ট্রাম্প কি আবার ফিরে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে
যা হবার তাই হয়েছে। কেউ তাতে অবাক হননি। আমরাও না। সপ্তাহব্যাপী বহুল আলোচিত ইম্পিচমেন্টের (অভিশংসন) রায় যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে যাবে সে সবার জানা ছিল। গত ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুসারী ও সমর্থকদের সশস্ত্র আক্রমণে তিনি (ট্রাম্প) সম্পূর্ণভাবে দায়ী তা ডেমোক্র্যাট দলীয় ইম্পিচমেন্ট হাউস ম্যানেজাররা ভিডিও ফুটেজ সহ প্রমাণ করতে সক্ষম হলেও তাকে ফাঁসানো যায়নি। কেননা বিচার করেছেন যারা তারা দলীয়। অতএব রায় নিজ দলের পক্ষে আনার জন্যে রিপাবলিকান দলের শীর্ষ নেতারা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এবং সফলও হয়েছেন। সিনেটে মোট ১০০টি আসনের ৫০টি রিপাবলিকান দলের। সেখান থেকে মাত্র ৭ সিনেটর সত্যের পক্ষে গিয়ে ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্যে প্রয়োজন ছিল সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ ভোট অর্থাৎ মোট ৬৭টি ভোট। ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করে ভোট পড়েছে ৫৭টি (ডেমোক্র্যাট ৫০, রিপাবলিকান ৭)। রিপাবলিকান দলের আরো ১০ সিনেটর ভোট দিলে বিতর্কিত, নিন্দিত এবং পাশাপাশি জনপ্রিয় ট্রাম্পের রাজনৈতিক জীবনের অবসান হতে পারতো। কিন্তু হলোনা। এ যাত্রায় তিনি বেঁচে গেছেন। এখন তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাবেন দ্বিগুণ শক্তিতে মার্কিন রাজনীতিতে তার অবস্থান শক্ত করার। ট্রাম্প যে আগামী ২০২৪ সালের নির্বাচনে দাঁড়াবেন সেটি অনেকটা নিশ্চিত করে বলা যায়, যদিনা তিনি ইতিমধ্যে অন্য কোন আইনি জটিলতায় আটকে যান।
লক্ষ্যণীয়, এই রায়ের মধ্যে দিয়ে এই কথাটিই আবার প্রমাণিত হলো যে, যুক্তরাষ্ট্রের মত উন্নত দেশেও রাজনীতিবিদদের কাছে রাষ্ট্রের চাইতে ক্ষমতা বড়। নীতির চাইতে গদি বড়। কথাটা এই কারণে বলা, ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দেয়া মানে এই নয় যে তারা তাকে নির্দোষ মনে করেন। তারা তার পক্ষে ভোট দিয়েছেন ‘ভয়ে’ ও ‘আতংকে’। ভয় নিজের আসন হারানোর, আতংক নিজের গদি খোয়ানোর। তারা কোনোভাবেই সত্যের পক্ষে গিয়ে ট্রাম্পকে ক্ষেপাতে রাজি নন। কেননা তারা খুব ভালো করেই জানেন, ট্রাম্পের বিপক্ষে অবস্থান নিলে ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচন ও ২০২৪ নির্বাচনে তারা তাদের আসন হারাতে পারেন। গেল নির্বাচনে ট্রাম্প হেরে গেলেও ভোট পেয়েছেন প্রায় সাড়ে সাত কোটি। তার উপর তার রয়েছে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে বিশাল অন্ধ সমর্থক গোষ্ঠী, যারা তার কথায়, তার নির্দেশে হেন কাজ নেই যা করতে অপারগ। তার প্রমান আমরা পাই ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটাল হিল আক্রমণের মধ্যে দিয়ে। ট্রাম্প ক্ষমতায় না থাকলেও দলের মধ্যে এখনো তার প্রভাব প্রবল। সংসদীয় দলীয় প্রধান কেভিন ম্যাককার্থি সহ দলের শীর্ষ নেতারা তাকে রীতিমত সমীহ করে চলেন। পেছনে যাই বলুক সামনে বলেন ‘ইয়েস স্যার’, যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারী পছন্দের। সিনেট সংখ্যালঘু দলের (রিপাবলিকান) নেতা মিচ মেককনেল রায় ঘোষণার দিন সিনেটে দেয়া বক্তব্যে ৬ জানুয়ারি সশস্ত্র আক্রমণের জন্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এককভাবে দায়ী করে বলেন, ‘তার (ট্রাম্প) মিথ্যা ও উস্কানিমূলক বক্তব্যের জন্যে এই ধরনের দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে।’ অথচ মজার ব্যাপার হলো, তিনি ভোট দিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে এই যুক্তি দেখিয়ে যে, ক্ষমতার বাইরে থাকা প্রেসিডেন্টকে ইমপিচ করা আইন বহির্ভূত এবং তাকে বিচার করার এখতিয়ার সিনেটের নেই। পাশাপাশি এও বলেন যে, তাকে (ট্রাম্প) যদি বিচার করতেই হয় সে জন্যে দেশে আদালত আছে। একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে তাকে বিচার করার সুযোগ রয়েছে। তার এই দ্বি-মুখী ভূমিকার নিন্দা জানিয়ে হাউস অব রিপ্রেসেন্টেটিভসের স্পীকার, ন্যান্সি পলোসি তাকে ‘মেরুণ্ডহীন’ বলে আখ্যায়িত করেন। ‘কেবল যে সিনেট মাইরনিটি নেতা মিচ্ মেককনেল নিজেকে মেরুদণ্ডহীন প্রমাণ করলেন তা নয়, মেরুদণ্ডহীন প্রমাণ করলেন রিপাবলিকান দলের ৪৩ সিনেট সদস্য যারা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকার জন্যে মিথ্যের পক্ষে দাঁড়ালেন,’ বলেন বর্ষীয়সী এই মার্কিন রাজনীতিবিদ। রায় ঘোষণার পর সাংবাদিকদের সাথে তিনি যখন বক্তব্য রাখছিলেন তখন তাকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পই হলেন একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি দুই দফা অভিশংসন বিচারের (ইম্পিচমেন্ট) মুখোমুখি হলেন। তবে কোনটিতেই তাকে দণ্ডিত করা যায়নি। ডেমোক্রেটিক দলীয় প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন সহ যুক্তরাষ্ট্রের মোট ৪ প্রেসিডেন্টকে এই পর্যন্ত অভিশংসনের মুখে পড়তে হয়েছে, যদিও বা কেউ দণ্ডিত হননি। তবে এবারের বিচারে যে বিষয়টি উল্লেখ করার মত তা হলো, এবার তার নিজ দলের ৭ সিনেটর তাকে দন্ড দেয়ার পক্ষে তাদের রায় দিয়েছেন। যারা তার বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন তারা ইতিমধ্যে তাদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় ভোটারদের রোষের মুখে পড়েছেন। প্রশ্ন আসতেই পারে- মেজরিটি রিপাবলিকান সিনেটররা যা করতে পারলেন না, এনারা তা কী করে করতে সক্ষম হলেন? তার অর্থ কি এই যে এনারা সাহসী এবং তাদের কাছে ক্ষমতার চাইতে দেশ বড়? মজার ব্যাপার হলো, এই ৭ জনের সবাই হয় আগামী প্রাইমারীতে দাঁড়াবেন না কিংবা অবসরে যাবেন। অতএব ট্রাম্পের বিপক্ষে ভোট দিলে ভোটারদের রোষে পড়ার ভয় তাদের নেই, ভয় নেই গদি হারানোর। সেই কারণেই কি?
ট্রাম্পকে নির্বাচনে হারানোর পর ট্রাম্প-বিরোধীরা মনে করেছিলেন বড় বাঁচা বেঁচে গেছেন। কিন্তু তিনি এখনো মার্কিন রাজনীতিতে শক্তভাবে বসে আছেন এবং তাকে তার এই ‘শক্ত অবস্থান’ থেকে হটানোর মত অধিকতর ‘শক্ত নেতা’ রিপাবলিকান দলে বর্তমানে নেই। বলা চলে এই দলটি এখন ট্রাম্প-কেন্দ্রিক। দলের মধ্যে ট্রাম্প-আনুগত্যাকারীদের সংখ্যাধিক্য তারই প্রমাণ। দলের মধ্যে এই প্রথম কট্টর পন্থীদের আওয়াজ বেশি করে শোনা যাচ্ছে। এদিকে রায়ে নির্দোষ ঘোষণার পর বিজয়ের হাসি হেসেছেন ট্রাম্প। উৎফুল্ল দেশ জুড়ে তার সমর্থকরা। রায় ঘোষণার পরপর এক ঘোষণার মধ্যে দিয়ে তিনি বলেন, ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট আন্দোলন শুরু হচ্ছে, যা খুব তাড়াতাড়ি ব্যাপকভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।’ অন্যদিকে, নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ‘ইতিহাসের এই দুঃখজনক অধ্যায় আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে গণতন্ত্র ভঙ্গুর। গণতন্ত্রকে সর্বদা রক্ষা করা দরকার এবং এই জন্য অবশ্যই সবাইকে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে বলে বাইডেন বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে সহিংসতা ও উগ্রবাদের কোনো স্থান নেই এবং আমেরিকান হিসেবে, বিশেষ করে আমেরিকার নেতা হিসেবে প্রত্যেকের দায়িত্ব সত্যকে সমুন্নত রাখা। মিথ্যাকে পরাজিত করা।” কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। ট্রাম্প এই বিচারকে নিন্দা জানান, পাশাপাশি যে সমস্ত সিনেটর তার পক্ষে ভোট দিয়েছেন তাঁদের ধন্যবাদ জানান।
তবে ট্রাম্প যে একেবারে ঝামেলামুক্ত তা ভাবারও কোন কারণ নেই। ইতিমধ্যে স্পীকার ন্যান্সী পলোসি ৬ জানুয়ারি ঘটনার মূল কারণ বের করার জন্যে ‘নাইন-ইলেভেন’ ধাঁচের বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলে ঘোষণা দেন। এছাড়া ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্যে, সরকারি কর্মকর্তাকে ফোনালাপের মধ্যে দিয়ে নির্বাচনী ফলাফল তার পক্ষে নেবার জন্যে চাপ, ধমক, হুমকি, ট্যাঙ ফাঁকি এমনিতর আরো কতিপয় ইস্যুতে তার বিরুদ্ধে দেশের আদালতে মামলা করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে। যে বিষয়টি লক্ষ্যণীয় তা হলো, গোটা প্রক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দৃশ্যের বাইরে ছিলেন। যদিও বা তিনি বিষয়টিকে তার হাতের নাগালের বাইরে যেতে দেননি। প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ঐক্য ও সমঝোতার উদার আহবান জানান এবং রিপাবলিকান দলের বেশ কিছু নেতা তাতে সমর্থনও দিয়েছেন। রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ বাইডেন চাননি তার এই উদ্যোগে কোনভাবে ভাঙন ধরুক, যে কারণে তিনি এই ইম্পিচমেন্ট প্রক্রিয়া যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেরে ফেলার পক্ষে ছিলেন। বাইডেন চাইলে তার এক্সিকিউটিভ ক্ষমতা বলে এককভাবে অনেক কিছুই করতে পারেন। হাউস অব রিপ্রেসেন্টেটিভ তার দলের দখলে, সিনেট তার দলের দখলে, হোয়াইট হাউসও। কিন্তু তিনি চান বৃহৎ ঐক্যের মধ্যে দিয়ে দেশকে, দেশের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। গত চার বছরে ডোনাল্ড ট্রাম্প রাজনীতিতে, দেশের জনগণের মাঝে সৃষ্টি করেছেন বিভেদ, বৈষম্য। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইমেজ, সম্মান ভুলণ্ঠিত করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে করেছেন হেয়। দেখা যাক প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ জো বাইডেন সে বিভেদ ও অনৈক্য দূরীকরণে কতটুকু সফল হতে পারেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট