমাকে শাহজাহানপুর-বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে উপস্থিত হতো লোহানী ভাইয়ের মতিঝিল এজিবি কলোনির বাসায়। মাঝখানে আর এক কর্মকর্তা উঠতেন। আমাদের তিন জনকে নিয়ে এগিয়ে যেত ছোট্ট এই সুজুকি। একজন মানুষকে চেনা-জানার জন্যে তিন বছর খুব বেশি সময় না হলেও একেবারে কমও নয়। তারই আলোকে আজকের এই লেখা।
আমার সাথে যখন তার পরিচয় তখন কামাল লোহানী বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক। আমি রিপোর্টার। এই বিভাগ থেকে সাংবাদিকতা বিষয়ে একটি মাসিক প্রকাশনা বের হতো। তাতে বিশেষ কোন বিষয়ে বা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ঢাকা কিংবা ঢাকার বাইরে অনুষ্ঠিত সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ কোর্স কিংবা সেমিনারের রিপোর্ট করা ছিল আমার পেশাগত দায়িত্ব। আমার সেই রিপোর্ট জমা দিতে হতো লোহানী ভাইকে, কেননা তিনি ছিলেন ওই প্রকাশনার সম্পাদকও। তার অধীনে আরো কাজ করতেন আমার সহকর্মী রেহানা আখতার ঝর্ণা, সাংবাদিক বন্ধু মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের স্ত্রী। মনে পড়ে পিআইবিতে যোগ দেবার দিন কয়েক পর এক প্রশিক্ষণ কোর্স হয়েছিল। তার রিপোর্ট তৈরি করে দিন দুয়েকের মাথায় লোহানী ভাইয়ের কামরায় গিয়ে তার কাছে জমা দিলে তিনি কিছুটা অবাক হয়ে বললেন, ‘এতো তাড়াতাড়ি করে ফেললেন?’ তার কথা শুনে আমারও কিছুটা অবাক হবার পালা, কেননা দৈনিক পত্রিকায় রিপোর্টার হিসাবে কাজ করা ও অভ্যস্ত আমি দিনের রিপোর্ট দিনেই নিউজ ডেস্কে জমা দেয়ার সাথে পরিচিত। পরে জেনেছি এবং দেখেছি বাংলাদেশের আর পাঁচ-দশটা সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত অফিসের মত পিআইবিও চলে একই গতিতে (ধীর)। ফলে সেখানে কাজের চাইতে ‘আড্ডা’ দেয়ার সুযোগ ছিল বেশি। তবে মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর ও রফিকুল ইসলাম নাসিম (দুজনেই প্রয়াত) সহ আমরা ক’জন ছিলাম যারা কেবল আড্ডার মাঝে সময় নষ্ট না করে, অফিসের চৌহদ্দী পেরিয়ে অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করে ‘বাড়তি’ উপার্জন করতাম। অবশ্যই পিআইবি-র কাজ বাদ দিয়ে নয়।
তিন বছর কামাল লোহানী ভাইয়ের সাথে কাজ করেছি। অনেক সময় তার কামরায় গিয়ে সামনের চেয়ারে বসে ক্ষণিক আলাপে মেতেছি। আকারে, জ্ঞানে-গুণে সর্ব-বিবেচনায় তিনি ছিলেন বড়, কিন্তু কোনদিন এই নিয়ে বিন্দুমাত্র ‘অহং’ দেখিনি তার মাঝে। সহকর্মী হিসাবে তার ‘জুনিয়র’ হলেও তার আচরণ ছিল অত্যন্ত বন্ধুসুলভ। সমাজতন্ত্রে মনে-প্রাণে বিশ্বাসী বলে হয়তো এই গুণটা তার মধ্যে প্রোথিত ছিল। তিনি ছিলেন মওলানা ভাসানী ন্যাপের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং পাকিস্তান আমল থেকে অসামপ্রদায়িক রাজনীতির জন্যে লড়াই করে গেছেন আজীবন। আপোষ করেননি তার রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে। রাজনীতির সাথে তার সম্পৃক্ততা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। তখন তিনি পাবনা জেলা স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্র। পরবর্তী সালে অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে নুরুল আমিন সহ মুসলিম লীগ নেতাদের পাবনা আগমনের প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলায় পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের প্রিন্সিপাল সহ কামাল লোহানী এবং আরো জনা কয়েক সহযোদ্ধা গ্রেপ্তার হন। তখন তার বয়স মাত্র ঊনিশ। স্বাধিকার আন্দোলনে তিনি ১৯৫৫ সালে আবারো গ্রেপ্তার হন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের সাথে একই কামরায় জেলে ছিলেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে তাকে আত্মগোপনে যেতে হয়। (চলবে) লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজীবন বাঁচাতে মাদক সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জানুন
পরবর্তী নিবন্ধদাতা দেশ অভিধায় বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা