আট বছর আগে অর্থাৎ ২০১২ সালে করা মারাত্মক ভুলের খেসারত দিতে হলো ডাচ কোয়ালিশন সরকারকে ২০২১ সালে এসে। প্রবল সমালোচনা, প্রতিবাদ ও চাপের মুখে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, মার্ক রুটে এবং তার কোয়ালিশন সরকার। শিশু ভাতা বা ‘চাইল্ড বেনিফিট’ নিয়ে রুটে সরকার ২০১২ সালে প্রায় ২৬ হাজার নির্দোষ পিতা-মাতাকে অন্যায়ভাবে ‘ব্ল্যাক লিস্ট’ করে তাদের ‘জোচ্চুর’ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল এই মর্মে যে, এই সমস্ত পিতামাতা তাদের সন্তান সম্পর্কে মিথ্যা ও ভুল তথ্য দিয়ে সরকার থেকে বেআইনিভাবে নিয়মিত আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করেছেন। সরকার এই সমস্ত পরিবারকে পরবর্তীতে বাধ্য করে সেই অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে। ভুক্তভোগীরা সরকারের এই ভুল সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, আবেদন করেছিলেন এবং এমন কী আইনি লড়াইও লড়েছিলেন। কিন্তু কোন কিছুতেই সরকারের টনক নড়েনি। তার ফলশ্রুতিতে অনেক পরিবারে নেমে আসে আর্থিক বিপর্যয়, হতাশা, অশান্তি এবং অনেক পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঘটে বিচ্ছেদ। অন্যদিকে শিশুদের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। এ নিয়ে প্রতিবাদ উঠে আসে বিভিন্ন মিডিয়ায় এবং আলোচনা উঠে আসে পার্লামেন্টে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী রুটে সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বিষয়টি এড়িয়ে চলেন। অবশেষে প্রবল চাপের মুখে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেখানে তথ্য প্রমাণাদি সহ বেরিয়ে আসে যে সরকার ‘সম্পূর্ণ বেআইনি’ভাবে এই সমস্ত পরিবারকে শাস্তি দিয়েছে এবং তাদের কাছ থেকে শিশু ভাতা জোরজবরদস্তি কেড়ে নেড়ে হয়েছে। কেবল তাই নয়, তদন্তে দেখা গেছে যে, এই ২৬ হাজারের মধ্যে ১১ হাজার পরিবার যাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে, অর্থাৎ বিদেশি বংশোদ্ভূত, তাদের ক্ষেত্রে ‘বাড়তি তদন্ত’ করা হয়, যা অনেকে ডাচদের ‘সিস্টেমেটিক বর্ণবাদ’ বলে অভিহিত করেন।
তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হবার পর শিশু ভাতা নিয়ে এই কেলেঙ্কারিকে রুটে সম্পূর্ণভাবে ‘অন্যায় ও অগ্রহণযোগ্য’ উল্লেখ করে গেল ডিসেম্বর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সমূহকে ক্রিস্টমাস উৎসবের আগেই ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রত্যেককে ৩০ হাজার অর্থাৎ ৩০ লক্ষ বাংলাদেশি টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু নতুন বছর (২০২১) এলেও এখনো পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবাররা সেই অর্থের মুখ দেখেননি। এতে সরকারের সমালোচনায় মেতে উঠে বিরোধী দল। ক্ষতিগ্রস্তরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই নিয়ে সক্রিয় হন। সবাই রুটে সরকারের পতন দাবি করেন। যে মন্ত্রী (কোয়ালিশন সরকারের অন্যতম শরিক দল, লেবার পার্টির ৪৬ বছরের নেতা লোদেবাইক আসার) এই ‘কেলেঙ্কারির’ সময় ক্ষমতায় ছিলেন সামাজিক মাধ্যমে ভিডিও বার্তা দিয়ে গেল সপ্তাহে পদত্যাগ করেন। কেবল মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগই নয়, তিনি ঘোষণা দেন এই বলে যে, তিনি দলীয় প্রধানের পদ থেকেও পদত্যাগ করছেন এবং এই পদে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। (বাংলাদেশের মন্ত্রীদের জন্যে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ, যদিও তারা এ সমস্ত উদাহরণে কান দেন না।) লোদে আসারের আচমকা পদত্যাগ ক্ষমতাসীন কোয়ালিশন সরকারকে আরো বেকায়দায় ফেলে দেয়। অভিযোগের আঙুল প্রধানমন্ত্রী রুটের দিকে বাড়তে থাকে। অনেকে বলতে থাকেন, এখন তার যাবার সময় হয়েছে। তিনি অনেকদিন ক্ষমতা আঁকড়ে আছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, গত প্রায় ১০ বছর ধরে রুটে ক্ষমতায়। মাঝখানে তাকে আরো দু-বার ভিন্ন ইস্যুকে ঘিরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। কিন্তু সাধারণ জনগণের ভোটে জিতে তিনি পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন, যদিও বা তার দল কোনটিতেই একক সংখ্যাগরিষ্টতা পায়নি। তাকে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হয়েছে, আরো তিন দলের সাথে। সে দলগুলি হলো, সোশ্যাল লিবারেল হিসাবে পরিচিত ‘ডি-৬৬’, কনজারবেটিভ ক্রিস্টিয়ান পার্টি ‘সি ডি এ’ এবং কনজারবেটিভ গ্রিন হিসাবে পরিচিত ‘ক্রিস্টিয়ান ইউনিয়ন’। হল্যান্ডে বরাবর কোয়ালিশন সরকার গঠন হয়ে আসছে। আমার ৩০ বছর হল্যান্ড অবস্থানে দেখিনি কোন একটি দলকে এককভাবে সরকার গঠন করতে।
গত ১৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটে নিয়ম মাফিক ডাচ রাজার সরকারি বাসভবনে গিয়ে রাজার কাছে তার মন্ত্রিসভার পদত্যাগপত্র পেশ করেন। পার্লামেন্ট ভবন সংলগ্ন তার সরকারি অফিস থেকে তিনি সাইকেলে চেপে রাজবাড়ি পৌঁছান। প্রায়শঃ ডাচ প্রধানমন্ত্রীকে দেখা যায় তার বাসভবন থেকে সাইকেলে চেপে তার অফিসে আসতে। অকৃতদার এই ডাচ প্রধানমন্ত্রী, ৫৩ বছরের মার্ক রুটে তার সততা ও একনিষ্ঠতার জন্যে পরিচিত এবং এখনো সমানভাবে জনপ্রিয়। রুটে পদত্যাগ করলেও তিনি আসন্ন নির্বাচনে আবার জয়ী হয়ে ফিরে আসবেন তেমন সম্ভাবনা অনেকটা বেশি। বোধকরি তিনি নিজেও তা জানেন। আর জানেন বলেই তিনি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের মাত্র মাস দুয়েক আগে সরকার পতনের ঘোষণা দিলেন। এতে তার নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে সহায়ক বলে রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা ধারণা করছেন। রুটের জনপ্রিয়তা এই মুহূর্তে তুঙ্গে না হলেও হুমকির মুখে না, তা নির্দ্বিধায় বলা চলে। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বর্তমান সরকার তার নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। কেউ কেউ আশংকা প্রকাশ করেছিল এই বলে যে এমন সময় সরকারের পতন হলো যখন গোটা দেশ কোভিড-সমস্যায় হিমশিম খাচ্ছে। তবে রুটে এই বলে জনগণকে আশ্বস্ত করেন যে সরকার এই ব্যাপারে আগের মতোই কাজ চালিয়ে যাবে। উল্লেখ করা যেতে পারে, হল্যান্ডে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে এই পর্যন্ত ১৩.০৫৬ নাগরিক মারা গেছে। আক্রান্ত হয়েছে এই পর্যন্ত নয় লক্ষাধিক, যা মাত্র এক কোটি ৬০ লক্ষ জনগোষ্ঠীর এই ছোট দেশের জন্যে অনেক বেশি। বর্তমানে ‘লক ডাউন চলছে’ যা আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এখন স্কুল বন্ধ, বন্ধ রেস্তোরাঁ, পার্ক এবং শপিং মল। খোলা সুপারমার্কেট, ওষুধের দোকান, নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিষের দোকানপাঠ, কাঁচা-বাজার। অভ্যন্তরীণ রেল, বাস ও ট্রাম চলছে, তবে সরকার নেহায়েত প্রয়োজন না হলে তা এড়িয়ে যাবার জন্যে পরামর্শ দিচ্ছে। এদিকে এই লক ডাউন ঘোষণার পর দিন কয়েক আগে রাজধানীতে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও লক ডাউনের বিরুদ্ধে মারমুখী প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হলো। পুলিশ প্রথমে তাদের সরে যেতে বললেও প্রতিবাদকারীরা তাতে কোন কর্ণপাত না করায় তাদের ‘ওয়াটার কেনন’ এবং লাঠিপেটা করে তাড়িয়ে দেয়, গ্রেপ্তার করে শতাধিক প্রতিবাদকারী।
এদিকে লেবার পার্টি নেতা লোদেবাইক আসার মন্ত্রীত্ব ও দলের নেতৃত্ব থেকে পদত্যাগ করার দিন কয়েকের মাথায় লিলিয়ান পুলুমেন দলের নতুন নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। ৬৯ বছরের এই মহিলা ২০০৩ সালে ডাচ রাজনীতিতে যোগ দেন। নির্বাচনকে ঘিরে এখনো কোন আলোচনা বা উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য হল্যান্ডে নির্বাচন কখন আসে, কখন শেষ হয়, সে কেবল টের পাওয়া যায় টিভি পর্দা কিংবা পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলে। নির্বাচনকে ঘিরে এখানে কোন মিছিল বা আমরা যাকে বলি ‘পাবলিক মিটিং’ তেমন কিছু হয়না। কিছু ‘জনসংযোগ’ জাতীয় মিটিং ও প্রচারণা চলে। শহরের কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানে দলীয় ও প্রার্থীদের ছবি, পোস্টার চোখে পড়ে। কোন দেয়ালে চিকা বা পোস্টার মারা হয় না। তাতে জরিমানা জুটবে প্রার্থী বা দলের। যেটুকু নির্বাচনী প্রচারণাভিযান আগে হতো, এবার কোভিডের কারণে তাও হবেনা বলে অনুমান করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে, হল্যান্ডে ‘প্রতিরোধক-টিকা’ দেয়া শুরু হয়েছে। এদিকে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটে বিজয়ীর শীর্ষে আছে। তার অর্থ তিনি আবারো হতে যাচ্ছেন পরবর্তী মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী। দ্বিতীয় স্থানে আছে এন্টি-মুসলিম ও বিদেশী-বিরোধী হিসাবে পরিচিত উগ্র ডান নেতা, খিয়ের্ট বিল্ডার্সের দল, ‘পার্টি ফর ফ্রিডম’। তবে কোন দলই এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারবে না সে ধরে নেয়া যায়। এখন দেখা যাক, শেষতক কী ফলাফল হয়। সে জন্যে আমাদের আরো মাস দুয়েক অপেক্ষা করতে হবে। নির্বাচন হবে ১৭ মার্চ ২০২১। সেদিনের অপেক্ষায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট