বাঙালির জীবনে উল্লেখযোগ্য
মাস মার্চ : পাকিস্তানকে ক্ষমা
চাইতেই হবে
মার্চ মাস চলে গেল। নতুন করে মনে করিয়ে দিলো একাত্তরের ভয়াল দিনগুলির কথা। বছরের এই মাসটি নানা ঘটনায় আমাদের দেশ ও জাতির জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ। মার্চ এলেই মনে পড়ে ২৫ মার্চের কালোরাত্রি। তখন আমাদের কতই বা বয়স। এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে সমবয়েসী শামীম সহ রাত সাড়ে এগারটার দিকে আমাদের পাশের বাসার সামনের মাঠে যে বিশালাকার কাঁঠাল গাছ, পাশে ল্যাম্পোস্ট, তার নিচে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। পুরো শহর থমথমে। চলমান গাড়ির তেমন শব্দ নেই। ৭ মার্চ থেকে চট্টগ্রামসহ গোটা দেশে এক ধরনের থমথমে পরিবেশ। দেশের নানা স্থানে টুকটাক অঘটন ঘটছে। বিহারী ও অবাঙালিদের উপর কোথায়ও কোথাও আক্রমণ হচ্ছে। আমরা যে এলাকাটিতে থাকতাম সেটি ছিল সরকারি আবাসস্থল। প্রতিবেশিদের মধ্যে কয়েকটি বিহারি ও পাঞ্জাবি পরিবার ছিল। গৃহকর্তারা বাবার সহকর্মী। আমাদের পাড়ায় দুদিকে মুখোমুখি বড় আকারের ১৮টি বাংলো-টাইপের বাসা। প্রতিটি বাসার সামনে বড় মাঠ। তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা প্রায় বাড়ি। তারই মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গেছে একটি পাকা রাস্তা। সেখানে বাইরের কোন গাড়ি চলতো না। সে রাস্তা মিশে গেছে দুদিকে বাইরের বড় রাস্তার সাথে। তার একটি চলে গেছে লাল ইমারতের বৃটিশ আমলে তৈরি দৃষ্টিনন্দন রেলওয়ে ভবনের দিকে, অন্যটি মিশেছে এনায়েত বাজারের দিকে এগিয়ে যাওয়া গাড়ি-রাস্তার সাথে। বাবা চাকরি করতেন রেলওয়েতে। সেই সুবাদে আমরা সেখানে। শুনেছি আমরা ওই পাড়ায় আসার আগে বাংলো-টাইপের বৃটিশ-ধাঁচে তৈরি এই বাসাগুলিতে বাস করতেন ইংরেজরা। পাড়ার নামটিও ছিল চমৎকার। বয়লিউ এভিনিউ। ইংরেজরা যাবার পর সেখানে আসে পাকিস্তানিরা, বাঙালি বিহারি, পাঞ্জাবি। বাসাগুলি ছিল দৃষ্টিনন্দন, কোন কোন বাড়ির সামনে বড় বাগান। তাতে শিউলী, গোলাপ থেকে শুরু করে নাম জানা অজানা নানা ফুলের গাছ। কোন কোন বাসার সামনে ছিল বিশাল আকারের তেঁতুল, জাম, কাঁঠাল, কুল ও কামরাঙ্গা গাছ। স্কুল-বয়সে অলস-দুপুরে গাছতলায় যেতাম। গাছের নিচে পড়ে থাকা জাম, তেঁতুল, কুল কুড়োতাম। ছোট ছোট পাথর ছুঁড়ে তেঁতুল, কুল আর জাম পাড়তাম। কখনো-সখনো মালিকের ধমক খেয়ে দৌড়ে পালাতাম। প্রতিবেশিদের সাথে ছিল এক সৌহার্দ্যের সম্পর্ক। আমাদের বাসার সাথে লাগোয়া বাদিকে ছিল অনেকটা আমাদের পারিবারিক সম্পর্কের মুকুল আপা-বাবুলদের বাসা, ডান দিকে প্রথমে ছিলেন এক বাঙালি পরিবার, বুলবুল ভাইরা থাকতেন। পরে ওনারা ঢাকা ঝিকাতলায় নিজ বাড়িতে চলে গেলে সেখানে আসে একটি অবাঙালি পরিবার। তাদের দ্বিতীয় ছেলে হাকিম। বড়ভাই ইঞ্জিনিয়ার। আমারই সমবয়েসী হাকিমের সাথে অল্পদিনে সদ্ভাব গড়ে উঠে। একসাথে আড্ডা দিতাম। একসাথে ফুটবল থেকে শুরু করে ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন খেলতাম বাসার সামনে বড় মাঠে। মার্চের শুরুর দিক থেকে পরিস্থিতি বদলে গেলে তারা (অবাঙালিরা) অনিরাপত্তায় ভুগে। তাদের নিরাপত্তা দেবার জন্যে পাড়ায় রাতভর পালা করে পাহারা দেয়া হতো, যাতে বাইরে থেকে কেউ এসে ওদের উপর আক্রমণ করতে না পারে। মনে পড়ে আমরা যারা বয়সে অন্যদের চাইতে ছোট ছিলাম কয়েকজন তাতে যোগ দিয়েছিলাম। যতটা না পাহারা দেয়ার জন্যে, তার চাইতে আমাদের আকর্ষণ ছিল রাতের বেলায় আড্ডা দিতে দিতে বার-কয়েক চা, চায়ের সাথে টাও। প্রতিটি বাসা থেকে পালা করে এই খাবারের ব্যবস্থা করতো। ভেতরে ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করতাম।
দিন এগিয়ে চলে। এক অজানা আশংকা সবার মনে। এলো ২৫ মার্চ। শুরুতেই বলেছি সমবয়েসী শামীমের কথা। রাত তখন প্রায় বারটা। হঠাৎ আমাদের বাসার অনতিদূরে আমবাগান নেভেল বেইস থেকে প্রচণ্ড হারে গোলাগুলির শব্দ ভেসে এলো। ভীতসন্ত্রস্ত আমরা দুটি কিশোর- আমি ও অবাঙালি শামীম- দৌড়ে নিজ নিজ বাসায় ফিরে যাই। সেদিনের পর শামীমের সাথে আর দেখা হয়নি। দেখা হয়নি তার ছোট বোন নাসরিনের সাথে। সেলোয়ার-কামিজ পরা সেই ছোট বোনটি আমাদের সাথে ক্রিকেট খেলতো। নাসরিন একটু ‘ছেলে-স্বভাবের’ ছিল। যাই হোক, পরদিন বাবা আমাকে পাঠিয়ে দিলেন গ্রামে পিসির বাড়িতে। বাবার একমাত্র ছোট বোন। মনে পড়ে সকালে চা খেয়ে রওনা দিয়েছিলাম পিসতুতো ভাই বাদলদার সাথে। এখন ভাবি কী করে এতটা পথ সেই বয়সে শহর থেকে হেঁটে পটিয়ায় গিয়ে পৌঁছেছিলাম। শুরু হলো বাঙালির প্রতিরোধ, অসম-যুদ্ধ। নিরস্ত্র বাঙালি অসম-সাহসিকতায় মুখোমুখি হলো দক্ষ হানাদার পাক-বাহিনীর। এতো গেল ২৫ মার্চের কথা। এর ১৮ দিন আগের দিন ৭ মার্চ ছিল বাঙালির জীবনে আর একটি স্মরণীয় দিন যা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়। নতুন ইতিহাসের পাতা খোলা হলো এই দিন। গোটা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে দেখলো এক অকুতোভয় ও সংগ্রামী নেতাকে। শুনলো তার বাণী, যে বাণী শোনালো জাতিকে আশা, দিল সাহস এবং দিক-নির্দেশনা। লাখো-লাখো জনতার সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চকন্ঠে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। গোটা জাতি হলো উদ্বেলিত। এর পর ১৭ মার্চ। যিনি গোটা জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে এগিয়ে যাবার নেতৃত্ব দিলেন সেই মহান নেতার জন্মও এই মাসে, দিনটি ১৭ই মার্চ। সেই জন্য বলি বাঙালি জাতির ইতিহাসে মার্চ মাস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেননা ১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে ৭ মার্চের জন্ম হতো না যেমন সত্যি, ঠিক তেমনি এটিও সত্যি জন্ম হতো না ২৫ মার্চের স্বাধীনতা সংগ্রাম।
ফিরে আসি ২৫ মার্চে। ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নামে নেমে এলো হত্যাযজ্ঞ। সে সময়কার ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের অনেক সাক্ষীর একজন বিকাশ রায়। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর হল্যান্ড আছেন জেনারেল ওসমানীর এক সময়কার সহচর, রায় বাবু। গতকাল কথা হচ্ছিল তার সাথে এই মার্চ মাসকে ঘিরে। তিনি বলছিলেন সে সময়কার ভয়াবহ মুহূর্তের কথা। মৃদুভাষী বিকাশ রায় থাকতেন রমনা কালী মন্দির ঘিরে যে বাড়িগুলো ছিল তার একটিতে। ২৭ মার্চের রাত্রে আকাশে এক ধরনের আলো ছড়িয়ে রমনা কালী মন্দির আক্রমণ করে পাক হানাদার বাহিনী। “বাবার সাথে আমি মন্দিরের নিচে একটি গুহায় লুকিয়ে রইলাম। পাক বাহিনী এসে আগুন লাগিয়ে দিল। সেখানে প্রায় ৩০০টি পরিবার বাস করতো। যাদের পেয়েছে তাদের দুটো লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করলো হানাদার বাহিনী। একটা সময় ওরা চলে গেলে আমরা বের হয়ে আসি। চারিদিকে কান্না, মৃতদেহ। তাদের মধ্যে আমার বন্ধু জয়ন্তও”, বলতেই একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বিকাশ রায়। “পরদিন আমরা ঢাকা ত্যাগ করি”। বেলজিয়ামে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশি আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর চৌধুরী রতন বলেন, “২৫ মার্চ রাতে কেবল ঢাকায় ৬০ হাজার লোককে হত্যা করে হানাদার পাক বাহিনী। কিন্তু এই সমস্ত খুনিদের বিচার এখনো করা সম্ভব হয়নি। জাতিসংঘ রুয়ান্ডা, কসোভো ও বসনিয়া গণহত্যার স্বীকৃতি দিলেও বিংশ শতাব্দীর সব চাইতে ভয়াবহ ১৯৭১ এর গণহত্যার এখনো স্বীকৃতি মেলেনি”। গতকাল হল্যান্ডের হেগ শহরে পাকিস্তান দূতাবাসের অনতিদূরে আয়োজিত এক বিক্ষোভ সমাবেশে জাহাঙ্গীর চৌধুরী এই বক্তব্য রাখছিলেন। এই অনুষ্ঠানে হল্যান্ড ছাড়াও বেলজিয়াম, জার্মানি থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা যোগ দিয়ে তাদের তীব্র ঘৃণা ও প্রতিবাদ জানান একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনীর গণহত্যার এবং তারা তাদের বক্তব্যে এই গণহত্যার জন্যে পাকিস্তান সরকারকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে দাবি জানান। পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে। বিচারের বাণী এখনো নিভৃতে কাঁদে। কিন্তু বাঙালির এই আন্দোলন থেমে যায়নি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। একাত্তরে যেমন বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল বাঙালি, ঠিক তেমনি এই আন্দোলনের বিজয় একদিন ধরা দেবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট